কেন্দ্রীয় বাজেট নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। আমি দু’একটি বিশেষ দিক নিয়ে আলোচনা করব। বাজেটের নথিপত্র পড়লেই দেখা যায়, ‘কোর অব দ্য কোর’, অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলির মধ্যে যেগুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, তাদের কয়েকটিতে বাজেট বরাদ্দ বিশেষ বাড়েনি। যেমন রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্প বা এনআরইজিএ-তে ব্যয়বরাদ্দ মোটামুটি একই আছে, ৬০,০০০ কোটি টাকা। সদ্য-ঘোষিত কৃষকদের অতিরিক্ত আয় প্রকল্প কোর অব দ্য কোর-এ নেই। এটি আছে কৃষি বিভাগের আওতায় বিভিন্ন কেন্দ্রীয় দফতরের জন্য নির্দিষ্ট ‘ইনকাম সাপোর্ট প্রোগ্রাম’ বা আয়-সাহায্য হিসাবে। অথচ সারা বছরের হিসাব ধরলে, এর বরাদ্দ ৭৫,০০০ কোটি টাকা এনআরইজিএ’কে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এনআরইজিএ আর আয়-সাহায্য, দুই প্রকল্প মিলিয়ে ১,৩৫,০০০ কোটি টাকার দায়ভার বহন করতে হবে দেশকে। ক্রমশ সে বোঝা সম্ভবত বাড়বে— এমন জনমোহিনী প্রকল্প ভারতীয় গণতন্ত্রে কোনও দিন প্রত্যাহৃত হওয়া কঠিন। এবং প্রকল্পটি যে ভবিষ্যতে কোর অব দ্য কোর হিসাবে চিহ্নিত হবে না, তা কি হলফ করে বলা যায়?
এনআরইজিএ প্রকল্পের সম্পর্কে একটি কথা বলা দরকার। এটা ঠিক যে, প্রকল্পটির কল্যাণে অনেক কৃষিশ্রমিকের উপকার হয়েছে, তাঁদের কাজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিছু জায়গায় জাতীয় সম্পদেরও সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু অনেক জায়গায় এটা কার্যত আয়-সাহায্য প্রকল্পের মতোই, অর্থাৎ সরকার কেবল টাকা দিয়েছে, সেই টাকার কোনও উৎপাদনশীল ব্যবহার হয়নি। কিন্তু এই প্রকল্পের ফলে কৃষিশ্রমিকের মজুরি বেড়েছে, ফলে কৃষিশ্রমিকের উপর নির্ভরশীল প্রান্তিক ও ছোট চাষির উৎপাদন খরচ বেড়েছে, তাঁরা আরও কোণঠাসা হয়েছেন। লক্ষণীয়, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষির ক্ষতি পোষাতেই আবার এখন আয়-সাহায্য প্রকল্প। এ দিকে খরা, বন্যা, কৃষি ঋণের অভাব, ফসল-বিমার অভাব, এগুলো অনেক দিনের সমস্যা। এ-সরকার ও-সরকার বলে নয়, কেউই এ-সব ব্যাপারে প্রয়োজনীয় মনোযোগ করেনি। আর, একটা সুস্থ বাজারধর্মী অর্থনীতিতে ফসলের ন্যূনতম দামের ব্যবস্থা করার কোনও প্রয়োজন হয় না। আসলে এ দেশে কৃষির বাজার ঠিক মতো কাজ করে না, শস্যের উৎপাদনশীলতা কম, কৃষিতে প্রয়োজনীয় সরকারি বিনিয়োগ হয় না, কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়াই চাষিরা যাতে ভাল ভাবে বাঁচতে পারেন তার ব্যবস্থা হয় না, শুধু ন্যূনতম সহায়ক দাম নিয়ে তর্জা।
আয়-সাহায্য নিয়ে একটা মৌলিক সমস্যার কথাও এড়ানো যায় না। গরিব মানুষ যদি কাজের বিনিময়ে একশো টাকা পান, তা হলে কাজটা করেন, কিন্তু কিছু না করে যদি সত্তর টাকা পান তা হলে কাজ করতে চাইবেন না। আর, রাজনীতিক এবং বিদগ্ধ পণ্ডিতরা যতই ভারতকে দরিদ্রে ভরপুর দেশ বলুন না কেন, দেশের অধিকাংশ জায়গাতেই দারিদ্রের সেই আগের চেহারা আর নেই। ১৩০ কোটির দেশে হতদরিদ্রের সংখ্যা হয়তো মেরেকেটে ২০ কোটি। সুতরাং কাজ করার ইচ্ছের উপরে আয়-সাহায্য প্রকল্পের কুফল পড়তেই পারে। কিন্তু এ সব কথা বলা রাজনৈতিক ভাবে একেবারে বেঠিক। আর রাজনীতির মানুষদেরই বা উপায় কী? অন্যরা কর দেবেন, তাঁরা খয়রাতি করবেন, এটাই তো গণতন্ত্র।
এ বার আর একটা সমস্যার কথা বলি। ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের বাজেট তৈরির সময় সরকার মোট আয় ধরেছিলেন ২৩,৯৯,১৪৭ কোটি টাকা। এখন, অর্থবর্ষের শেষে আয় দাঁড়াচ্ছে আনুমানিক ২৪,১৬,০৩৪ কোটি টাকা, অর্থাৎ ০.০০৭ শতাংশ বেশি। অন্য দিকে, সরকারি খরচ প্রাথমিক বরাদ্দের তুলনায় বাড়ছে ০.০৬ শতাংশ। এ বার, এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যদি ধরে নিই, সদ্য পেশ করা বাজেটের তুলনায় ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের শেষে সরকারের আয় ও ব্যয় যথাক্রমে ০.০০৭ এবং ০.০৬ শতাংশ বেশি হবে, তা হলে এখনকার প্রস্তাবের চেয়ে বাজেট ঘাটতি প্রায় ১,৮৫,০০০ কোটি টাকা বেশি হবে। এবং জিডিপির তুলনায় রাজকোষ ঘাটতির অনুপাতও তা হলে প্রস্তাবিত ৩.৪ শতাংশে আটকে থাকবে বলে মনে হয় না।
এখানে একটা কথা বলা দরকার। অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে মনে করি, জাতীয় আয়ের অনুপাতে রাজকোষ ঘাটতির মাত্রা একটু বাড়ল কী কমল, তাতে বিরাট কিছু যায় আসে না। অনেক সময় স্বল্পশিক্ষিত পুরোহিত যজমানকে খুশি করার জন্য বাড়তি মন্ত্র পড়েন, শেয়ার বাজার আর রাজকোষ ঘাটতির অনুপাত নিয়ে বাড়াবাড়ি অনেকটা সেই রকম ব্যাপার। অনেক ক্ষেত্রেই মন্দার সময় কষি আলগা করা অত্যন্ত সুবিবেচনার কাজ, যা করে মার্কিন দেশ সম্প্রতি সুফল পেয়েছে। কিন্তু মুশকিল হল, আমাদের দেশে সব দানছত্রের লক্ষ্য হল, করের টাকা কী করে ক্ষমতায় থাকার জন্য খরচ করা যায়। তাই ঘাটতি বৃদ্ধি নিয়ে চিন্তা থাকেই।
একটা খটকার কথা বলে লেখা শেষ করি। প্রচলিত নিয়মে প্রস্তাবিত বাজেট বরাদ্দ সরকারি ভাবে পাশ হয়ে যাওয়ার পরে তাকে পরিবর্তন করতে গেলে কতকগুলো বিশেষ পদক্ষেপের প্রয়োজন হয়। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে কৃষকদের আয়-সাহায্য বাবদ ৭৫,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। কিন্তু বাজেটের প্রস্তাবে চলতি বছরের অর্থাৎ ২০১৮-১৯ সালের সংশোধিত হিসাবে দেখা যাচ্ছে, কৃষি বিভাগের ব্যয়বরাদ্দের ৭ নম্বর খাতে ২০,০০০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে, এই টাকাটার কথা বাজেট বক্তৃতাতেও বলা হয়েছে। এটি নতুন প্রকল্প, ২০১৮-১৯-এর মূল বাজেট প্রস্তাবে ছিল না। অথচ ওই ২০,০০০ কোটি টাকা মার্চের মধ্যেই, অর্থাৎ নতুন বাজেট পাশ হওয়ার আগেই খরচ করা হবে। নতুন প্রকল্প পুরনো বাজেটের হিসেবে কী ভাবে ঢুকল। সেটা পরিষ্কার নয়। ব্যাপারটা বেশ দৃষ্টিকটু।
সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতির অধ্যাপক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy