একটা সময় আসে, যখন জমি ছেড়ে দিতে হয়। ছবি: রয়টার্স।
বিকট আওয়াজে বিছানাটা কেঁপে উঠল। চারদিকে চুরচুর হয়ে কাচ ভেঙে পড়ার শব্দ। চমকে চোখ খুলল কিশোর। কিন্তু তাতে কিছু বদলাল না। চোখ বুজলে যে নিকষ অন্ধকার, চোখ খোলার পরেও সেই অন্ধকারই দেখছিল সে চারপাশে। অন্ধকারের রং কখনও বদলায় না।
সাইরেনের কান-ফাটানো শব্দের সঙ্গে আর একটা বিস্ফোরণ! চারদিকের আঁধার আরও গাঢ়। আরও ঝুঁঝকো।
নেটোর যুদ্ধবিমান আবার বোমাবর্ষণ শুরু করল বেলগ্রেড শহরে।
সেই মিশমিশে অন্ধকারের মধ্যে ১১ বছরের কিশোরের ডাকনাম ধরে কেউ একটা চিৎকার করছিল, ‘‘নোলে! নোলে! ভাইরা কোথায় গেল?’’
হতবাক কিশোর ভাবছিল, সত্যিই তো! কোথায় গেল তার চার আর আট বছর বয়সি দু’ভাই? বেলগ্রেডের আকাশে বোমারু বিমানের আনাগোনার সময় থেকে সে-ই তো তাদের স্বঘোষিত অভিভাবক! বিস্ফোরণের শব্দে মা বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়েছেন। মাথায় চোট পেয়ে তিনি প্রায় সংজ্ঞাহীন। তাঁর হুঁশ ফেরানোর চেষ্টা করছেন বাবা।
মাথার উপর আবার বিমানের তীব্র শব্দ। অদূরে কোথাও বিস্ফোরণের অভিঘাতে আবার কেঁপে উঠল গোটা বাড়ি। সিঁড়ি দিয়ে দুদ্দাড়িয়ে নেমে অন্ধকার রাস্তা ধরে দৌড় শুরু করল পাঁচ জনের পরিবার। দু’ভাইকে কোলে নিয়ে আগে বাবা-মা। কয়েক কদম পিছনে সে। দৌড়-দৌড়-দৌড়! ছুটতে ছুটতে আচমকা হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল কিশোর। ছেঁচড়ে গেল দু’হাতের তালু। নুনছাল উঠে গিয়ে জ্বালা করতে লাগল দু’হাঁটু। ঠান্ডা কংক্রিটের ফুটপাথের উপর পড়ে থাকতে থাকতে তার নিজেকে আচম্বিতে ভারী একলা মনে হচ্ছিল। চিৎকার করে বাবা-মা’কে ডাকছিল সে। কিন্তু তাঁরা তখন অনেকটা দূরে। কিশোর পুত্রের আকুতির সীমার বাইরে। ক্রমশ ছোট হতে হতে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছিল তাঁদের ঝাপসা অবয়ব।
রাতের আকাশ চিরে ফালাফালা হয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এক মহাজাগতিক তুষার-কোদাল মেঘের গা থেকে বরফের বিশাল বিশাল চাঙড় চেঁছে তুলে আনছে। রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে-থাকা কিশোর ঘাড় ঘুরিয়ে তার বাড়ির দিকে তাকিয়ে বিস্ফারিত নয়নে দেখল, ফেলে-আসা সেই বাড়ির ছাদের উপরে মহাকায় এফ-১১৭ বোমারু বিমানের ইস্পাত-ধূসর ত্রিভুজ। চোখের পলক ফেলার আগে সেই ত্রিভুজ উড়ে এল তার মাথার ঠিক উপরে। সে দেখল, দু’ফাঁক হয়ে খুলে যাচ্ছে সেই ত্রিভুজের বিশাল ধাতব উদর। সেই গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসছে দু’টি লেজ়ার-নির্দেশিত মিসাইল। যে ক্ষেপণাস্ত্র ধাওয়া করছে তার পরিবার, তার বন্ধুবান্ধব, তার পরিপার্শ্বকে। ছুটে যাচ্ছে সেই সব কিছুকে ধ্বংস করতে, যা কিছু সে আজন্ম প্রিয় বলে জেনে এসেছে।
দ্রুত গতির স্টেল্থ বম্বারের পেট ফাঁক করে বেরিয়ে আসা সেই জোড়া মিসাইল তার মাথার উপরের আকাশ চিরে গিয়ে পড়ল কিছু দূরের হাসপাতালে। ভয়াবহ বিস্ফোরণের চোটে অনুভূমিক ইমারত ধসে পড়ল মাটিতে। ভয়ার্ত কিশোর দেখছিল, একঝলকে হাসপাতাল বাড়িটাকে পেটে আগুনের গোলা-ঠাসা এক অতিকায় ক্লাব স্যান্ডুইচের মতো লাগছে। বাতাসে ধোঁয়া, ধুলো আর ধাতু গলে যাওয়ার কটু গন্ধ। বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত বেলগ্রেড শহরটাকে একটা ফেটে-যাওয়া পাকা কমলালেবুর মতো লাগছিল তার।
তার পর থেকে পরিবার-সহ সেই কিশোরের টানা ৭৮ দিন কেটেছিল বোমা-নিরোধক বাঙ্কারে। শিকেয় উঠেছিল তার ভালবাসার টেনিস। ছেলেবেলার সেই বর্ণনা দিয়ে তাঁর ‘সার্ভ টু উইন’ বইয়ের (এই বইয়ের ওই পরিচ্ছেদগুলো পড়েই তাঁর প্রতি এক অবুঝ ভালবাসার জন্ম। যত বার পড়ি, গায়ে কাঁটা দেয়। মনে হয়, জীবনের এমনতর যুদ্ধ যিনি জিতে এসেছেন, তিনি কোর্টে সমস্ত লড়াই জিতুন) প্রথম পরিচ্ছেদে তিনি লিখেছেন— এত দিন, এত বছর পরেও কর্কশ, তীক্ষ্ণ, বিকট আওয়াজ তাঁর মধ্যে এক আশরীর ভয়ের জন্ম দেয়! অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে!
যেমন হল সে দিন। গলা ধরে এল। অধর আর ওষ্ঠে সামান্য চাপ। যদি কান্নাটা সামান্য উঁচু হয়ে-থাকা কণ্ঠার হাড়েই আটকে রাখা যায়! হল না। মাথা নিচু করে তিনি লুকোতে চাইছিলেন অশ্রু। পারলেন না। কান্নার দমকে পেশল শরীরের কোমর থেকে কাঁধ পর্যন্ত থরথর করে কেঁপে উঠল। দু’হাতে চোখ ঢেকে ফেললেন তিনি।
ইদানীং গ্র্যান্ড স্ল্যামে তাঁর ম্যাচ থাকলে দেখি না। টেনশন হয় বড্ড। একটা সংস্কারও কাজ করে। দেখেছি, ‘লাইভ’ ম্যাচ না-দেখলেই তিনি জেতেন। যেমন এই উইম্বলডনে। সেমিফাইনাল পর্যন্ত তাঁর একটাও ম্যাচ দেখিনি। যেমন প্রথম দিকে দেখিনি গত রবিবারের ফাইনালও। একটু ভয়ে ভয়েই আনন্দবাজার অনলাইনের সাইট খুলে মাঝেমধ্যে দেখছিলাম। প্রথম সেট ৬-১ জিতলেন তিনি। দ্বিতীয় সেট টাইব্রেকারে হারলেন। হারলেন ঠিকই। কিন্তু টাইব্রেকার তো! ভাবলাম, এ বার খেলাটা দেখিই না হয়।
পরে দেখলাম, রবিবারের উইম্বলডন ফাইনালে সারা পৃথিবীর কয়েক কোটি দর্শকের অংশ ছিলাম মাত্র। বিবিসি জানাচ্ছে, ২০১৬ সালের (যখন অ্যান্ডি মারে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। ব্রিটিশ নাগরিকের ট্রফি জয় দেখতে হামলে পড়েছিলেন ইংল্যান্ডবাসী) পর এই প্রথম এত দর্শক তাদের প্ল্যাটফর্মে উইম্বলডন ফাইনাল দেখেছেন। ১১.৩ মিলিয়ন। ১ কোটি ১৩ লক্ষ। শুধু একটি জানালায় চোখ রেখে!
গ্যালারিতে উইম্বলডন টুপি মাথায় চাপিয়ে হাজির ‘ওয়ান লাস্ট টাইম’ খ্যাত গায়িকা আরিয়ানা গ্রান্দে, ‘স্পাইডারম্যান’-এর চরিত্রাভিনেতা অ্যান্ড্রু গারফিল্ড, ‘লর্ড অফ দ্য রিংস’-এর তারকা ইয়ান ম্যাককেলেন, গাই রিচি, ‘জেমস বন্ড’ ড্যানিয়েল ক্রেগ এবং তাঁর স্ত্রী র্যাচেল ওয়াইজ়। প্রিয়ঙ্কা চোপড়ার স্বামী নিক জোনাস, বলিউডের ফ্যাশনিস্তা সোনম কপূর, অভিনেত্রী নীনা গুপ্তেরা।
তবে এই লেখায় একটা আলাদা অনুচ্ছেদ রাখতে হল দর্শকাসনে সবুজ কাচ-সোনালি ফ্রেমের অ্যাভিয়েটর রোদচশমা, এলোমেলো বাদামি চুল আর গুঁড়ি গুঁড়ি দাড়ির ৫৯ বছরের (তাঁর সমানের কোর্টে যুযুধান দুই মহারথীর মিলিত বয়সের চেয়েও বেশি) এক ঝকমকে প্রৌঢ়ের জন্য। অ্যাঞ্জেলিনা জোলির জন্য ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। ব্র্যাড পিট এখনও বুক ধুকপুক করিয়ে দেওয়ার মতো হ্যান্ডসাম।
যাক সে কথা!
বলতে চাইছি, কিংবদন্তির জন্য মঞ্চ তৈরি ছিল। উইম্বলডন জয়ের নিরিখে রজার ফেডেরারের রেকর্ড ছোঁয়ার মঞ্চ। গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ে মার্গারেট কোর্টের রেকর্ড ছোঁয়ার মঞ্চ। যে মঞ্চ তাঁরই চোখের সামনে ৪ ঘণ্টা ৪২ মিনিটে একটু একটু করে বদলে গেল নবীনের আহ্বান-ভূমিতে। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, কোনও না কোনও একটা সময় আসে, যখন জমি ছেড়ে দিতে হয়। দিতেই হয়।
তিনি কি সেন্টার কোর্টের বাতাস হাতড়ে সেই জমিটা ধরে রাখার, সেই আসনটুকু ধরে রাখার আকুল চেষ্টা করছিলেন? একটা অন্তিম আকুতি? ছেড়ে দিতে দিতেও ধরে রাখার একটা মরিয়া প্রয়াস? নইলে কেন সাত মিনিটের টয়লেট ব্রেক নেবেন! কেন সার্ভিস করার সময় বাড়তি সময় নেবেন? নিয়ম বলে, সার্ভিস করতে হবে ২৫ সেকেন্ডের মধ্যে। ফাইনাল বলে একটু ছাড় পাওয়া যায় হয়তো। তাঁর তরুণ প্রতিপক্ষ নিয়েছেন গড়ে ২৭ সেকেন্ড। তিনি অন্তত ৩৩। কখনও কখনও বাড়তি আরও কয়েক সেকেন্ড। ফুসফুসে আরও কিছু বাতাস ভরে নেওয়ার জন্য। এতটাই যে, চেয়ার আম্পায়ার অতিরিক্ত সময় নেওয়ার জন্য তাঁকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘‘গেট অন উইথ ইট!’’ অর্থাৎ, অনেক হল, এ বার খেলাটা শুরু করুন! আর গোটা গ্যালারি চলে গিয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। মনে হচ্ছিল, মশাল নিভে যাওয়ার সময় কাছিয়ে আসছে বুঝলে সকলেই কি আরও বেশি বেশি করে আগুনটা আঁকড়ে ধরতে চান! যেন শেষের সময়টা কাছে না-আসে! যেন আলোটা সরে না-যায়! সেই দুর্মর আকাঙ্ক্ষা, সেই উদগ্র বাসনার কাছে ভেসে যায় যাবতীয় দার্শনিকতা, সহবত, স্পোর্টসম্যান স্পিরিট। কোনও মহত্ব আর কাজ করে না।
মনে হচ্ছিল, স্পেনীয় তরুণ তাঁকে সেই দাওয়াইটাই দিচ্ছেন, যেটা তিনি নিজে সবচেয়ে ভাল দিয়ে এসেছেন এতদিন। যাকে চ্যাম্পিয়নের স্নায়ু বলে। যে স্নায়ুর জোর প্রতিপক্ষের মনের ভিতর ঢুকে গিয়ে তার নিশ্চিন্তিকে ভেঙে-দুমড়ে দিয়ে সেই শূন্যস্থানে অনিশ্চয়তা আর হতাশা ভরে দেয়। শকুন যেমন মৃত্যুর নিশ্চিত গন্ধ পেয়ে তার শিকারের দিকে উড়ে যায়, অদূরে দাঁড়িয়ে সেই গন্ধ পাচ্ছিলেন ২০২৩ সালের উইম্বলডনের ভাবী চ্যাম্পিয়ন। তিনি বুঝতে পারছিলেন, নেটের উল্টো দিকে টেনিসবিশ্বের সফলতম (যদি শ্রেষ্ঠতম না-ও হন) খেলোয়াড়ের এত দিনের নির্মিত সৌধ ভেঙে পড়ছে। তিনি সঙ্কেত পাচ্ছিলেন সেই বিনির্মাণের।
গোলার মতো সার্ভিস! তেমনই ক্ষিপ্র কোমরের নড়াচড়া। অবিশ্বাস্য ‘পাওয়ার টেনিস’ খেলেন রাফায়েল নাদালের ছাত্র। কিন্তু তার সঙ্গেই অসম্ভব নৈপুণ্যে মিশিয়ে দেন বিষাক্ত ভলি আর ড্রপশট। লাফিয়ে শূন্যে উঠে তীক্ষ্ণ ক্রসকোর্ট মারেন। পরের রিটার্নটা যখন ডাউন দ্য লাইন ফোরহ্যান্ড মারবেন বলে ভাবছে সারা বিশ্ব, ভাবছেন নেটের উল্টো দিকে গুঁড়ি মেরে থাকা কিংবদন্তি প্রতিদ্বন্দ্বীও, তখন হাওয়া কেটে চাবুকের মতো র্যাকেট নামিয়ে এনেও শেষমুহূর্তে ব্রেক কষে সেকেন্ডের ভগ্নাংশে শূন্যে দাঁড় করিয়ে দেন তাঁর র্যাকেট। হেলিকপ্টারের রোটর ব্লেডের মতো। তার পর অবিশ্বাস্য নিয়ন্ত্রণে আলতো আদরে একঝলকে নেট ছুঁইয়ে বলটা ফেলে দেন উল্টো দিকের কোর্টে।
২৩ গ্র্যান্ড স্ল্যাম ট্রফির মালিককে ভোম্বল দেখাচ্ছিল। যখন নেট পোস্টে আছড়ে র্যাকেটটা ভাঙলেন, মনে হল, এ বার এই লোকটা টেনিসের মূল ভিত্তি এবং আসবাবপত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে। মনে করছে, নেটের ও পাশের কচি মুখটার পাশাপাশি এরাও তার প্রতিপক্ষ!
কিংবদন্তিকে কি খানিকটা বিস্ময়াবিষ্টও দেখাল ম্যাচের শেষে? খানিকটা হতভম্ব? খানিক রুদ্ধবাক? যখন মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে তিনি বলছেন, ‘‘অ্যামেজিং! অ্যামেজিং!’’ তখন তাঁর শরীরী ভাষায় একটা বিস্ময় ধরা পড়ছিল। বোধহয় খানিকটা অবিশ্বাসও— যে, কালকের একটা ফচকে আমার ড্রয়িংরুমে এসে আমায় মেরে গেল! বার তিনেক শব্দটা বললেন— অ্যামেজিং! আশ্চর্য! মনে হচ্ছিল, বলছেন বটে গোটা পৃথিবীর নজরের সামনে ফুট বিশেক দূরে দাঁড়িয়ে-থাকা বিজয়ীকে সম্বোধন করে। কিন্তু আসলে বলছেন নিজেকে। স্বগতোক্তির মতো— আশ্চর্য!
কোনটা আশ্চর্য? আশ্চর্য এটা যে, ২০ বছরের এক ছোঁড়া, যাকে এই সে দিন প্যারিসে হারালাম, সে-ই পৃথিবীবিখ্যাত ঘাসের কোর্টে আমার অশ্বমেধের ঘোড়া থামিয়ে দিল! কোয়ার্টার ফাইনাল জিতে উঠে যে আমি জাঁক করে বলেছিলাম, ‘‘তরুণ খেলোয়াড়েরা আসছে। ওরাও জিততে চায় ঠিকই। বাট দ্যাট এইন্ট হ্যাপেনিং’’, সেই এক তরুণই আমাকে ভূলুণ্ঠিত করে গেল! সেমিফাইনালে সেন্টার কোর্টের যে গ্যালারি আমায় টিটকিরি দিচ্ছিল আর আমি কঠিন পয়েন্ট জিতে উঠে মুখে কপট কান্নার ভঙ্গি করে তাদের পাল্টা দিচ্ছিলাম, যে সেন্টার কোর্টে গত ১০ বছর আমি হারিনি, সেই কোর্টেই আমার ভূমিশয্যা রচিত হল!
তাঁর মধ্যে কোথাও কি একটা অহং কাজ করছিল? আত্মবিশ্বাসের উপর কি অহমিকার একটা পাতলা, ফিনফিনে বরফের মতো আস্তরণ তৈরি হয়েছিল? নইলে সেমিফাইনালে টুর্নামেন্টের অন্যতম কনিষ্ঠ প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে কেন তিনি অযথা দীর্ঘায়িত করছিলেন তাঁর বৃংহণ? কেন সার্ভিসের সময় চিৎকার করে চেষ্টা করছিলেন প্রতিপক্ষের মনঃসংযোগ নষ্ট করার? চেয়ার আম্পায়ার তাঁকে পয়েন্ট জরিমানা করায় ঘন ভ্রু উঁচিয়ে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। ম্যাচ জিতে উঠে সংক্ষিপ্ত মন্তব্যে বলেছিলেন, ‘‘আমার সঙ্গে কখনও এমন ঘটনা ঘটেনি! হয়তো স্টেডিয়ামের ছাদে প্রতিধ্বনি হচ্ছিল। জানি না।’’
সেই অহমিকাই কি তিনি গায়ে জড়িয়ে নেমেছিলেন ফাইনালে? যা শুষে নিয়েছিল তাঁর ভিতরের নম্রতা। যে তিনি অহরহ প্রতিপক্ষের দুর্ধর্ষ শটে র্যাকেট-তালি দেন, সেই তিনি কি সেন্টার কোর্টে ততটাই করুণাময় রইলেন? অন্তিম সেটে প্রতিটি শট মারার সময় যে জান্তব গোঙানি তাঁর কণ্ঠ থেকে নির্গত হচ্ছিল, তার মধ্যে কি খানিকটা অসহায়তাও মিশে ছিল? খানিকটা মোহভঙ্গের অনুপান?
কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে প্রিন্সেস অফ ওয়েল্স, ডাচেস অফ কেমব্রিজ কেট মিডলটন। তাঁর অনতিদূরে নতুন চ্যাম্পিয়ন। মোহাবিষ্টের মতো পরাভূত, ধ্বস্ত সম্রাট বলছিলেন, ‘‘ভেবেছিলাম, ক্লে কোর্ট আর হার্ড কোর্টে তোমার বিরুদ্ধে ঝামেলায় পড়তে পারি। কিন্তু ঘাসের কোর্টে? নাহ্!’’ বলছিলেন, ‘‘আমি এর আগে কখনও এমন একজন খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধে খেলিনি! রজার আর রাফার নিজস্ব শক্তি যেমন আছে, তেমনই দুর্বলতাও আছে। বাট কার্লোস ইজ আ ভেরি কমপ্লিট প্লেয়ার। বিভিন্ন সারফেসে মানিয়ে নেওয়ার যে আশ্চর্য ক্ষমতা ওর রয়েছে, সেটাই ওকে সর্বত্র সফল করবে। ওর কেরিয়ারকে বহু দূর বিস্তৃত করবে!’’
ট্র্যাজেডির মতো লাগছিল। মহাকাব্যের মতো লাগছিল। মনে হচ্ছিল, মহাকাব্য ট্র্যাজেডি থেকেই হয়। আর মনে হচ্ছিল, ট্র্যাজেডি রচিত হয় একটি বিশেষ মুহূর্তের অভিঘাতে।
তৃতীয় সেটের মাঝ বরাবর একটা গেমে ১৩টা ‘ডিউস’ হল (গেমটা টানা ২৬ মিনিট চলেছিল)। শেষপর্যন্ত গেমটা জিতলেন ভাবী চ্যাম্পিয়ন। জেতার পর গ্যালারির কানে তালা-ধরানো হর্ষধ্বনির মধ্যে ডান কানের পিছনে ডান হাতের আঙুল ছুঁইয়ে কুড়ি বছরের তরুণ সেন্টার কোর্টকে নির্ভুল ইঙ্গিতে বলছিলেন, আরও জোরে চিৎকার করো! আরও বজ্রনির্ঘোষে উদ্যাপন করো আমার জয়। আমি তোমাদের গর্জন এখনও ঠিকঠাক শুনতে পাচ্ছি না।
মনে হল, সেই বিন্দু থেকেই একটা সরণ শুরু হল। তৈরি হল মহাকাব্যিক ট্র্যাজেডির অভিঘাত। মনে পড়ল, তিনি লিখেছিলেন, এত বছর পরেও কর্কশ, তীক্ষ্ণ, বিকট আওয়াজ তাঁর শরীর জুড়ে একটা ভয়ের জন্ম দেয়! অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে!
মনে হল, বয়সে ১৬ বছরের ছোট তরুণের ছদ্মবেশে তাঁর কীর্তির মহাকাশে উড়ে এসেছে এক অতিকায় বোমারু বিমান। দু’ফাঁক হয়ে খুলে যাওয়া তার পেটের কালান্তক গহ্বর থেকে একের পর এক বেরিয়ে আসছে লেজ়ার-নির্দেশিত মিসাইলের মতো বিদ্যুৎগতির ডাউন দ্য লাইন শট। ধাওয়া করছে তাঁর সাফল্যকে। ছুটে যাচ্ছে তাঁর এত দিন ধরে গড়ে তোলা প্রিয় কীর্তিসৌধ ধ্বংস করতে। কাঁধ ঝুলে যাচ্ছে তাঁর। ঘাম জমছে চোখে। ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে দৃষ্টি।
বেলগ্রেড শহরের ঠান্ডা, পাথুরে রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে আকুল হয়ে বাবা-মা’কে ডাকতে-থাকা ১১ বছরের ভয়ার্ত কিশোর ‘নোলে’র সঙ্গে কোথাও একটা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিলেন ৩৬ বছরের অতুল কীর্তিমান নোভাক জোকোভিচ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy