চলতি সপ্তাহে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী লোকসভায় বিবৃতি দিয়েছেন, তিনি বাজেটঘাটতির স্তরকে জিডিপি-র ৬.৪ শতাংশের মধ্যে আটকে রাখবেন। —ফাইল চিত্র।
দেশের অর্থমন্ত্রী হিসাবে নির্মলা সীতারমণের কার্যকালের এটি চতুর্থ বছর। ২০১৯ সালে কাজ শুরু করার সময়ে তাঁর কর্মপদ্ধতি খানিক দুঃসাহসী বলে মনে হলেও এখন তা লক্ষণীয় রকমের বাস্তবমুখী। গোড়ার দিকে তাঁকে বেশ চাপের মধ্যেই কাজ শুরু করতে হয়েছিল। সেই সময়ের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে পরিস্থিতি মোটেই খুব সুবিধাজনক ছিল বলে মনে হয় না। আদায়ীকৃত রাজস্বের হার দ্রুত কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ১৮.৪ শতাংশে। এর পিছনে এক দিকে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির গতি কমে আসার বিষয়টি কাজ করেছিল। কোভিড অতিমারির আগেই এই গতিহ্রাসের বিষয়টি কাজ করেছিল। অন্য দিকে, বছরের মাঝখানে তিনি অপ্রত্যাশিত ভাবেই কর্পোরেট রাজস্ব কমানোর নীতি ঘোষণা করেছিলেন। এর প্রেক্ষিত হিসাবে কাজ করেছিল তার কয়েক দিন আগেই প্রধানমন্ত্রীর আমেরিকা সফর, যার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সে দেশের কর্পোরেট প্রভুদের সঙ্গে তাঁর আলাপ-আলোচনা। সেই রাজস্বহ্রাসের ফল দাঁড়ায় বছরের শেষে ৪.৫ শতাংশ হারে রাজস্ব-ঘাটতি। অথচ মূল বাজেটে ওই ঘাটতির হার দেখানো হয়েছিল ৩.৪ শতাংশ।
পরের বছরটিও খুব আশাব্যঞ্জক ছিল না। মনে রাখা দরকার, সেই বছরটি ছিল কোভিডের বছর। এবং অতিমারির প্রভাবে মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) লক্ষণীয় রকমের পতন ঘটে। কর্পোরেট রাজস্বের ক্ষেত্রে পতন ছিল ১৭.৮ শতাংশ, সেখানে পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি) বাবদ আয়ে ৮.৩ শতাংশ পতন দেখা গিয়েছিল। অথচ লক্ষ করার বিষয়, সেই নিরাশার পরিস্থিতিতেও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী কিন্তু কিছু সুযোগকে দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, আরও বেশি পরিমাণে দুর্ভাবনা জড়ো করলে পরিস্থিতির কিছু ইতরবিশেষ ঘটবে না। এবং সেই চিন্তা মাথায় রেখেই তিনি তাঁর হিসাবনিকাশ যথাযথ ভাবে তৈরি করেন। লাভ-লোকসানের বিষয়গুলিকে যথাযথ ভাবে চিহ্নিত করেন, তথাকথিত ‘লোকসান’-এর দিকগুলির পর্যালোচনা করে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের পথ প্রস্তুত রাখেন। এর ফলে বাজেটঘাটতি সংক্রান্ত বিভিন্ন কারচুপি বন্ধ হয়। সরকারের হিসাবের মধ্যে ‘অফ-ব্যালান্স শিট’ (যে ব্যালান্স শিটে সংস্থার সম্পদ ও দায় উল্লিখিত হয় না)-কে নিয়ে আসায় ঘাটতির হার রেকর্ড পরিমাণে বেড়ে ৯.২ শতাংশে গিয়ে ঠেকে। কিন্তু এর ফলে সরকারের হিসাবরক্ষার কাজে আত্মবিশ্বাস বাড়ে।
তাঁর তৃতীয় বাজেটে নির্মলা ইঙ্গিত রাখেন, তিনি ধোঁকা-পূর্ণ বাজেটের ত্রুটিগুলি বুঝতে পেরেছেন। আগের বছরগুলির তুলনায় ২০২১-’২২ অর্থবর্ষের জন্য রাজস্বের পরিসংখ্যানকে তিনি বেশ নিচুগ্রামেই রাখেন। এর ফলে প্রস্তাবিত পরিমাণের চাইতে আদায়ীকৃত রাজস্বের পরিমাণ ১৩.৪ শতাংশ বেশি হয়। এর ফলে কর বাদ দিয়ে অন্য ক্ষেত্র থেকে আদায়ীকৃত রাজস্বের ঘাটতি থেকে আগত সমস্যাগুলি আর ততখানি বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়নি এবং এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কিছুটা সুরক্ষাবলয়ের কাজ করেছিল।বিশেষত কোভিড অতিমারির সময় দরিদ্র মানুষের জন্য শস্য সরবরাহের মতো কাজ এর ফলেই সম্ভব হয়েছিল। সেই অর্থবছরের শেষে দেখা যায়, ঘাটতির যে আনুমানিক পরিসংখ্যান বাজেটে উল্লেখ করা হয়েছিল, তারই ধারেকাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে প্রকৃত ঘাটতির পরিমাণ।
এই বছর সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে। পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের উপর কর কমানো সত্ত্বেও কর থেকে আগত রাজস্বের পরিমাণ প্রস্তাবিত পরিসংখ্যান ছাড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু খরচের ক্ষেত্রে ভর্তুকির বিষয়টি আবার ফুলেফেঁপে উঠেছে। এর পিছনে এক দিকে যেমন ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে তৈরি হওয়া সারের মূল্যবৃদ্ধি থেকে কৃষকদের রক্ষা করার দায় কাজ করেছে, তেমনই কাজ করেছে সরকারের তরফে বিনামূল্যে শস্য সরবরাহ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত।
চলতি সপ্তাহে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী লোকসভায় বিবৃতি দিয়েছেন, তিনি বাজেটঘাটতির স্তরকে জিডিপি-র ৬.৪ শতাংশের মধ্যে আটকে রাখবেন। গত দু’টি অর্থবর্ষে তাঁর তরফে রাজস্ব আদায়ের সম্ভাব্য পরিমাণের হিসাবটি ছিল বেশ নিচুগ্রামে। আর সেই কারণেই অপরিকল্পিত খরচের এক টালমাটাল সময়ে সরকারের মুখরক্ষা সম্ভব হয়েছিল। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন বিচার করলে মনে হয়, আগামী বছরের বাজেটে করসংক্রান্ত রাজস্বের বৃদ্ধি নিচুগ্রামেই দেখানো হবে।
কর বা রাজস্বনীতির দিক থেকে দেখলে বোঝা যায়, কর্পোরেশন ট্যাক্সের হার এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক মাপকাঠির কাছাকাছি রয়েছে।যেখানে বিপুলায়তন আয়ের ক্ষেত্রে আয়করের হার বাড়িয়ে রাখা হয়েছে । তুল্যমূল্য বিচার করলে দেখা যায়, যেখানে যেটি থাকার কথা, ঠিক সেখানেই সেটি রয়েছে। কিন্তু ‘ক্যাপিটাল গেন্স ট্যাক্স’-এর হারে কয়েক গুণ বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।জিএসটি-র ক্ষেত্রেও তা-ই রয়েছে। পাশাপাশি, শুল্কের হার বাড়ানো হয়েছে। এ থেকে এমন মনে হতে পারে যে, এই সমস্ত বিষয় আগামী বাজেটে এবং জিএসটি কাউন্সিলের আগামী অধিবেশনে আলোচিত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। যদি তা না হয়, তা হলে কাজটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে এবং কর বা রাজস্বের হারের দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন বা তাকে কমিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
ইতিমধ্যে বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ যে যথেষ্ট বেশি, তা-ও লক্ষ করা গিয়েছে। অতিমারির আগে ২০০৯-’১০ সালের অর্থসঙ্কটের বছরের পরিসংখ্যান ৬.৫ শতাংশকে তা প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে। এখনপ্রতিরক্ষা, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার মতো খরচের বড় জায়গাগুলিকে মাথায় রেখে বিষয়টি কী ভাবে সামলানো যাবে, তা এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সত্যি বলতে, ভারতের বাজেট তার সরকারের উপরে আগত দাবিদাওয়াগুলির তুলনায় যথেষ্ট কম। সুতরাং কোভিড-কালে বেড়ে যাওয়া ভর্তুকি আর ‘ডোল’ (বিনামূল্যে শস্য সরবরাহের মতো) বাবদে খরচ কমিয়ে সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হয় না। জিডিপি-র ৬ শতাংশ কম হারে ঘাটতি রাখা দরকার। যদিও এই হারও যথেষ্ট বেশি।অন্তত বেড়ে যাওয়া সরকারি ঋণের সাপেক্ষে তো বটেই। এর সঙ্গে অতিরিক্ত পদক্ষেপ হিসেবে নতুন রাজস্ব নির্ধারণ, সম্ভব হলে জিএসটি-র গড় হারের বৃদ্ধি ঘটানো এবং একই সঙ্গে বিভিন্ন রাজস্বকে একটি খাতে নিয়ে আসার মতো কাজও করতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy