দারিদ্র মানে কিন্তু শুধু পেটের ভাতের সংস্থান নয়। দারিদ্রের অঙ্ক হয় আপেক্ষিক মানদণ্ডে।
ছোটবেলায় এটা খুব শুনতাম। ‘উটপাখির মতো বালিতে মুখ লুকিয়ে বসে থাকিস না’। কি না শীতকালে হওয়া বার্ষিক পরীক্ষায় (তখন নভেম্বরের শেষে বা ডিসেম্বরের প্রথমে বার্ষিক পরীক্ষা হত) অঙ্কে আত্মীয়দের কাছে, মায়ের মুখে কালি দিয়েও বেড়াতে যাওয়ার আবদার করেছি। বিন্দুমাত্র লজ্জা না পেয়েও।
উটপাখি দেখেছি চিড়িয়াখানায়। না দেখে উপায় ছিল না। কারণ, ওই অঙ্কের নম্বর টেনেই বলা হত যে উটপাখি বিপদ এলে বালিতে মাথা ঠেসে ধরে নাকি ভাবে, ‘যা দেখি না তা নেই’। বিপদও।দারিদ্র নিয়ে বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্টের পরেও যে আকচাআকচি দেখছি তাতে ওই অঙ্কের নম্বর আর চিড়িয়াখানা দেখার স্মৃতি আবার চাগিয়ে উঠল। না। ভারত যে অভ্যন্তরীন উৎপাদনের অঙ্কে বিশ্বের অনেক দেশকে টেক্কা দিয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু তাতে সাধারণ নাগরিকের কী লাভ হয়েছে? আরও সহজ করে বললে সাধারণ নাগরিক কি এই সমৃদ্ধির ভাগীদার হতে পেরেছে? সরকারি তথ্যই কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে ‘না’ বলেই। আর গোটা বিশ্বও ঠিক এটাই বলছে। বহু দিন আগেই কেন্দ্রীয় সরকার দারিদ্রের অঙ্ক কষা বন্ধ করে দিয়েছে। তার কারণ যা-ই হোক না কেন। কিন্তু সেই কেন্দ্রীয় সরকারেরই অন্যান্য পরিসংখ্যান সম্পদ বন্টনের অসাম্যকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।
মাথায় রাখতে হবে দারিদ্র মানে কিন্তু শুধু পেটের ভাতের সংস্থান নয়। দারিদ্রের অঙ্ক হয় আপেক্ষিক মানদণ্ডে। তাই দারিদ্রসীমার অঙ্কটাও কষা হয় দেশের আয়ের তুলনায়। যে দেশের আয় যত বেশি সে দেশের দারিদ্রসীমাও তত উপরে। কারণ ধনী দেশে টিকে থাকতে গেলেও যে আয়ের দরকার তা হয়তো মধ্য আয়ের দেশের মধ্যবিত্তের আয়ের সমতুল্য হতে পারে।
আর টিকে থাকার অঙ্ক শুধু আয়ের উপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো সামাজিক পরিষেবায় অধিকারের উপরও। শুধু তা-ই নয়, পরিস্থিতির উপর নিরন্তর নজরদারির জন্য প্রয়োজন পরিসংখ্যান, যাতে সঠিক চিত্রটা নীতিনির্ধারকদের চোখের সামনে থাকে। কিন্তু যে ভারতবর্ষ এক সময় পরিসংখ্যান সংগ্রহে পথিকৃৎ ছিল সেই দেশেই বিগত কয়েক বছর ধরে সেই পরিসংখ্যান সংগ্রহে সরকারের আগ্রহের অভাব বাড়ছে ঠিক যেন ওই উটপাখিকে অনুসরণ করেই।উদাহরণ হিসাবে নেওয়া যাক ২০১৫ সালের সিএজির মিড-ডে মিলের উপর রিপোর্টের বক্তব্যকেই। ২০১৫-কে নেওয়ার কারণ হল তার আগে-পরে এমন কোনও সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেনি যাতে বলা যায় তা ব্যতিক্রমী। ২০২১-২২ ধরলে তা সব সময়ই কোভিডের ঢালে আড়াল করার একটা প্রবণতা খুবই স্পষ্ট।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখা ভাল যে, আড়াল করার প্রবণতা যে শুধু কেন্দ্রের তা নয়। সরকারের সব স্তরেই নাগরিকের জীবনের মূল্যে এই প্রবণতা কিন্তু স্পষ্ট। ফেরা যাক সিএজির রিপোর্টে। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে যে কেন্দ্র এবং রাজ্যের মিড ডে মিলের সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি। যে খাবার যত জন ছাত্রকে দেওয়া হয়েছে বলে সরকারি স্তরে দাবি করা হয়েছে, নিরীক্ষকরা দেখেছেন তা ঠিক নয়। কোথাও যে খাবার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তা দেওয়া হয়নি, কোথাও বা যে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাওয়ার দেওয়ার কথা, পাতে দেওয়া খাবার তার ধারেকাছেও যায় না। কেন্দ্রের দিক থেকে যে নজরদারি করার কথা, তাতেও বিরাট খামতি থেকে গিয়েছে।
এর ফল? মিড-ডে মিল প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল দুটো। দরিদ্র ঘরের সন্তানদের মুখে অন্ন তুলে দেওয়া, এবং ‘দরিদ্র ভারতবাসীর’ সন্তানকে পুষ্টি জুগিয়ে শিক্ষার অধিকারকে বাস্তব করে তোলা। কিন্তু সিএজি-র রিপোর্ট বলছে, এ ব্যাপারে সব স্তরের সরকারই উটপাখি। এমনকি, পড়ুয়াদের স্বাস্থ্যের উন্নতি হচ্ছে কি না তা-ও দেখতে অনাগ্রহী সরকার। গত ছয় বছরে এ অবস্থার যে খুব একটা উন্নতি হয়নি, তা কর্নাটকে মিড- ডে মিল খেয়ে ছাত্রদের অসুস্থ হওয়া বা অন্য কোনও রাজ্যে এ জাতীয় ঘটনা ঘটার খবরেই প্রমাণ হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে পুষ্টির অভাবে বাচ্চাদের বৃদ্ধি ঠিক মতো হয় না। তার প্রথম শিকার উচ্চতা আর তার পরের শিকারই বুদ্ধির বিকাশ। প্রয়োজনীয় হারে লম্বা না হওয়াও কিন্তু পুষ্টির তথা দারিদ্রের নিদর্শন। আর জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষার পঞ্চম রাউন্ড বলছে, ভারতে ৩৩.৫ শতাংশ পাঁচ বছরের কম বাচ্চা প্রয়োজনীয় হারে লম্বা হয়নি। আগের সমীক্ষায় এই হার ছিল ৩৮.৪ শতাংশ। তাই শতাংশের হারে কিছুটা হ্রাস হলেও দেশের এক তৃতীয়াংশ বাচ্চা এখনও অপুষ্টির শিকার। বিশ্বের প্রথম সারির আর্থিক শক্তিধর রাষ্ট্রের সন্তানদের পুষ্টির যদি এই হাল হয় তাহলে তো বলতেই হয় যে, দেশ বড়লোক হলেও তাতে সাধারণের কোনও লাভ হয়নি! তার থেকেও ভয়ানক কথাটা হল, এই প্রজন্ম যখন বড় হবে তখন তো শৈশবে অপুষ্টির কারণে তাদের মেধার বিকাশেও খামতি থেকে যাবে! আমরা যখন বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর রাষ্ট্র হয়ে উঠতে চাইছি, তখন আগামী দিনে আমাদের এক তৃতীয়াংশ নাগরিকই কিন্তু মেধাশক্তিতে পিছিয়ে থাকবে!
যে কোনও সমস্যার সমাধানের রাস্তায় হাঁটতে গেলে খামতিটা স্বীকার করেই নিতে হয়। না হলে সে খামতি দুর করার রাস্তাও দুরপনেয় হয়েই থাকে। শুধু কেন্দ্রকে নয়, সরকারের সর্বস্তরেই উট পাখির মতো বেঁচে থেকে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার রাস্তায় হাঁটার প্রবণতা থেকে না সরে আসলে কিন্তু সব অর্থেই আগামী দিনে আমরা মেধা-পঙ্গুত্বে ভুগব। আর তা দেশের নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্যকে আরও বাড়াবে। আমরা কি তাই চাইছি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy