কুম্ভমেলার ‘আইআইটি বাবা’ অভয় সিংহ (ছবি) এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ডিং। ভাল ছাত্র, ভাল চাকরি করেছেন, তার পর সব ছেড়ে বেছে নিয়েছিলেন আখড়ার জীবন। অতি সম্প্রতি বিতাড়িত হয়েছেন সেই আখড়া থেকে। কুম্ভমেলায় এত সাধুসন্ন্যাসীর ভিড়েও অভয় সিংহ কেন মিডিয়ার নজরে পড়লেন, এবং দেশব্যাপী খ্যাতি অর্জন করলেন রাতারাতি, তার কারণটি স্পষ্ট— সব সুখ হাতের নাগালে পাওয়ার পরও যিনি তা হেলায় ত্যাগ করতে পারেন, গুরুবাদী ভারতীয় সমাজে তাঁর ত্যাগ ও কৃচ্ছ্রসাধন একেবারে আগমার্কা খাঁটি বলে স্বীকৃতি পাবেই। ফেরারি বিক্রি করে সন্ন্যাসী হলে মিডিয়াতেও তাঁদের কদর আলাদা।
কিন্তু, শুধু কি তা-ই? আসলে কি ‘আইআইটি বাবা’ অভয় সিংহকে একটা প্রতীক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার সুচতুর প্রয়াস চলছে না সোশ্যাল মিডিয়ার দক্ষিণপন্থী বাস্তুতন্ত্রে? সেই প্রতীক, যা বলছে যে, বিজ্ঞান মানুষকে জীবনের যে অর্থের সন্ধান দিতে পারে না, অধ্যাত্মবাদ সেটা পারে। অভয় সিংহ এমন এক জন মানুষ, যিনি বিজ্ঞান না হোক, প্রযুক্তির উচ্চ স্তরে শিক্ষা অর্জন করেছেন, সেই শিক্ষাকে পুঁজি করেছেন পেশাদারি জীবনে। তার পরও তিনি আধ্যাত্মিকতার কাছে আশ্রয় খুঁজলে তা কি বিজ্ঞানের সমূহ পরাভব নয়? কুম্ভমেলার পরিসরটিও তাৎপর্যপূর্ণ। সেখানে মুখ দিয়ে আগুন ছুড়ে, গায়ে ছাই মেখে, গলায় মড়ার খুলি দুলিয়ে, সস্তার বিভূতি দেখিয়ে তথাকথিত সন্ন্যাসীর দল খ্যাতি অর্জন করার চেষ্টা করে থাকেন। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে, ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পুণ্যার্থীদের সামনে, বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের উপরে আধ্যাত্মিক ভাববাদের ধ্বজা ওড়াতে পারলে, হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রবল সুবিধা হয় রাজনৈতিক সমরাঙ্গনে।
তবে, রাষ্ট্রের এই সূক্ষ্ম দ্যূতক্রীড়ায় অভয় বেচারা সম্ভবত বোড়েমাত্র। তাঁর নিজের মতো করে আত্মসমীক্ষার প্রক্রিয়াটিকে হাইজ্যাক করে, চতুর রাষ্ট্র রৌদ্র থাকতে থাকতে খড় শুকিয়ে তুলতে চায় পরবর্তী নির্বাচনের আগে। ফলস্বরূপ অভয়ের ভাইরাল হওয়া— আসলে তাঁকে ভাইরাল করা। এই ভাইরাল হওয়ার চাপ তাঁর উপরে স্পষ্ট— বিভিন্ন সংঘাত তৈরি হয়েছে আখড়ার সঙ্গে তাঁর। উঠে এসেছে তাঁর পারিবারিক অশান্তিতে বিক্ষত শৈশবের কথাও। তাঁর বর্তমান অস্থিরতা সোশ্যাল মিডিয়ার দক্ষিণপন্থী বাস্তুতন্ত্রকে আরও অস্ত্র জোগাচ্ছে— টিআরপি বাড়ছে অভয় সিংহের; সে তাঁর মানসিক স্থিতির মূল্যে হলেও। অভয় ধর্মব্যবসায়ী নন, বরং ধর্মব্যবসায়ীদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছেন বেচারা।
কেউ অতি সচ্ছল মোহময় পেশাজীবনের হাতছানি ছেড়ে এসেছেন মানেই তিনি সন্ন্যাসমনস্ক, এই ধারণাটি নিতান্তই অতিসরলীকরণ। বহু মানুষ স্বেচ্ছায় অতি আকর্ষণীয় চাকরি ছেড়ে এসে মানব এবং সমাজকল্যাণে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের জীবন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই অধ্যাত্মবাদের ধারেকাছে যাননি, বরং সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন ভাববাদী দর্শনের বিপরীতে বস্তুবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে— প্রয়োজনে নিজের জীবন দিয়েই। চিকিৎসক শঙ্কর গুহনিয়োগীর জীবন ও কর্ম এ প্রসঙ্গে মনে রাখা জরুরি। আর এক উদাহরণ অধ্যাপক অলক সাগর। আইআইটি দিল্লির খ্যাতনামা অধ্যাপক, আমেরিকার হিউস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট করা মানুষ, রঘুরাম রাজনের মতো ব্যক্তিত্বের শিক্ষক— চাকরি থেকে পদত্যাগ করে মধ্যপ্রদেশের আদিবাসীদের উন্নতিকল্পে কাটিয়ে দিলেন সারাটা জীবন। খালি গায়ে হেটে ধুতি পরে বেতুল জেলার কোচামুতে রোজ ষাট কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে দূরদূরান্তের গ্রামের গরিব আদিবাসীদের বীজশস্য সরবরাহ করে বেড়ান চাষের জন্য। অথবা ভাবা যেতে পারে আনন্দ তেলতুম্বডের কথা— ভারতের সেরা ম্যানেজমেন্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আমদাবাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট থেকে এমবিএ করে ভারত পেট্রলিয়ামের এগজ়িকিউটিভ ডিরেক্টর এবং আইআইটি খড়্গপুরের খ্যাতনামা অধ্যাপক হয়েও সুখী নিশ্চিন্ত জীবনের মোহ ছেড়ে দক্ষিণপন্থা-বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জীবন কাটাচ্ছেন।অধ্যাপক সাগর বা অধ্যাপক তেলতুম্বডের, বৈভব ছেড়ে এসে জীবনের মানে খোঁজার জন্য আধ্যাত্মিকতার প্রয়োজন পড়েনি। স্বাভাবিক ভাবেই এঁরা কেউই ভাইরাল হননি— ভারতীয় গুরুবাদী সমাজে আইকন হিসাবে কল্কে পাওয়ারও কোনও সম্ভাবনা নেই এঁদের।
আধ্যাত্মিকতা ভারতীয় ভাববাদী দর্শনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ আবহমান কাল ধরে। ভারতীয়দের রক্তে মিশে আছে অধ্যাত্মবাদের প্রতি অমোঘ আকর্ষণ। দক্ষিণপন্থী রাজনীতি সেই আকর্ষণকে পুঁজি করে হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদী রাজনীতিতে নেমেছে। তাদের পরিকল্পিত ভবিষ্যৎ ভারত গড়ে উঠবে জাতের বিভেদ, ব্রাহ্মণ্যবাদ, কুসংস্কার এবং শ্রেণিশোষণের উপরে ভিত্তি করে। ধর্মীয় মৌলবাদের দ্বারা চালিত দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির প্রক্ষিপ্ত ভারতবর্ষের ধারণায় বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ, বিজ্ঞানমনস্কতা, এবং যুক্তিবাদের কোনও স্থান নেই, তাই আজ তাদের বিজ্ঞানের উপর অধ্যাত্মবাদের জয় প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে ছলে বলে কৌশলে। অভয় সিংহের ‘আইআইটি বাবা’ হয়ে ওঠার গল্প সেই ধর্মীয় মৌলবাদভিত্তিক বিভেদমূলক রাজনীতির প্রসারেরই এক কৌশলমাত্র। এক ঝকঝকে মেধাবী আইআইটিয়ান যুবকের শেষ অবধি কুম্ভমেলায় গেরুয়া ও গঞ্জিকা সহযোগে আত্মানুসন্ধানের প্রক্রিয়ার প্রতি তাই কৌতূহলী হওয়া যেতেই পারে, কিন্তু এই ঘটনাকে মহিমান্বিত করার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ নেই, এই কথাটাও ভুললে চলবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy