সংস্কৃত কলেজ। ছবি: পরিমল গোস্বামী
ঐতিহ্যগত ভাবে টোল-চতুষ্পাঠীর পঠনপাঠনের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল কোনও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পাঠ শেষ করার উপর জোর না দিয়ে প্রধানত পঠিতব্য বিষয়কে গভীর ভাবে অনুশীলন করা। এই গভীর অনুশীলনের ফলেই অতীতে টোলের বহু ডাকসাইটে পণ্ডিতমশাইদের বিদ্যাবত্তার রোশনাই কেবলমাত্র টোলের চৌহদ্দিতেই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং সংস্কৃত শাস্ত্রের উচ্চতম গবেষণার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। টোল-চতুষ্পাঠীর পঠনপাঠনকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এই গৌরবের অতীতকে ভুলে গেলে চলবে না। এ বিষয়ে কিছু কথা এই লেখার প্রথম পর্বে (‘ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে’, ২৯-৬) বলা হয়েছে।
টোল-চতুষ্পাঠীর পাঠ্যক্রম বানাতে হবে এমন ভাবে, যাতে আজকের সামগ্রিক পরিবেশের সঙ্গে মানানসই করে নিয়ে গুরু-শিষ্য পরম্পরার নন-ফরমাল অধ্যয়ন-অধ্যাপনার রীতিকে যত দূর সম্ভব রক্ষা করা যায়, আবার অন্য দিকে ইঙ্গ-সংস্কৃত পাঠ্যক্রমের শেষে অর্জিত বিএ এমএ ডিগ্রির সমতুল উপাধি প্রদান করে টোল-চতুষ্পাঠীর ছাত্রছাত্রীদের শুধু সংস্কৃত শিক্ষকদের জন্যে নির্দিষ্ট পরীক্ষাই নয়, সব ধরনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসার সুযোগ করে দেওয়া যায়। তার জন্যে পাঠ্যক্রমের বিভিন্ন স্তরে উপযুক্ত মানের মাতৃভাষা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি একান্ত প্রয়োজনীয়, যাতে এই পাঠ্যক্রমকে ইঙ্গ-সংস্কৃত পাঠ্যক্রমের সমতুল বলায় কোনও বাধা না থাকে। এই ধরনের সিলেবাস গড়ে তুলতে পারলে সংস্কৃত ভাষার বলয়ে বিস্তৃত ভাবে ব্যাকরণ, কাব্য, অলঙ্কার এবং অন্যান্য শাস্ত্র, দর্শন ইত্যাদি পাঠের জন্যে উপার্জনমুখী মুক্তবিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থার তুলনীয় একটি বিকল্প টোল-চতুষ্পাঠী শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হতে পারে, যা আমাদের অতীত ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার পক্ষেও সহায়ক হবে।
১৯৬০-এর দশকে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ তথা বঙ্গীয় সংস্কৃত শিক্ষা পরিষদের তদানীন্তন সচিব, অধ্যাপক বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য বঙ্গীয় সংস্কৃত শিক্ষা পরিষদের পঞ্চদশ ও ষোড়শ বার্ষিক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে খেয়াল করিয়ে দিয়েছিলেন, নব্যন্যায়-এর উৎপত্তিস্থল এই বাংলাতেই তার চর্চা ভীষণ ভাবে কমেছে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, যে সব বিষয়ের পাঠ ও চর্চা খুব কমে গিয়েছে, তাদের পঠনপাঠনে যদি অবিলম্বে উৎসাহ না দেওয়া যায়, অচিরেই হয়তো সেই সব বিষয় বিস্মরণের অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। টোল-চতুষ্পাঠীর শিক্ষা সম্পর্কে যাঁরা সামান্য খোঁজ রাখেন তাঁরা জানেন, গত পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে বঙ্গীয় সংস্কৃত শিক্ষা পরিষদের তীর্থধারীদের মধ্যে সিংহভাগই সারস্বত ব্যাকরণ, পৌরোহিত্য ইত্যাদি সহজে উপাধি অর্জন করা যায় এমন কয়েকটি বিষয়কে পাঠ্য বিষয় হিসাবে বেছে নিয়েছেন। নব্যন্যায়, প্রাচীন ন্যায়, এবং অন্য দর্শনভিত্তিক অপেক্ষাকৃত কঠিন বিষয়গুলি পড়ার লোক ছিল না বললেই হয়। দীর্ঘ কাল ধরে এই ধারা অব্যাহত থাকায় বর্তমানে এ সব বিষয়ে অধ্যাপকও প্রায় অমিল। এই অবস্থা সৃষ্টির পিছনে কারণগুলি হল: ১) পশ্চিমবঙ্গ সরকার কোনও আমলেই দর্শনভিত্তিক বিষয়গুলি পড়ার জন্যে কোনও বাড়তি উৎসাহ দেখায়নি, ২) টোলের অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করার সময় কাব্য, দর্শন ও বিভিন্ন শাস্ত্রের চর্চা ও প্রসার সমান ভাবে অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে টোলওয়াড়ি বিষয়ভিত্তিক সমানুপাতিক সংখ্যার অধ্যাপক-পদ সৃষ্টি করার কথা কোনও দিন ভাবা হয়নি, ৩) যে যে বিষয়ের অধ্যাপক ইতিমধ্যেই বহু সংখ্যায় নিয়োগ করা হয়ে গিয়েছে সেই সব ক্ষেত্রে ওই সংখ্যাকে আর বাড়তে না দিয়ে অন্যান্য বিষয়ের জন্য অধ্যাপক নিয়োগ করা হয়নি, ৪) অধ্যাপক নির্বাচনের সময় কে কোন বিষয়ে তীর্থধারী এবং সেই মুহূর্তে সেই বিষয়ের অধ্যাপকের আর প্রয়োজন আছে কি না, সেই বিশ্লেষণ না করে যে কোনও বিষয়ে তীর্থধারী হওয়ার পরে কে কত দিন অধ্যাপক হওয়ার প্রতীক্ষায় ছিলেন সেই বিষয়কেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
অধ্যাপক নিয়োগে এই অসঙ্গতির সুযোগে টোল-চতুষ্পাঠীর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে দ্রুত উপাধি অর্জনের প্রবণতা দেখা গিয়েছে এবং সেই কারণেই দর্শনভিত্তিক বিষয়গুলির চর্চা ধারাবাহিক ভাবে কমে এসেছে। ছাত্রছাত্রীরা জানেন, সারস্বত ব্যাকরণ বা পৌরোহিত্যের উপাধিধারী অধ্যাপক যে বৃত্তি পান, ন্যায়ের বা বেদান্তের উপাধিধারী অধ্যাপকও তা-ই পান। এ কথা ঠিক, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে বহু-অভিলষিত কঠিন বিষয়ের অধ্যাপকের বেতনের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত সহজ ও জৌলুসহীন হিসাবে প্রচারিত বিষয়ের অধ্যাপকের বেতনের ফারাক থাকে না। ফারাকটা হয় অন্য ভাবে। উচ্চতর গবেষণার পরিসর বহু-অভিলষিত কঠিন বিষয়ের ক্ষেত্রে অনেক বিস্তৃততর হওয়ায় অধ্যাপকের বহু পদ সেখানে নানা স্তরে নানা মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা পায়, দ্বিতীয় ক্ষেত্রের অধ্যাপকদের পক্ষে সাধারণ ভাবে যে পর্যায়ে পৌঁছনো সম্ভব হয় না। টোল-চতুষ্পাঠীর ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে, কঠিন বিষয়গুলির জন্য অধ্যাপকের পদ বেশি থাকবে সে প্রশ্নই নেই, কারণ, একটু আগেই বলেছি, বিভিন্ন বিষয়ের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব না দিয়ে প্রতীক্ষা সংক্রান্ত তথ্যই গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। আসলে কোনও নির্দিষ্ট বিশ্বাসভূমি সৃষ্টির তাগিদে নয়, কাব্য, দর্শন ও সেই সব শাস্ত্রের চর্চা ও গবেষণার ক্ষেত্র প্রসারিত করতে হবে, যার মধ্য দিয়ে সর্বজনস্বীকৃত আমাদের গৌরবময় ইতিহাসকে আমরা মনে রাখব। টোল-চতুষ্পাঠীর পঠনপাঠনের ঐতিহ্যকে দীর্ঘ মেয়াদে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এ বিষয়ে সুপরিকল্পিত নীতি নির্ধারণ একান্ত প্রয়োজনীয়।
(শেষ)
বঙ্গীয় সংস্কৃত শিক্ষা পরিষদের ভূতপূর্ব সচিব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy