কাটোয়ার দীক্ষাবাড়িতে শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীচৈতন্যদেব ও জগন্নাথের মূর্তি। ফাইল ছবি
বসন্ত আসার পরে যে উৎসবটিতে বাঙালিরা এক সঙ্গে মেতে ওঠেন সেটি হল দোল। বাঙালি সমাজে দোল উৎসবের শুরু কোথায় এবং কবে হয়েছিল তা নিয়ে নানা মত থাকলেও প্রাচীন যুগ থেকেই এই উৎসবটির অস্তিত্ব ছিল। এই উৎসবের সঙ্গে পুরাণ, লোককথা, কিংবদন্তি— জড়িয়ে রয়েছে অনেক কিছুই। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে দোল উৎসবের তাৎপর্য অনেক। শ্রীবিষ্ণু যখন তাঁর ভক্ত প্রহ্লাদকে বাঁচাতে দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু ও তাঁর বোন হরিকাকে বধ করলেন, তখন মর্ত্যবাসী আনন্দে হোলি খেলেছিলেন। আবার কোনও কোনও পুরাণে বলা হয়েছে, মহাদেব যখন তাঁর তপস্যায় বিঘ্ন ঘটানোর অপরাধে কামদেবকে ভস্মীভূত করলেন, তখন মদনের স্ত্রী রতি ও উমার অনুরোধে ও প্রার্থনায় দেহহীন ভাবে মদনকে বাঁচিয়ে তোলেন তখন মর্ত্যবাসী আনন্দে দোল খেলেছিলেন। আর একটি মতে দ্বাপর যুগে শ্রীকৃষ্ণকে হত্যা করার জন্য মথুরারাজ কংস একের পর এক দৈত্যকে পাঠিয়েও যখন সফল হচ্ছিলেন না। তখন ভয়ঙ্কর ম্রেধাসুরকে পাঠালেন কৃষ্ণকে হত্যা করতে। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর হাতের বাঁশিটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে সেই দৈত্যের চোয়ালে আটকে দিয়েছিলেন এবং তাঁর গায়ে আগুন দিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। অনেকে বলেন, এই ম্রেধাসুরের গায়ে আগুন দিয়ে হত্যা করার সূত্র ধরেই দোলের আগের দিন ম্যাড়া পোড়ানোর রীতি প্রচলিত হয়েছে। সেই দৈত্যকে হত্যার আনন্দের সুবাদেই নাকি হোলি খেলার সূত্রপাত। অন্য এক কাহিনি থেকে জানা যায়, পুতনা রাক্ষসী যখন ছদ্মবেশে তাঁর স্তনে বিষ মিশিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে পান করাতে যান তখন সেই স্তন কামড়ে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে হত্যা করলেও, সেই বিষের প্রভাবে তাঁর সারা দেহ নীলবর্ণ ধারণ করে। এই গাত্রবর্ণের জন্য রাধা তাঁকে পছন্দ করবে না, মায়ের কাছে এই অভিযোগ করলে, মা যশোদা বলেন, রাধা তাঁকে তাঁর নিজের পছন্দের রঙে সাজিয়ে নেবেন। শ্রীকৃষ্ণকে রাধার এই রঙ মাখানো থেকেই হোলির শুরু।
হোলি বা দোল মূলত শ্রীকৃষ্ণের লীলা সমৃদ্ধ হলেও বৈষ্ণবতীর্থ কাটোয়ায় এই হোলির তাৎপর্য আলাদা। যেহেতু শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মতিথি এই দোলপূর্ণিমা, তাই এখানকার দোল মূলত গৌরাঙ্গকেন্দ্রিক। কাটোয়ার দোলের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য এখানকার দোল উৎসব তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত। বৈষ্ণবধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হওয়া সত্ত্বেও ছোট, বড় অনেক মন্দির রয়েছে এখানে। মূলত রাধাকৃষ্ণ এখানে বিভিন্ন রূপে বিরাজ করেন। এখানকার রাধাকান্তদেবের মন্দির, ষড়ভুজা মন্দির, রাধামাধব মন্দির, সখীর আখড়া, আশ্রমে দোল পূর্ণিমার দিন হোলি উৎসব পালিত হয়। আগের দিন রাতে ম্যাড়া পোড়ানো ছাড়াও দোলের দিন ভোগপুজোও হয়ে থাকে।
কাটোয়ার কাছেই বিকি হাটে রয়েছে শুকদেব ব্রহ্মচারীর আশ্রম। ভারতবর্ষের নানা প্রান্ত, এমনকি, বাংলাদেশের নাগরিকেরাও দোল উপলক্ষে এই আশ্রমে সমবেত হন। হাজার হাজার ভক্ত ও অতিথিবৃন্দের বিনা খরচে খাওয়া এবং থাকার বন্দোবস্ত করা হয়। দোল উপলক্ষে চার-পাঁচ দিনের মেলাও বসে এই আশ্রম চত্বরে। মন্দির চূড়ায় ধ্বজা উত্তোলনের মধ্যে দিয়ে এখানে দোল উৎসবের শুরু হয়। পরে বাজনা, আবির নিয়ে শহর পরিক্রমা বা ধুলোটের মধ্যে দিয়ে এখানে উৎসবের সমাপ্তি ঘটে।
দোল উৎসবের দ্বিতীয় পর্যায়ে হয় মহাপ্রভুর দোল। এই দিনটি শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মতিথি। কাটোয়ার বিভিন্ন মন্দিরে এই দিন চৈতন্যদেবের অভিষেক হয় এবং চৈতন্যদেব, নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর বিগ্রহ নিয়ে শোভাযাত্রা বার হয়। এই শোভাযাত্রাটি শহর পরিক্রমা করে। বিকেলের দিকে গঙ্গার দিকে ম্যাড়া পোড়ানো হয়। এই ম্যাড়া পোড়ানো অশুভ শক্তির বিনাশের প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়। পরের দিন হয়, হোলিখেলা। কাটোয়ার আপামর জনসাধারণ মহাপ্রভুর দোল উপলক্ষে দ্বিতীয় দিনে হোলি খেলায় সামিল হন। সকাল থেকে গোলা রং ও জল রং ব্যবহার করা হয়। বিকেলের দিকে চলে আবির খেলা। কীর্তন, ভাগবত পাঠ, ভক্তিগীতি, হরিনাম সঙ্কীর্তনের আসর বসে। বহু ভক্ত প্রসাদ পান। কাটোয়ার তাঁতিপাড়ায় প্রায় তিন শতাব্দী পুরনো চট্টরাজবাড়ি এবং ঠাকুরবাড়ির দু’টি রাধাগোবিন্দ মন্দিরে দোলপূর্ণিমার পঞ্চম ও ষষ্ঠ দিনে উৎসব পালিত হয়। এই দুই বাড়ির ম্যাড়া পোড়ানো হয়, কারবালাতলার কাছে তিন রাস্তা সংযোগে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ দোলের দিন নাম সঙ্কীর্তন, ভোগপুজো, আরতি ছাড়াও বহু মানুষ ধনী, দরিদ্র, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে প্রসাদ গ্রহণ করে।
এ ছাড়াও বর্তমানে বিভিন্ন সংস্থা শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসবের অনুসরণে দোল ও হোলি উৎসব সূচনা করেছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত, নৃত্য, আবিরখেলা, মিষ্টিমুখ, প্রভৃতিতে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে এই ছোট শহরটি।
কাটোয়ার গৃহশিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy