Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

রস না গোল্লা

‘বাংলার রসগোল্লা’ বলিতে বাংলায় একটি নির্দিষ্ট উপাদানে প্রস্তুত, নির্দিষ্ট ওজনের এবং নির্দিষ্ট ঘনত্ব ও মিষ্টত্ববিশিষ্ট রসে নিমজ্জিত মিষ্টান্নকে চিহ্নিত করা হইয়াছে। ইহাকে প্রসেস পেটেন্টের সহিত তুলনা করা যাইতে পারে। অর্থাৎ, পণ্যটি প্রস্তুত করিবার একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতির উপর পশ্চিমবঙ্গের অধিকার, পণ্যটির উপর নহে।

শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

বিজয়গর্বে উল্লসিত বঙ্গবাসী সমীপে সবিনয় প্রশ্ন— রসগোল্লার, বস্তুত ‘বাংলার রসগোল্লা’-র, জিয়োগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশন ট্যাগ অর্জন করিয়া ঠিক কতখানি লাভ হইল? রসগোল্লার জন্ম ওডিশায় নহে, বাংলাতেই, এই ঘোষণাটি বর্তমানের, এবং ভবিষ্যতের, নিকট কতখানি তাৎপর্যপূর্ণ? প্রথম কথা, অন্য কোনও রাজ্যের মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীরা রসগোল্লা তৈরি করিতে বা বেচিতে পারিবেন না, এমন কোনও বাধানিষেধের সম্ভাবনা নাই। ‘বাংলার রসগোল্লা’ বলিতে বাংলায় একটি নির্দিষ্ট উপাদানে প্রস্তুত, নির্দিষ্ট ওজনের এবং নির্দিষ্ট ঘনত্ব ও মিষ্টত্ববিশিষ্ট রসে নিমজ্জিত মিষ্টান্নকে চিহ্নিত করা হইয়াছে। ইহাকে প্রসেস পেটেন্টের সহিত তুলনা করা যাইতে পারে। অর্থাৎ, পণ্যটি প্রস্তুত করিবার একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতির উপর পশ্চিমবঙ্গের অধিকার, পণ্যটির উপর নহে। ফলে, ভিনরাজ্যের ব্যবসায়ীরা নিজেদের মতো করিয়া রসগোল্লা বানাইয়া তাহা বেচিতেই পারেন। দ্বিতীয়ত, রাজ্যে যে লক্ষাধিক মিষ্টান্ন বিক্রেতা আছেন, তাঁহারাও চাহিলেই ‘বাংলার রসগোল্লা’ কথাটি ব্যবহার করিতে পারিবেন না। তাহার জন্য সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিটি মানিতে হইবে। কর্তারা কথা দিয়াছেন যে শিখাইয়া পড়াইয়া লইবেন। কিন্তু, তাহার পর কী?

রসগোল্লার জন্মদাতা হিসাবে স্বীকৃতি অর্জন করিবার অপেক্ষা অনেক বেশি জরুরি তাহার বাজারটিকে দখল করা। যে ভঙ্গিতে পশ্চিমবঙ্গের মিষ্টান্নশিল্প চলে, তাহাতে কাজটি বিলক্ষণ কঠিন। দোকানে গরম রসগোল্লা আসিলে গুটিকয়েক খরিদ্দার আসিয়া হাঁড়ি ভরিয়া বাড়িতে লইয়া যাইবেন, তাহা এই শিল্পের সাফল্যের মাপকাঠি হইতে পারে না। সফল হইতে চাহিলে দেশের, এবং বিশ্বের, বাজারে ছাপ ফেলিতে হইবে। উদাহরণ হাতের কাছেই আছে। একটি ছোট ব্যবসা কালক্রেমে কী ভাবে ভাজাভুজি হইতে চড়া দামের মিষ্টান্ন, সব কিছুর বাজারের দখল লইয়াছে, রাস্তাঘাটে, রেলওয়ে স্টেশনে এবং বিমানবন্দরে নজর ফিরাইলেই তাহা স্পষ্ট দেখা যায়। স্বাদের নিরিখে সেই মিষ্টান্নের কাছে হারিবার কোনও কারণ রসগোল্লার নাই। তবুও, দেশি ঘি-র লাড্ডু যাহা পারিয়াছে, রসগোল্লা তাহা পারে নাই, কারণ বাংলার ব্যবসায়ীরা সেই ব্যবসায়িক বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারেন নাই। ইতস্তত কয়েকটি সংস্থা বৃহত্তর বাজারে রসগোল্লার বিপণনের চেষ্টা করিয়াছে, কিন্তু একে তেমন সংস্থা মুষ্টিমেয়, তাহার উপর সেই চেষ্টাও খুব জোরদার নহে। অতএব, জিআই ট্যাগ লইয়া উচ্ছ্বাস খানিক কমিলে এই দিকে মন দেওয়া বিধেয়।

বিপণনের দুনিয়ায় সার কথা হইল ব্র্যান্ডিং। বিভিন্ন সংস্থা একই পণ্য নির্মাণ করিলেও নিছক ব্র্যান্ডিং-এর জোরে উপভোক্তার মনে কোনও একটি বিশেষ পণ্য ‘পরিবারের মহান পুষ্টিদাতা’ হিসাবে গাঁথিয়া যায়, আবার কোনওটি মনে থাকে ‘সুরভিত অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম’ হিসাবে। বিশ্বমঞ্চে বাংলার রসগোল্লারও এমনই একটি পরিচিতি চাই। পাশাপাশি চাই নির্দিষ্ট গুণমানের প্রতি আপসহীন দায়বদ্ধতা, পণ্য সরবরাহের মসৃণ নেটওয়ার্ক। ভারতের স্বাদ বলিতে দুনিয়ার মানুষ যেন রসগোল্লাকেই বুঝে, ব্র্যান্ডটিকে সেই জায়গায় লইয়া যাইতে হইবে। নচেৎ, হাতে থাকিবে ‘বাংলার রসগোল্লা’র জিআই ট্যাগ। ভিনরাজ্যের সংস্থাগুলি বাজার জিতিয়া লইবে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE