ক্ষীণ গণস্মৃতিতেও ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারপর্বে ‘গুজরাত মডেল’-এর দামামা এখনও মুছিয়া যায় নাই। কৃতিত্ব গণস্মৃতির নহে, দামামার তীব্রতার। মডেলটি ঠিক কী, নরেন্দ্র মোদী বা তাঁহার বিপণন বিশেষজ্ঞরা কখনও ব্যাখ্যা করেন নাই। কিন্তু দেশবাসী ভাবিয়া লইয়াছিল, সেই মডেলেই অপুত্রের পুত্র হইবে, নির্ধনের ধন। সেই গুজরাত মডেল-এর প্রতিশ্রুতি নরেন্দ্র মোদীকে আমদাবাদ হইতে দিল্লির তখ্তে বসাইয়াছিল। সাড়ে তিন বৎসর পর, গুজরাতের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারপর্বে নরেন্দ্র মোদী দিল্লি ছাড়িয়া ফের গুজরাতমুখী হইয়াছেন। ইতিমধ্যেই পাঁচ দফা সফর হইয়া গিয়াছে। বিরোধীরা অভিযোগ করিতেছেন, তিনি যাহাতে প্রতিশ্রুতির বন্যা বহাইয়া দিতে পারেন, তাহার জন্য নির্বাচন কমিশন ভোটের দিন ঘোষণার কাজটি বকেয়া রাখিয়াছিল। মোদীর জনসভায় ব্যবসায়ীদের জন্য কর ছাড়, সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধা হইতে কৃষকদের জন্য ঋণ মকুব, হরেক প্রতিশ্রুতি শোনা গেল। গুজরাতের প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণের জন্য তিনি কংগ্রেসের দিকে আঙুল তুলিলেন, ব্যক্তিগত আক্রমণ শানাইলেন। কিন্তু, কী আশ্চর্য, ‘গুজরাত মডেল’-এর উল্লেখমাত্র করিলেন না। যে রাজ্যের ‘সাফল্য’-এর গল্পকে তিনি এবং তাঁহার বিজ্ঞাপন-সহায়করা গোটা দেশের ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষা’য় পরিণত করিয়াছিলেন, সেই রাজ্যের নির্বাচনে শুধুই খণ্ডজাতীয়তাবাদের উপর ভরসা করিতে হইতেছে কেন?
তাহার একমাত্র কারণ, ‘গুজরাত মডেল’ নামক বস্তুটি নিতান্তই হাওয়ার নাড়ু ছিল। কথাটি যে এই প্রথম প্রকাশ্যে আসিল, তাহা নহে। ২০১৪-পূর্ব সময়েও গণপরিসরে এই মডেল বিষয়ে সন্দেহ আলোচিত হইয়াছিল। কিন্তু, প্রচারের দামামা আর বিশ্বাসীদের জয়ধ্বনিতে তাহা টিকিতে পায় নাই। যাঁহারা এই মডেলের পতাকা বহন করিতেছিলেন, তাঁহাদের দাবি ছিল, শিল্পায়নের মাধ্যমেই অর্থনীতির যাবতীয় সমস্যার সমাধান সম্ভব, এবং গুজরাত তাহাই করিয়া দেখাইয়াছে। সে রাজ্যে কিসের মূল্যে শিল্পায়ন হইয়াছে, সেই প্রশ্নটি যদি উহ্যও রাখা যায়, ‘ট্রিক্ল ডাউন’ দর্শনের চুঁয়াইয়া পড়া উন্নয়ন যে মানুষের কাছে পৌঁছায় না, গুজরাত মডেল বিষয়ে মোদীর নীরবতাই তাহার সাক্ষ্য বহন করিতেছে। রাজ্যে আর্থিক অসাম্য বিপুল। দেশের ২০টি প্রধান রাজ্যের মধ্যে দারিদ্রসীমার ঊর্ধ্বে থাকা মানুষের অনুপাতে গুজরাত দশম স্থানে। ১৯৯৩ সালে গুজরাত দেশে তৃতীয় স্থানে ছিল। উল্লেখ্য, এই একই সময়কালে কেরল ষষ্ঠ হইতে প্রথম স্থানে উঠিয়া আসিয়াছে।
রাজ্যের বিভিন্ন সূচকের মধ্যে বৈপরীত্যটি খেয়াল করিলেই বোঝা যায়, কেন রাজ্যের নির্বাচনে ‘গুজরাত মডেল’ বিষয়ে সম্পূর্ণ মৌনই বুদ্ধিমানের কাজ। রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের হিসাবে গুজরাত দেশে চতুর্থ, তাহার বৃদ্ধির হারে তৃতীয়, মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদনেও তৃতীয়। অথচ, ২০টি প্রধান রাজ্যের মধ্যে শিশুমৃত্যুর হারে তাহা একাদশ স্থানে, লিঙ্গ-অনুপাতে পঞ্চদশ, প্রত্যাশিত গড় আয়ুতে দশম। অর্থাৎ, ‘গুজরাত মডেল’ নামক বস্তুটি মানুষকে দেখিতে পায় নাই, শুধু শিল্পের আরাধনা করিয়া গিয়াছে। শিকাগো স্কুলের দিকপালরাও ইহাকে ধনতান্ত্রিক উন্নয়নের পরাকাষ্ঠা বলিয়া দাবি করিবেন না। গোটা রাজ্যে বিজেপি-র বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হইয়াছে, নোটবাতিল বা জিএসটিই তাহার একমাত্র কারণ ভাবিলে মস্ত ভুল হইবে। উন্নয়নের চূড়ান্ত অভাব রাজ্যের মানুষের প্রাত্যহিকতায় গভীর ছাপ ফেলিতেছে। নরেন্দ্র মোদীর প্রতি সামাজিক অবজ্ঞা এবং বিরোধী নেতা হিসাবে রাহুল গাঁধীর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি— উভয় প্রবণতাকেই এই অভাবের প্রেক্ষিতে দেখা বিধেয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy