নেতা: কলকাতার শহিদ মিনারে মাদ্রাসা ছাত্রদের এক সমাবেশে বক্তৃতা দিচ্ছেন মুলায়ম সিংহ যাদব। জানুয়ারি, ২০০১
১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকের কথা। উত্তরপ্রদেশের ইটাওয়া জেলার যশবন্তনগরের সংযুক্ত সমাজবাদী পার্টির বিধায়ক নত্থু সিংহ এসেছেন পার্শ্ববর্তী মৈনপুরী জেলায় কুস্তির টুর্নামেন্ট দেখতে। হরিয়ানা-পঞ্জাবের মতো পশ্চিম উত্তরপ্রদেশেও তখন কুস্তি খুব জনপ্রিয়। দেখলেন, কুস্তির রিং-এ ছোটখাটো কিন্তু গাঁট্টাগোট্টা চেহারার এক কুড়ি-বাইশের তরুণ বিপক্ষের কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বীদের অনায়াসে কাঁধে তুলে এমন আছাড় মারছে যে, কেউ দাঁড়াতেই পারছে না। পরে আলাপ করে যখন জানলেন যে, ক্ষিপ্রবুদ্ধি ছেলেটি কুস্তির পাশাপাশি সমাজবিজ্ঞানে এম এ পাশ করে স্থানীয় স্কুল আর ইন্টার কলেজে পড়াচ্ছে, তখন নত্থুর জহুরির চোখ ভবিষ্যৎ রাজনীতির না-কাটা হিরেটিকে চিনতে ভুল করেনি। সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের রিং-এ সে দিনের তরুণ মুলায়ম সিংহ যাদব নানা রঙের প্রতিপক্ষকে বার বার কুপোকাত করেছেন।
নত্থুর হাত ধরেই ‘অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি’র সেই তরুণ মুলায়মের রামমনোহর লোহিয়া-প্রবর্তিত নিম্নবর্ণভিত্তিক সমাজবাদী রাজনীতিতে হাতেখড়ি ও পরে উল্কার গতিতে উত্থান। ১৯৬৭-র বিধানসভায় নত্থুর ছেড়ে দেওয়া আসনে নির্বাচিত হওয়া; উনিশ মাসের জরুরি অবস্থার (১৯৭৫-৭৭) পুরোটাই জেলে কাটিয়ে ১৯৭৭-এ ভোটে জিতে প্রথম বার উত্তরপ্রদেশে রাষ্ট্রমন্ত্রী, এবং ১৯৮৯ সালে রাজীব-বিরোধী হাওয়ায় ভিপি সিংহের জনতা দলের টিকিটে জিতে প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হওয়া। কুর্সির মেয়াদ সে দফায় দু’বছরের কম। এর পর ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৫ দ্বিতীয় বার, এবং ২০০৩-০৭ তৃতীয় বার মুখ্যমন্ত্রী। মাঝে প্রায় দু’বছর (১৯৯৬-৯৮) কেন্দ্রে যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। ১৯৯২-তে জনতা দল ছেড়ে নিজস্ব দল সমাজবাদী পার্টি গঠন, টানা পঁচিশ বছর সভাপতি থেকে ‘নেতাজি’ আখ্যা পাওয়া। দলের ঘরোয়া কোন্দলেও তাঁর প্রকৃত অবস্থান বুঝতে না দিয়ে, কখনও এ দিক কখনও ও দিক করে, আমৃত্যু নিজের ওজন বজায় রেখেছেন।
ভারতীয় রাজনীতিতে মুলায়মের গুরুত্ব বুঝতে গেলে গো-বলয়, অর্থাৎ উত্তরপ্রদেশ-বিহার-মধ্যপ্রদেশ-রাজস্থান-হরিয়ানার বিস্তৃত অঞ্চলের রাজনীতি সম্পর্কে খানিকটা ধারণা থাকতে হবে। হাজার জটিল জাতপাতের উচ্চাবচতায় বিভক্ত এখানকার প্রায়-সামন্ততান্ত্রিক সমাজ যুগের পর যুগ টিকে থেকেছে শক্তিমান জাতিগোষ্ঠীগুলির দাপট আর নিম্নবর্ণের প্রান্তিক মানুষদের ভীতিপূর্ণ সহাবস্থানের উপর। স্বাধীনতার পর, ভোটভিত্তিক রাজনীতির আবহে, কংগ্রেস দল প্রথম কুড়ি বছর কেন্দ্র ও প্রায় সব রাজ্যে একক শাসন বজায় রাখতে পেরেছিল দেশের এই বৃহত্তম অংশে জাতপাতের ক্ষেত্রে মোটের উপর স্থিতাবস্থা বজায় রেখে, এবং শক্তিমান আহির-জাঠ-গুজ্জর-রাজপুত (সংক্ষেপে ‘অজগর’) গোষ্ঠীগুলিকে নিজের পক্ষে রেখে।
অন্য দিকে, একদা নেহরুর সহযোগী ও কংগ্রেস সমাজবাদী দলের অন্যতম নেতা রামমনোহর লোহিয়া মনে করতেন যে, ভারতের মতো জাতপাত-বিভক্ত দেশে সমাজবাদকে কেবল অর্থনৈতিক শ্রেণি-বৈষম্য মেটালেই চলবে না, একই সঙ্গে জাতপাতের বৈষম্যও দূর করতে হবে। ভারতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিম্নবর্ণের মানুষরাই আর্থিক দিক থেকেও সবচেয়ে বঞ্চিত, তাই আর্থসামাজিক অন্যায় ঘোচাতে লোহিয়া নিম্নবর্ণগুলির জন্য বিশেষ সংরক্ষণের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। বিগত শতকের ষাট-সত্তরের দশকে বিশেষত উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে বহু লোহিয়াপন্থী সমাজবাদী যখন কংগ্রেসের স্থিতাবস্থাবাদী রাজনীতির বদলে ‘সামাজিক ন্যায়’-এর উপরে গুরুত্ব দিচ্ছিলেন, তার মধ্যে দুই তরুণ যাদব নেতাও— উত্তরপ্রদেশের মুলায়ম, ও বিহারের লালু প্রসাদ— ছিলেন। ১৯৯০ সালে সদ্য প্রধানমন্ত্রী হওয়া ভিপি সিংহও চাইছিলেন রামমন্দিরকে সামনে নিয়ে আসা বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থান ঠেকাতে। তাই মণ্ডল কমিশনের দশ বছরের পুরনো সুপারিশ (অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্য ২৭% সংরক্ষণ) কার্যকর করলেন। এই সুপারিশ শিক্ষা ও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে যেমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনল, তেমনই গো-বলয়ের জাতপাতভিত্তিক রাজনীতিরও চরম পুনর্বিন্যাস ঘটাল।
বিহার ও উত্তরপ্রদেশে লালু ও মুলায়ম মুখ্যত ওবিসি যাদব ও সংখ্যালঘু মুসলমানদের মধ্যে নতুন সমীকরণ গড়ে এই খেলায় অন্যদের ‘টেক্কা’ দিলেন। তার আগেই মুলায়ম ১৯৭৭-এ প্রথম বার উত্তরপ্রদেশে রাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে এই নতুন রাজনীতিতে হাত পাকাচ্ছিলেন— রাজ্য সমবায়গুলিতে তফসিলি জাতির জন্য সংরক্ষণ চালু করে। ১৯৮৯-এর ডিসেম্বরে মুলায়ম প্রথম বার মুখ্যমন্ত্রী হন (বিজেপি-কে ঠেকাতে ‘বাধ্য হওয়া’) কংগ্রেসের সমর্থনে। সে সময় (১৯৯০) এক দিকে সেপ্টেম্বর মাসে বিজেপি সভাপতি লালকৃষ্ণ আডবাণীর রামরথ সোমনাথ থেকে বেরিয়ে ভারত কাঁপাচ্ছে, অন্য দিকে বাবরি মসজিদ ভেঙে রামমন্দির নির্মাণ করার উদ্দেশ্যে হাজার হাজার করসেবক অযোধ্যায় জড়ো হচ্ছেন। মুলায়ম বলেছিলেন, মসজিদের কাঠামো রক্ষা করবেনই। ফলে, পুলিশের সঙ্গে করসেবকদের বহু দফায় সংঘর্ষ চলতে থাকে। অবশেষে অক্টোবরের ৩০ ও নভেম্বরের ২ তারিখ পুলিশের গুলিতে বেশ কিছু করসেবক নিহত হন। এতে বিজেপি দারুণ চটে তাঁর নাম রেখেছিল ‘মৌলানা মুলায়ম’। এর কয়েক মাস পরে কংগ্রেস সমর্থন তুলে নিলে মুলায়ম মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। এর পর ১৯৯২-তে জনতা দল ছেড়ে তাঁর নিজস্ব সমাজবাদী পার্টি গঠন।
ইতিমধ্যে জাতপাতভিত্তিক ‘সামাজিক ন্যায়’-এর প্রয়োগে গো-বলয়ের ‘নিচুতলা’ আরও খণ্ডিত হল। আম্বেডকরের আদর্শে কাঁসিরাম ও মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি নানা শ্রেণির ‘অচ্ছুত’ জাটভ-দের ‘দলিত’ ভোটব্যাঙ্ক গড়ে ক্ষমতাবান (ওবিসি-ভুক্ত) যাদবদের প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠল। বার বার সামাজিক সমীকরণ বদলাতে ওস্তাদ ‘নেতাজি’ এ বার তাঁর উদীয়মান বিরোধী মায়াবতীর বিএসপি-র সঙ্গে সমঝোতা করেই ১৯৯৩-এর ডিসেম্বরে দ্বিতীয় বার মুখ্যমন্ত্রী হন। বছর দেড়েক বাদে সেই জোট ভেঙে যায় এবং ইউপির অকংগ্রেস/অবিজেপি রাজনীতি এসপি ও বিএসপি-র দু’টি অক্ষে ভাগ হয়ে যায়। ইতিমধ্যে কেন্দ্রে যুক্তফ্রন্ট সরকার এসেছে এবং শেষ পর্যন্ত জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হতে না পারায়, মুলায়মের নাম উঠলেও (শোনা যায় লালু প্রসাদের আপত্তিতে) তাঁর ভাগ্যে প্রধানমন্ত্রিত্বের শিকে ছেঁড়েনি— প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সান্ত্বনা-পুরস্কারেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। ১৯৯৮-এ যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতনের পর মুলায়ম ফের ইউপি-র রাজনীতিতেই মনোনিবেশ করেন এবং বিএসপি-এসপি’র ক্ষমতা দখলের খেলায় শেষ বার ২০০৩ সালে মুখ্যমন্ত্রীর ‘মিউজ়িক্যাল চেয়ার’-এ বসেন চার বছরের জন্য। পরের পাঁচ বছর (২০০৭-১২) মায়াবতী মুখ্যমন্ত্রী থাকার পর মুলায়মের প্রথম পক্ষের পুত্র অখিলেশ মুখ্যমন্ত্রী হন। দলের রাশও তরুণ অখিলেশের হাতেই যেতে থাকে, এবং তাকে কেন্দ্র করেই শুরু হয় যাদব বংশের ভাইপো (অখিলেশ) ও কাকার (শিবপাল) কাজিয়া। একদা মৈনপুরীর কুস্তিগির এ বার রাজনীতির পারিবারিক রিং-এ রেফারির মতো অনেক সময় ভাই শিবপালের দিকে, কখনও বা পুত্র অখিলেশের দিকে ভারসাম্য রেখে নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যান। এর পর ধীরে ধীরে অন্তরালে যেতে শুরু করেন এবং আবডালে বিজেপির সঙ্গে সখ্য বাড়ে। এর মধ্যে ২০১৪ থেকে দু’দফায় সাংসদও হয়েছেন। ২০১৯ সালে সংসদের শেষ অধিবেশনে বলে বসেন, নরেন্দ্র মোদীকেই তিনি পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী দেখতে চান! এই ভাবে একদা কট্টর বিজেপি-বিরোধী ‘মৌলানা’ মুলায়মের রাজনৈতিক জীবনের ‘আয়রনিক’ বৃত্তটি সম্পূর্ণ হয়।
‘সামাজিক ন্যায়’-এর কথা বলে জাতপাতভিত্তিক খণ্ডকরণের যে-রাজনীতি মুলায়ম প্রবর্তন করে গেলেন, তা মায়াবতীদের হাত ধরে আরও খণ্ডিত হল। এখন ‘মহাদলিত’ গোষ্ঠীগুলিও রাজনীতির বাজারে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই চক্রব্যূহ থেকে বেরোনোর চাবিকাঠি কারও হাতে নেই। প্রথাগত ভাবে সামাজিক স্থিতাবস্থায় বিশ্বাস রাখা মধ্যপন্থী কংগ্রেসের পক্ষে এর মোকাবিলা অসম্ভব। এই শূন্যস্থান পূরণ করতে ২০১৪ থেকে বিজেপি এই খণ্ডগুলির ‘স্বীকৃতি’ দিয়ে তাদের হিন্দুত্ববাদী আদর্শ ও সংগঠনের ‘অভ্যন্তর’-এই যত দূর সম্ভব স্থান দিয়ে উত্তরপ্রদেশ তথা সারা ভারতে পুরনো কংগ্রেসের মতোই ‘একদলীয়’ শাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে, কেন্দ্রীয় স্তরে যার মোকাবিলার শক্তি কোনও একক পার্টির এই মুহূর্তে নেই। রাজনীতিতে এই বিশেষ ‘অবদান’ বাদে মুলায়ম কিন্তু আদতে ছিলেন পিতৃতন্ত্রের প্রবল সমর্থক। সংসদ ও বিধানসভায় মেয়েদের এক-তৃতীয়াংশ সংরক্ষণের তীব্র বিরোধী। নারীবিদ্বেষী নানা মন্তব্যও করেছেন অক্লেশে। অথচ, তাঁর তাত্ত্বিক গুরু লোহিয়া ভেবেছিলেন, প্রকৃত সমাজবাদ আনতে হলে জাতপাতের সাম্যের সঙ্গে লিঙ্গগত সাম্য প্রতিষ্ঠাও সমান জরুরি।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy