সাম্রাজ্যসূর্য: সিপাহি বিদ্রোহের পর বিজয়গর্বিত ‘নেটিভ’-পরিবৃত ব্রিটিশ সেনাপতি মিকাম ও অ্যান্ডারসন (বসে, ডান দিকে), ১৮৫৭। গেটি ইমেজেস।
রাজার বাড়ি বাকিংহাম প্যালেসের ব্যাপারই আলাদা। সুবিপুল ধরাধামে সে একটা আলাদা দ্বীপ। বাইরে তার টহলদার লাল কোট উঁচু কালো টুপি পরিহিত রাজপেয়াদা, ভিতরে সোনারুপোর ঝনঝনানি, হিরেমোতির চকমকানি। দুনিয়া যে নিয়মে চলে, সে ঠিক সে নিয়মে চলে না— এক সযত্নপোষিত ঐতিহ্যবুদ্বুদের সঙ্গোপন আচ্ছাদনে কেটে যায় তার দিনরাত্রি।
আপাতত সেই প্যালেসে থরোথরো উত্তেজনা। আগামী বছরের ৬ মে এসে গেল বলে, সাজো সাজো সকলে, কে কী পরবে ঠিক করো, ভাবোনি এখনও? সময় কই? ১৯৫৩ থেকে ২০২৩— ৭০ বছর পর করোনেশন অনুষ্ঠান, প্রস্তুতি মাত্র ৭ মাস!
সবচেয়ে বেশি হইচই ফেলেছেন রাজা তৃতীয় চার্লস, বায়না জুড়েছেন (রানি? রাজপত্নী?) ক্যামিলা যেন দ্বিতীয় এলিজ়াবেথের সেই চোখধাঁধানো রাজমুকুটটি (ছবি নীচে) পরেন এই অনুষ্ঠানে, যাতে আছে ২৮০০টা জ্বলজ্বলে হিরে। রাজার এ-হেন প্রেমাকুল অভীপ্সায় চমকিত ফিসফিসানি শুভানুধ্যায়ীদের— বলেন কী চার্লস? আবার ওই মুকুট? মা এলিজ়াবেথ পরতেন সে ঠিক আছে, আবার নতুন করে তাকে নিয়ে ঝামেলা বাড়ানো? ২৮০০ হিরের মধ্যে একদম সামনেই যে শোভা পাচ্ছে বিশালাকার কোহ-ই-নূর, যার একারই ১০৫ ক্যারাট পুরো পৃথিবীর মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো, ওই হিরে আবার নতুন করে জনসমক্ষে আনা? ভারত সাম্রাজ্য থেকে সে কালের ‘লুণ্ঠিত’, মতান্তরে ‘সংগৃহীত’, কোহিনুর নিয়ে আজকাল ঝামেলার শেষ নেই, উইলিয়াম ডালরিম্পল একটা গোটা বই লিখে ফেলেছেন, সেই বই নিয়ে টেলিভিশন চ্যানেলে রাগারাগি কাটাকাটি হয়েছে। আগের বারের অভিষেকের পর সাত দশক অতিক্রান্ত, দুনিয়াদারির হালচাল ঘুরেছে বোঁবোঁ, আধুনিক যুগ হয়েছে উত্তর-আধুনিক, সাম্রাজ্যের গ্ল্যামারকে এখন চাপাচুপি দিয়ে চলতে হয়। ওই সময়ের ‘চোরাই’ মাল দেখলে লোকে খামোকা উত্তেজিত হয়ে যেতে পারে— ভারতে আফ্রিকায় তো বটেই, এমনকি বিলেতে খেয়েপরে সুখেথাকা ইন্ডিয়ান আর ‘পাকি’গুলোও কেমন যেন করে। ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, আফগানিস্তান— নিজেদের মধ্যে শত্রুতার শেষ নেই, কিন্তু কোহিনুর শোনামাত্র তিন দেশই একসুরে গলা মেলায়: “ফেরত চাই। চাই-ই চাই।”
এ সব কি নতুন রাজা জানেন না? খুব জানেন। জানা সত্ত্বেও যে তাঁর এ অভিলাষ, সেটা ছেলেমানুষি ভাবা হবে বিলক্ষণ বোকামি। এত দিন পথ চেয়ে আর কাল গুনে বসে থাকার পর সিংহাসনাসীন রাজার কোহিনুর-বায়নার পিছনে নিশ্চয় আছে তাঁর নিজের দেশের সমস্ত জনসাধারণের মনভোলানো প্রাণজোড়ানোর ‘শিয়োর-শট’। ‘বাইরের’ লোকের কথা ভেবে কী হবে? ‘ভিতরের’ লোকেরা কতই না খুশি হবে পুরানো সেই দিনের কথা সামনে এলে! মনে পড়বে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য দুই শতাব্দী জুড়ে সত্যি অস্ত যেত না, এমন ছিল তার ব্যাপ্তি— এই দিক দিয়ে দিনমণি ডুবতেন তো ওই দিক দিয়ে আবার টুক করে উঠে পড়তেন! আজকের এই ব্রেক্সিট-লাঞ্ছিত, মূল্যবৃদ্ধি-জর্জরিত, অশ্বেতকায়-লাঞ্ছিত বিরক্ত হতাশ খিটখিটে ইংল্যান্ড-সমাজকে মনে করানো যাবে— নতুন সুখবর না-ই থাকুক, কোহিনুরের উজ্জ্বল দ্যুতি কিন্তু আজও তাদের দেশকে ভরিয়ে রেখেছে, ভাসিয়ে চলেছে। কত ভাল একটা ‘ভাইব’ তৈরি হবে, তাই না?
আসলে, ভারত পাকিস্তানে যতই স্বাধীনতার পঁচাত্তর ইত্যাদি হইচই হোক, ইংল্যান্ড দেশটায় সাম্রাজ্য-নস্টালজিয়া পুরনো চালের মতো প্রতি সন্ধেয় ভাতে বাড়ছে। ২০১৬ সালে এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, সাম্রাজ্য যতই কোথায় বা কী ভূতের ফাঁকি হয়ে গিয়ে থাকুক ইতিমধ্যে, অন্তত ৪৪ শতাংশ ‘ব্রিটন’ আজও তার গরবে একান্ত গরবি। তাঁরা বিশ্বাস করেন, ব্রিটিশরা অশেষ কষ্ট স্বীকার করে দূরদূরান্তে সভ্যতা না ছড়ালে এই গ্রহ এত দিনে রসাতলে গিয়েছিল আর কী। বিশ্বাস করেন, ‘ইফ ইউ ডোন্ট সেলিব্রেট দি এম্পায়ার ইউ আর অ্যান্টি-ব্রিটিশ’। অতিশয়োক্তি নয়— সত্যিই এ কথাটা মুখে মুখে ঘুরেছে কিছু কাল আগে। ২০২০ সালে লেবার এমপি লিসা ন্যান্ডি (অবশ্যই বাংলা এবং কলকাতা সূত্রে ‘নন্দী’) দাবি তুলেছিলেন ‘ওবিই’ অর্থাৎ ‘অফিসার অব দ্য মোস্ট এক্সেলেন্ট অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’ পদের নামটি থেকে ‘এম্পায়ার’ শব্দটা সরানো হোক। শোনামাত্র তাঁর বিরুদ্ধে বিরোধীদের তীব্র গর্জন, আর তার সঙ্গে জনরোষ: ‘শি ইজ় বিইং অ্যান্টি-ব্রিটিশ’!
হাবভাব দেখে মনে হয়, জর্জ বার্নার্ড শ’র বক্রোক্তি আজও প্রাসঙ্গিক যে ‘দি অর্ডিনারি ব্রিটিশার ইম্যাজিনস দ্যাট গড ইজ় অ্যান ইংলিশম্যান’।
ব্রিটিশ সমাজ অবশ্য চিরকালই স্ববিরোধিতায় ভরপুর। এও একশো ভাগ ঠিক যে, সেখানকার লিবারালরা গোটা বিশ্বেরই লিবারালতম মানুষ, সবাইকে তাঁরা সে কালেও উদারতায় টেক্কা দিতেন, এ কালেও দেন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বাদই দিলাম, আর কোন দেশ পারবে লন্ডনে পার্লামেন্ট স্কোয়্যারে চার্চিল মশায়ের পাশেই বসিয়ে দিতে মহাত্মা গান্ধীকে? কিংবা ব্রিস্টল শহরের প্রাণকেন্দ্রে রেখে দেবে রাজা রামমোহন রায়ের মর্মর-অবয়ব? মুশকিল হল, পপুলার সেন্টিমেন্ট বা পপুলার কালচারটা ঠিক এই সব লিবারাল রাজনীতি বা পণ্ডিতমহল দিয়ে বিচার করা যায় না। বৃহত্তর রাজনীতিতে ও জনসমাজে যখন সাম্রাজ্যের স্মৃতি উস্কে মানুষের আবেগ জাগানোর ও ভোট বাগানোর একের পর এক উদাহরণ চোখে পড়ে— বোঝা যায়, জনমানসের অভিমুখটা কোন দিকে।
তা ছাড়া জনমানস বুঝতে টেলিভিশন জিনিসটা খুব কাজের। ইন্ডিয়ান সামার্স নামে টেলিভিশন সিরিজ় সাম্প্রতিক কালের বিগ হিট-গুলির অন্যতম, মানুষ, যাকে বলে, মাতোয়ারা। ডাউনটন অ্যাবেও কম যায় না, সাম্রাজ্যের নস্টালজিয়ায় মোচড় দিতে। সাম্প্রতিক কালে ব্রিটিশ টিভিতে ইন্ডিয়ান রেলওয়েজ় নিয়ে যে পরিমাণ আদর-আবেগ, দেখলে ভারতীয়মাত্রেরই ওয়েস্টমিনস্টারের দিকে তাকিয়ে বলতে ইচ্ছে করবে, তোমায় করি গো নমস্কার! ইন্ডিয়ান হিল রেলওয়েজ়, গ্রেট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে জার্নিস, ইন্ডিয়া’জ় ফ্রন্টিয়ার রেলওয়েজ়, আরও কত। সব ক্ষেত্রেই কোনও না কোনও সাহেব উপস্থাপক ঘুরে বেড়ান ট্রেনে চেপে ‘ভারত এক খোঁজ’ ভঙ্গিতে, যার নিহিতার্থ, ভারতকে কী সাংঘাতিক উপহারই না দিয়েছি আমরা! সতনম সঙ্গেরা তাঁর বই এম্পায়ারল্যান্ড-এ লিখেছেন, এখনকার ব্রিটেনে যে কোনও সাম্রাজ্যবিষয়ক সমালোচনাই এমন অবধারিত ভাবে ‘ইন্ডিয়ান রেলওয়েজ়’ দিয়ে শেষ হয় যে ক্যাথরিন স্কোফিল্ড নামে এক ইতিহাসবিদ টুইটার হ্যাশট্যাগ চালু করে দিয়েছিলেন এই ভাবে— #অকেশনাল ম্যাসাকার #বাটদ্যরেলওয়েজ়। দারুণ আইডিয়া বলতে হবে, ‘টু হাইলাইট এগজ়াম্পলস অব টায়ারসাম টাব-থাম্পিং জিঙ্গোইজ়ম’।
সাম্রাজ্য এখন নতুন সারস্বত সেনসেশন, বলা যায়। লেবার পার্টির এমপি ট্রিশাম হান্ট লিখেছেন একটি বই— এম্পায়ারের তিন রত্ন বম্বে-সিঙ্গাপুর-দুবাইয়ের মহাপৃথিবী নিয়ে। নিয়াল ফার্গুসনের হাতে এম্পায়ারের প্রশংসা মোটের উপর কটেজ ইন্ডাস্ট্রি-তে পরিণত হয়েছে, এত বিবিধ তার প্রচার বাজার। আর এ সবের উল্টো দিকে আছে সতনম সঙ্গেরার বইটি, অসাধারণ মনোগ্রাহী! ব্রিটেন কী ভাবে তার সাম্রাজ্যকে তৈরি করেছে তা তো অনেক শুনেছি আমরা, কিন্তু সাম্রাজ্য কী ভাবে আজকের ব্রিটেনকে তৈরি করেছে তিলে তিলে— তা জানার জন্য এই বই পড়তেই হবে। বিলিতি সাহেবদের এক দিকে এম্পায়ার বিষয়ে অ্যামনেশিয়া বা আশ্চর্য বিস্মরণ, আর অন্য দিকে উদ্ধত আত্মগরিমা— সঙ্গেরার ভাষায় ‘দি এম্পায়ার স্টেট অব মাইন্ড’— জানতে এই বই দেখে নিতেই হবে। বিশেষত দাসপ্রথা প্রচলন নিয়ে সাম্প্রতিক ইংল্যান্ডের বেশ বড় অংশের নির্লজ্জ আত্মপক্ষসমর্থন অজানা ছিল বইটি পড়ার আগে। ইতিমধ্যেই সানডে টাইমস বেস্টসেলার এটি, কিন্তু তাতে কী। নিন্দা-কুৎসার ঝড় বইয়ে দিয়েছে এই বই। সঙ্গেরাকে সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করা হয়েছে কী ভাবছেন তিনি দেখেশুনে। তাঁর উত্তর— বাইরে ঠিক থাকলেও, ব্যক্তিগত ভাবে তিনি ‘ডিপলি আপসেট’, “পিপল রাইট টু মি অল দ্য টাইম নাও টু গেট ব্যাক টু হোয়্যার আই কাম ফ্রম। আমি ওদের উপদেশ শুনেছি, সোজা চলে এসেছি উলভারহ্যামটনে।” বিষাদে-প্রসাদে মজার উত্তর তাঁর।
মজার তো শেষ নেই। শোনা যাচ্ছে ব্রেক্সিট-উত্তর কালের ব্রিটিশ নেতাদের বাগাড়ম্বর: ও সব ইউরোপীয় ইউনিয়ন দিয়ে কী হবে, গুলি মারো, আমাদের কমনওয়েলথ-ই যথেষ্ট! শুনে হাঁ হতে হয়! কোথায় ইইউ, কোথায় কমনওয়েলথ— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুনিয়ায় কমনওয়েলথ তো তার শুরুর দিন থেকেই শুনশান, ছোটখাটো দ্বীপদেশ কয়েকটি, অনিচ্ছুক গোমড়ামুখো এশীয়-অস্ট্রেলেশীয় কূটনীতিক কয়েক জনা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তো কমনওয়েলথ শুনলেই এমন চোয়াল শক্ত করেন যে, বেচারি নতুন রাজা চার্লস-এর কপালে কী আছে ভাবতেও উদ্বেগ হয় তাবৎ ‘প্রজাবিশ্ব’র।
তবে, মোদীর দেশে রানিবিয়োগের সময়ে প্রাণ ভরে ‘মোর্ন’ করতে ভুলিনি আমরা। এ বছরের ‘নাইন-ইলেভন’এ জাতীয় শোক পালিত হয়েছে রানির শোকে। অন্তত এই আশ্বাস ও বিশ্বাসে ভর করে বাকিংহাম প্যালেস আগামী মে মাসে ভারতরত্ন কোহিনুর বার করে পরিয়ে দিতেই পারে রাজপত্নী ক্যামিলাকে। ভয় কী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy