ছাত্রীর রেজ়াল্ট খারাপ হয়েছে। কারণ তাকে রান্না করতে, কাপড় কাচতে হয়। বাবা জানালেন, তিনি ও স্ত্রী কাজে যান। মেয়েকে এগুলো করতে হয়। বড়দির প্রশ্ন, “আপনার যুবক পুত্র তো ব্যস্ত নন। তিনি কেন করেন না?” বাবা বিরক্ত। বললেন, “মেয়ে থাকতে ছেলে রান্না করবে? কাপড় কাচবে?” বাড়ির পুরুষ রান্নাবান্না করেন না, তা নয়। আবার এখনও বহু পরিবারে বোন থাকতে দাদাকে রান্না, কাপড় কাচানোর প্রস্তাব মানুষকে হতচকিত করে! ভারত মিশ্র ভূপ্রকৃতি, ভাষা, সংস্কৃতির দেশ। এখানে মানুষের জীবনদর্শনের বৈচিত্রও কম নয়। আর এই ভারতেই প্রত্যেক জানুয়ারির ২৪ তারিখে ‘জাতীয় কন্যাশিশু দিবস’ পালিত হয় ঘটা করে।
নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রক ২০০৮-এ দিনটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। উদ্দেশ্য, কন্যাশিশুর স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নিরাপত্তার অধিকার সম্পর্কে গণসচেতনতা বৃদ্ধি, লিঙ্গসাম্য স্থাপন, নারী-পুরুষের আনুপাতিক হার ঠিক ভাবে বজায় রাখা ইত্যাদিতে জোর দেওয়া। ২০২৫-এ দিনটিকে কেন্দ্র করে সরকারের আহ্বান, কন্যাশিশুকে পড়াও, দেশ গঠন করো। এ হল তথ্যপ্রযুক্তির প্রজন্ম। উন্নত সমাজ গড়ে দেখাও। বিদ্যাসাগর, সাবিত্রীবাই-এর দেশে মেয়েরা সাম্য ও সম্মানের সঙ্গে বাঁচবে। সুস্বাস্থ্য ও শিক্ষা পেয়ে নিরাপদে জীবনযাপন করবে, এটাই তো কাম্য? তাই ‘জাতীয় কন্যাশিশু দিবস’-এর স্লোগান, ‘স্বপ্ন হোক আকাশের মতো সীমাহীন’।
২০২১-এ ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিস জানায়, দেশে যেখানে পুরুষের সাক্ষরতা ৮৪.৭০%, নারীর ক্ষেত্রে তা ৭০.৩০%। কিন্তু সরকারের বহু প্রকল্প রয়েছে ‘বেটি’কে পড়ানোর জন্য। রাজ্য, কেন্দ্র নানা তরফের উপহার হাতে বাড়ি গিয়েও বহু বালিকা আর স্কুলে আসে না। হারিয়ে যায় (ইচ্ছা বা অনিচ্ছায়) বা বিয়ে হয়। ২০২২-এ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রতি মিনিটে ৩ জন নাবালিকার বিয়ে হয়। ২০১১-র শেষ জনগণনা দেখিয়েছে, এই পোড়া দেশে প্রতি দিন প্রায় ৪৪০০ নাবালিকার বিয়ে হয় (তাও যেটুকু জানা যায়)। সোসাইটি ফর এনলাইটনমেন্ট অ্যান্ড ভলান্টারি অ্যাকশন বলছে, দেশের ২০-২৪ বছরের বিবাহিতাদের অন্তত ২৩.৩% বাল্যবিবাহের শিকার। আশ্চর্য বিষয়, মেয়েদের এই ভয়াবহ দুর্ভাগ্যের বৃত্তান্ত শুনে ভারতের এক বিরাট অংশ শিহরিত হয় না। যে মেয়েদের ভবিষ্যৎ হেঁশেলেই আবদ্ধ এবং যার জন্য পণ দিতে দরিদ্র পিতার সর্বস্ব চলে যায়, তাকে যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে দিয়ে ‘কন্যাদায়’ ঘাড় থেকে নামানোই তো দস্তুর? এই দর্শন এবং ব্যবস্থা থেকে না বেরিয়ে কন্যাশিশু দিবসের সাফল্য কামনা কি দিবাস্বপ্ন নয়?
এমন দেশ যে ‘বেটি’কে প্রাণে বাঁচাও বলেও স্লোগান দিতে হয়! কারণ কন্যাভ্রূণ হত্যায় দেশ বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। এ বিষয়ে ‘ভিকট্রি স্ট্যান্ড’-এ পর পর দাঁড়াবে গুজরাত, মহারাষ্ট্র, ছত্তীসগঢ়, হরিয়ানা, পঞ্জাব, রাজস্থান। উত্তরাখণ্ড কম যায় না। ২০১৯-এ সেখানে ১৩২টা গ্রামে তিন মাসে নাকি একটিও শিশুকন্যা জন্মায়নি! বিপক্ষের খেলোয়াড়দের কাটিয়ে শিশুকন্যা জন্মের গোলপোস্টে পৌঁছে গেলেও, জীবন তার জন্য প্রায়ই সাজিয়ে রাখে অপমান, নির্যাতন, অবহেলা এবং অবশ্যই যৌন হেনস্থা। এর সঙ্গে কিন্তু বয়স বা পোশাকের তেমন যোগ নেই (‘সুকুমার’ ধর্ষক নাকি স্বল্প পোশাক দেখলে সংযম হারায়)। ২০২৪-এ উত্তরাখণ্ডে ধর্ষণের ঘটনায় ৬-৭ বছরের তিন বালক-সহ গ্রেফতার আট। নির্যাতিতার বয়স মাত্র তিন। যে তিন বালক দুধের শিশুটিকে ‘ধর্ষণ’ করতে গিয়েছিল, তারা কি এর অর্থ বুঝেছে? হয়তো তারাও জানে, ধর্ষণ আসলে নারীকে পুরুষশক্তি প্রদর্শনের হাতিয়ার! সম্প্রতি এক অবিশ্বাস্য ঘটনা আলোচিত হচ্ছে। কেরলের দলিত ক্রীড়াবিদ কন্যার অভিযোগ, মাত্র ১৩ বছর থেকে সহপাঠী, ট্রেনার, প্রতিবেশী-সহ তাকে ধর্ষণ করেছে মোট ৬২ জন। বাবার মোবাইলে সে ধর্ষকদের নাম লিখেছিল। এখন মেয়েটির বয়স আঠারো। তার বাল্য, কৈশোর সবটা কেটেছে হায়নার থাবায় রক্তাক্ত হতে হতে। অথচ দেশে নাবালিকার জন্য পকসো আছে; শিক্ষা, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, সাম্যের অধিকার এবং নির্যাতিত না হওয়ার অধিকার আছে!
সাংবাদিক অমিতাভ পরাশর ১৯৯৬-এ গিয়েছিলেন বিহারের কাটিহারের গ্রামে। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন সিরো দেবী, হাকিয়া দেবী, ধর্মী দেবী প্রমুখ ধাইদের। তাঁরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশুর জন্মে সাহায্য করেন। তাঁরা জানান, পুত্র জন্মালে আনন্দ বাঁধ মানে না। কন্যা জন্মালে ঘরের দরজা বন্ধ করে, লাঠি হাতে বাড়ির পুরুষরা ঘিরে দাঁড়ায়। প্রাণভয়ে সদ্যোজাতকে গলা টিপে হত্যায় বাধ্য হন তাঁরা। বদলে মেলে একটা শাড়ি বা এক থলি শস্য। হাকিয়া দেবী জানান, তত দিনে মেরেছেন অন্তত ১৩টি শিশুকন্যাকে। ধর্মী দেবী হত্যা করেন ২০-র বেশি সদ্যোজাতকে। অনিলা কুমারী নাম্নী সমাজসেবী কাটিহারে যান স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নিয়ে। মেয়ে জন্মালে ধাইরা তুলে দিতে থাকেন তাঁর হাতে। পালিত পিতামাতার স্নেহে বড় হওয়ার সুযোগ পায় তারা। এ ভাবেই জন্মের কুড়ি বছর পর মনিকা থাট্টের দেখা সিরো দেবীর সঙ্গে। প্রাণে না মেরে মনিকাকে অনিলা দেবীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন তিনি।
জাতীয় কন্যাশিশু দিবস অনিলা দেবী, সিরো দেবী আর মনিকা থাট্টেরই দিন। বৈষম্যের বস্তাপচা ধারণার অবলুপ্তির দিন। অসম যুদ্ধ লড়ে যাওয়া অসংখ্য বালিকার দিন, যারা এক দিন দেশ বদলাবে। আমরা পাশে থাকলে তাদের শুধু স্বপ্ন নয়, সাফল্যও আকাশের মতো সীমাহীন হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy