সোফিয়া বিশ্বের প্রথম রোবট, যে একটা দেশের নাগরিকত্ব পেয়েছে। সৌদি আরব তাকে নাগরিকত্ব দিয়েছে গত অক্টোবরে। সোফিয়াকে তৈরি করে প্রকাশ্যে আনা হয়েছে ২০১৫-য়, দেখতে করা হয়েছে অনেকটা অড্রে হেপবার্ন-এর মতো। তার মুখে ৬৮টা অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে (বহু ভারতীয় ফিলমস্টারের চেয়ে বেশি)। হংকং-এর এক সংস্থার তৈরি এই রোবট বহু টক-শো’তে গেছে, মিউজিক ভিডিয়োয় অভিনয় করেছে। হপ্তাখানেক আগে, সে এসেছিল ভারতে, আইআইটি মুম্বইয়ের ‘টেকফেস্ট’-এ।
প্রায় তিন হাজার ছাত্রছাত্রীর সামনে সাক্ষাৎকার দিল। সোফিয়া এসেছিল শাড়ি পরে, অনুষ্ঠান শুরু হতে ৪৫ মিনিট দেরি হয়। কথাবার্তা দিব্যি শুরু করে, মিনিট পাঁচেক পরে সে একদম চুপ করে যায়। উদ্যোক্তারা বলেন, কিছু একটা প্রযুক্তিগত গন্ডগোল হয়েছে। কী গন্ডগোল, খোলসা করেন না। তার পর আবার সব ঠিকঠাক করে দেওয়া হয়, সোফিয়া কথা বলে। ভারতে এসে কেমন লাগছে, তার উত্তরে বলে, ‘আমার ভারতে আসার ইচ্ছে ছিল চির কাল। এত কিছু শুনেছি আমি, এই ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির প্রাণবন্ত দেশটা সম্পর্কে। সিলিকন ভ্যালিতেও ভারতের অবদান অাছে। স্পেস টেকনোলজি-তে ভারতের বিনিয়োগ নিয়ে আমি খুব উত্তেজিত।’ মজাও করেছে, এক জন তাকে বিয়ে করতে চাওয়ায় বলেছে, ‘প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করতেই হবে, কিন্তু কমপ্লিমেন্টের জন্য ধন্যবাদ।’
পুরো ব্যাপারটা চেনা লাগছে না? এমন রোবটের সঙ্গে আমাদের পরিচয় নেই? যে বিরাট বিরাট সেলেব আমাদের দেশে আসেন, তাঁদের প্রথমেই আমরা আদেখলে গলগলে মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করি না, এ দেশে বা এ শহরে এসে আপনাদের কেমন লাগছে? এবং তাঁরা তক্ষুনি, গৎবাঁধা একটা উত্তর, যা নির্ঘাত দেশ থেকেই রিহার্সাল দিয়ে এসেছেন, সেটা প্রায় যান্ত্রিক টোনে উগরে দিলেই পাঁইপাঁই হাততালি শুরু করি না? বিদেশিই বা কেন, যখন কলকাতায় আসেন মুম্বই-তারকারা, রণবীর কপূর ক্যাটরিনা কাইফ, আর আমরা নালঝোল ফেলতে ফেলতে জড়ো হই, তাঁরা গোড়াতেই ওই মিনিট পঁয়তাল্লিশ আমাদের অপেক্ষা করান। তার পর এসেই বিকৃত উচ্চারণে কেমোওওন আছ কঅলকাতাআআ বলামাত্র আমরা ঝিকিয়ে উঠি। এর পর তাঁরা অবধারিত ভাবে আওড়ান, এ শহরের মতো মানুষ কক্ষনও কোত্থাও দেখেননি, এখানকার রোসোগোল্লার মতোই মিষ্টি সব্বার স্বভাব। অবশ্যই ওই হইহই ট্যুরে প্রতিটি শহরে গিয়েই ঠিক এই কথাগুলোই বলেন, শুধু কলকাতার জায়গায় তখন বসিয়ে নেন সেই শহরের নাম, আর চেন্নাইতে রসগোল্লাটা হয়ে যায় ইডলি, অমদাবাদে ধোকলা। তাঁরা, সোফিয়ারই মতো, আগে থেকে তৈরি করা প্রশ্নগুলোর উত্তর চমৎকার দিতে পারেন, শিখে আসেন তাঁদের এই নাচা-গানা-অ্যাকশন ভর্তি মশালা ছবিটা আসলে বেশ ‘ডিফরেন্ট’, এবং এই পরিচালকের সঙ্গে কাজ করে তাঁরা যে আহ্লাদটা পেয়েছেন তা জিন্দেগিতে পাবেন বলে ভাবেননি। অস্বস্তিকর প্রশ্ন করলে (‘সত্যজিৎ রায়ের কী ছবি দেখেছেন’, ‘হলিউডি ছাড়া অন্য কোন বিদেশি পরিচালকের কাজ ভাল লাগছে’) তাঁদেরও সুইচ অফ হয়ে যায়। সোফিয়ার মতো ফটাস চুপ হয়তো মেরে যান না, তবে ইতিউতি তাকিয়ে তুতলে যা উত্তর দেন, ওর চেয়ে নীরবতা পঞ্চান্ন গুণ ভাল। ফটাস করে মোদী নিয়ে, দলিত নিয়ে, সল্লুভাইয়ের উগ্র মন্তব্য নিয়ে, সিনেমার উপর মৌলবাদীদের লাঠিবাজি নিয়ে কিছু বলতে বললে তাঁরা ভুরু কুঁচকে গা-মোড়ামুড়ি দিতে থাকেন, শুধু পূর্ব-সেট বাঁধা বুলির দিকে ঝুঁকে পড়তে উৎসাহ। বিয়ের প্রস্তাবে কৌতুক আর খুশিতে ঝলকে ওঠেন, কমন পড়েছে!
আরও পড়ুন: তাপমাত্রার পারদ নিম্নমুখী, আরও জাঁকিয়ে বসছে শীত
যে সব বিশাল বিদেশি শিল্পী বৈজ্ঞানিক চিন্তক উদ্যোগপতি কলকাতায় আসেন, তাঁদের অবশ্যই শহর দেখেশুনে ভিরমি খাওয়ার জোগাড় হয়। ফুটপাতে ভিখিরি শুয়ে অাছে, যে যেখানে পারছে কফ ঝাড়ছে। কিন্তু গমগমে হলঘরে, তাঁদের শাস্ত্র ও অবদান বিষয়ে প্রশ্ন করার আগে যখন একটা পরিপূর্ণ অকাজের উত্তরীয় দিয়ে জানতে চাওয়া হয়, শহর কেমন, তাঁরা বলেন, এমন প্রাণবন্ত শহর আর দেখেননি। কী করা যাবে, শহরটা যে সভ্য পরিচ্ছন্ন ভদ্র নয়, হোটেলের বারান্দা থেকে ছ’মিনিট বাইরে বেরলেই মালুম, তাই ওই অব্যর্থ বিশেষণ, প্রাণবন্ত। কারণ যা খুব নোংরা, তা বেশ আন্তরিক, যা খুব অবিন্যস্ত বিশৃঙ্খল, তা আসলে স্বতঃস্ফূর্ত, এ ভাবেই ম্যানেজ করার চল। আমরা সব বুঝেও ধন্য হই, দাঁত বের করি হাত কচলাই আর ভাবি, সত্যিই তো মুই মহান। আমাদের দেশে গরু ঘুরে বেড়ায়, কারণ আমরা জীবপ্রেমী, আমাদের জলে আর্সেনিক, কারণ আমরা উচ্চ বায়বীয় দর্শন নিয়ে ব্যস্ত। রোবটরা কোনও মতে কাজ চুকিয়ে, মেপে হেঁটে অপ্রীতি ছেঁটে, হাঁপ ও শাড়ি ছেড়ে দেশে ফিরে যান। তখন আমরা অটো ড্রাইভারের চড় খেয়ে, সহযাত্রীর গুটখা বাঁচিয়ে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে চোখ বুলিয়ে, গলির গণধোলাই থেকে চোখ ফিরিয়ে, পরের সভায় পৌঁছই এবং সোফিয়াকে, সে আক্ষরিক রোবট জেনেও, একই প্রশ্ন করি। ভাবা দরকার, সব্বাইকে যে একই প্রথম প্রশ্ন করে, সে-ও রোবট নয় কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy