ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির ভবিষ্যৎ কেমন? গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার (আইএমএফ) বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতা সংক্রান্ত সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান তালিকা প্রকাশ করেছে। সেই তালিকা ১৯৮০ সালের ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক রিপোর্ট’-এ প্রকাশিত দেশভিত্তিক পরিসংখ্যানের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। প্রসঙ্গত, ১৯৮০ সালেই আইএমএফ তার এ সংক্রান্ত প্রথম তালিকাটি প্রকাশ করেছিল। কেউ যদি অর্থনীতির বৃদ্ধির তুলনামূলক খতিয়ানের দিকে নজর করেন, তা হলে দেখতে পাবেনআমেরিকান ডলারের সাম্প্রতিক বিনিময় মূল্যের নিরিখে চারটি দেশ ২০১১-২০২১— এই দশকটিতে সব থেকে ভাল ফল করেছে। দেশগুলি যথাক্রমে বাংলাদেশ, চিন, ভিয়েতনাম এবং ভারত (ভারতের ক্ষেত্রে ২০২১ মানে ২০২১-২০২২’এর সাম্প্রতিক অর্থবর্ষ)।
চারটি দেশের মধ্যে মাত্র দু’টি বিগত দশকের তালিকায় গোড়ার দিকে ছিল। তালিকার প্রথমেই ছিল চিন এবং ভিয়েতনাম ছিল পঞ্চম স্থানে (তুরস্কের সঙ্গে যুগ্ম ভাবে)। মনে রাখতে হবে, সেই সময়কালে (২০০১-২০১১) ভারতীয় অর্থনীতির দশকওয়াড়ি কর্মক্ষমতা ছিল অভূতপূর্ব। কিন্তু এ কথাও সত্য যে, ওই কালপর্বে বিশ্বের নতুন ভাবে মাথাতোলা যাবতীয় বাজার এবং উন্নয়নশীল দেশগুলির (৪০টি ‘উন্নত’ অর্থনীতির দেশের সঙ্গে এদের ধরা হয়) তুলনায় ভারতের গড় আর্থিক বৃদ্ধির গতি সামান্য শ্লথ ছিল। যে সময় ভারত উন্নয়নের ক্ষেত্রে আসাধারণত্বের দৃষ্টান্ত রাখছিল, বিশ্বের অন্যান্য দেশও সেই সময় একই রকম ‘অসাধারণত্ব’-এর নজির প্রকাশ্যে এনেছিল। এর পূর্ববর্তী দুই দশকে১৯৯১-২০০১ এবং ১৯৮১-১৯৯১ পর্বে ভারত নতুন মাথাতোলা বাজারগুলির গড়ের নিরিখে হয় সার্বিক ভাবে খানিক এগিয়ে ছিল, নয়তো সার্বিক ভাবে খানিক পিছিয়েছিল।
এই পরিসংখ্যান ও তার তালিকায় স্থানাধিকারের বিষয়টি অবশ্যই আপেক্ষিক। একে বৃদ্ধির চূড়ান্ত প্রমাণ বলে ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। সুতরাং, ২০১১-২০২১ নাগাদ সদ্যজাগরিত বাজারগুলির তুলনায় ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধির চেহারা ভাল ছিল— এই তথ্যের সঙ্গে ওই দশকে ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধির শ্লথতার তথ্য সামঞ্জস্যহীন কোনও বিষয় নয়। ডলারের সাম্প্রতিক মূল্যের নিরিখে ভারতীয় অর্থনীতি ২০০১-২০১১ পর্বে আকারগত ভাবে ৩.৭ গুণ বেড়েছে। কিন্তু বিগত দশকে তার বৃদ্ধি মাত্র ১.৭ গুণ।
এই তুলনামূলক হিসাব থেকে যা উঠে আসে, তা এই রকম— ২০২২ (ভারতের ক্ষেত্রে ২০২২-২০২৩) সালে আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল ৬.৮ শতাংশ।যেখানে যাবতীয় নতুন গজিয়ে-ওঠা বাজারের ক্ষেত্রে বড়জোর ৩.৭ শতাংশ বৃদ্ধি অনুমান করা গিয়েছিল। কমবেশি ৩ শতাংশের ফারাক এমন ক্ষেত্রে সচরাচর লক্ষ করা যায় না। ২০২৩-এ এই ফারাক যথেষ্ট মাত্রাতেই ছিল (২.৪ শতাংশ)। এর পিছনে নিশ্চিত ভাবে চিনের আর্থিক বৃদ্ধির অধোগতি কাজ করছিল। যা যাবতীয় জায়মান বাজারের গড় পরিসংখ্যানকে পিছন দিকে টেনে ধরছিল। ইতিমধ্যে অগ্রবর্তী অর্থনীতির দেশগুলিতে বৃদ্ধির গতি চলতি বছরে ২.৪ শতাংশ থেকে আগামী বছর ১.১ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ কথা না বলে আইএমএফ অবশ্য এক ‘বিভাজন’-এর সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করছে। এমন বিভাজন যদি আংশিক বলেও প্রমাণিত হয়, তা হলে ভারতের বৃদ্ধির সূচকসংখ্যা ২০২২ এবং ২০২৩-এ এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকবে, যা পূর্ববর্তী পরিংখ্যানের সামান্য হেরফেরের থেকে বেশি কিছু হবে বলে মনে হয় না। এক ‘অন্ধকার দিগন্তে’ (আইএমএফ এমন নামেই চিহ্নিত করছে) ভারতীয় অর্থনীতির সাম্প্রতিক অবস্থান তাই এক উজ্জ্বল বিন্দু। যা একটু বেশি স্থায়ী হবে বলেই আশা করা যায়।
যে হেতু ভারত ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছে (তেলসমৃদ্ধ সৌদি আরবকে বিচ্ছিন্ন বলে ধরতে চাইছি না), সে হেতু আর্থিক বৃদ্ধির দৌড়ে পরে আগত দেশগুলি ঠিক সেই কাজগুলিই করছে, যা পূর্ববর্তী দশকগুলিতে তাদের পূর্ব এশীয় পূর্বসূরিরা করে দেখিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইওয়ানের মতো দেশগুলি ১৯৮১-র আগে যে এই কাজ শুরু করেছে, সে কথা মনে রাখতে হবে। ভিয়েতনামে মাথাপিছু আয় ভারতের তুলনায় ৬০ শতাংশ বেশি বা ফিলিপিন্সের (‘আসিয়ান-৫’দেশগুলির মধ্যে দরিদ্রতম বলে ধরা হয়) তুলনায় বেশি হলেও এই উদাহরণ যে সত্য, তা অস্বীকার করা যায় না। এমন ঘটে থাকলে ফিলিপিন্স ২০২২-এর তালিকায় উল্লিখিত প্রথম তিনটি দেশের পরেই স্থান পাবে। এই চারটি দেশই ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ কৌশল অনুসারে তাদের উৎপাদন কেন্দ্রগুলিকে চিন থেকে দূরে রাখতে তৎপর হয়েছে।
১০৮১ থেকে ২০২১— আইএমএফের দেওয়া চার দশকের হিসাব নিয়ে বসলে দেখা যায় কেবল তিনটি দেশ লক্ষ্যণীয় ভাবে ভারতের থেকে এগিয়ে রয়েছে। চিন এ ক্ষেত্রে নিজেই একটি দৃষ্টান্ত, যে তার অর্থনীতির ৬২ গুণ বৃদ্ধি ঘটিয়েছে (ডলারের সাম্প্রতিক নিরিখে), দক্ষিণ কোরিয়ার স্থান ঠিক তার পরেই (২৫ গুণ) আর এর পরেই রয়েছে ভিয়েতনাম। ভারত এবং আরও চারটি দেশ(মিশর, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ এবং তাইওয়ান) এর পরেই অবস্থান করছে। এই দেশগুলিতে আর্থিক বৃদ্ধি ঘটেছে ১৬ গুণ। তাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়া কিন্তু খুব পিছনে পড়ে নেই। এই ভাবে বিচার করলে ভারতের বৃদ্ধির চেহারা লক্ষ্যণীয় হলেও চমকপ্রদ নয়। পাশাপাশি, এ কথাও মানতে হবে যে, বিশ্বের মোট গৃহজ উৎপাদনে (জিডিপি) ভারতের অংশ ১০৮১-১৯৯১ পর্বে ১.৭ শতাংশ থেকে ১.১ শতাংশে নেমে গেলেও ২০১১ নাগাদ ২.৫ শতাংশে উঠে এসেছে এবং ২০২১-এ তা বেড়েছে ৩.৩ শতাংশ। আশা করা যায়, আগামী বছরগুলিতে এই পরিসংখ্যান আরও খানিকটা বাড়বে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy