Advertisement
E-Paper

স্বাধীনতার নব্বই দিনের মাথায় ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারই বঙ্গবন্ধুর বিরল রাজনৈতিক সাফল্য

১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর শহিদ সোহরাওয়ার্দির মৃত্যুবার্ষিকীতে আওয়ামি লিগের জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ইস্ট পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলা বাদ দিয়ে আমাদের স্বাধীন দেশটির নাম হবে বাংলাদেশ।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জনতার সমুদ্রে বঙ্গবন্ধু অসম্প্রদায়িক এক রাষ্ট্রের রূপরেখা ও মুক্তির ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ‘‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’’

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জনতার সমুদ্রে বঙ্গবন্ধু অসম্প্রদায়িক এক রাষ্ট্রের রূপরেখা ও মুক্তির ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ‘‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’’ গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

শামীম রেজ়া

শামীম রেজ়া

শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২২ ১০:০২
Share
Save

ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আওয়ামি লিগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমেদের প্রথম দেখা। ৪ এপ্রিল, ১৯৭১। ইন্দিরা তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, ‘‘হাউ ইজ শেখ মুজিব? ইজ হি অল রাইট?’’ কেমন আছেন শেখ মুজিব? তিনি ঠিক আছেন তো? মুজিব অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতার নায়ক শেখ মুজিবুর রহমান। জবাবে তাজউদ্দিন বললেন, ‘‘বঙ্গবন্ধু আমাদের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। তাঁর নির্দেশে আপনার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছি। ২৫ মার্চের পর মুজিবভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। আমাদের অস্ত্র ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। শরণার্থীদের জন্য আশ্রয় ও খাদ্য দরকার। ভারতের সর্বাত্মক সাহায্য চাই।’’ ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার স্টাডি রুমের এই কথোপকথনই আসলে একটি দেশের জন্মকথার সূচনালগ্ন।

স্বাধীন বাংলাদেশ। ১৯৭১ থেকে ২০২২— অর্ধশতাব্দীও পার। কিন্তু সূচনালগ্নের সেই ইতিহাস চিরস্মরণীয়।

বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের সহযোগী ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলামের জবানি থেকে জানতে পারি, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াল রাতের আগে বঙ্গবন্ধুকে আত্মগোপনের কথা বলায় মুজিবুর বলেছিলেন, “আমাকে নিয়ে তোরা কোথায় রাখবি? বাংলাদেশে আত্মগোপন সম্ভব নয়, আমার হয়তো মৃত্যু হবে। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। বাড়ি ছেড়ে গেলে পাকিস্তানি হানাদাররা আমার সকল লোককে হত্যা করবে। আমার জন্য জনগণের জীবন যাক আমি চাই না।” ১৯৭১ সালের এই ২৫ মার্চ কিন্তু এক দিনে আসেনি।

১৯৫৫ সালে ২১ দফা দাবিতে স্বায়ত্বশাসনের জন্য আন্দোলন শুরু করেন মুজিব।

১৯৫৫ সালে ২১ দফা দাবিতে স্বায়ত্বশাসনের জন্য আন্দোলন শুরু করেন মুজিব। ছবি আর্কাইভ থেকে।

১৯৪৮ সালেই শহিদ সোহরাওয়ার্দির সঙ্গে মুসলিম লিগ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মুজিব। এর পর তিনি দিনে দিনে নিজেকে তৈরি করেছেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মুজিব গ্রেফতার হন। তাঁকে জেলে পাঠানো হয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে— এর প্রতিবাদে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর জেলে এক টানা ১৭ দিন অনশন করেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেল থেকে তিনি মুক্তি পান।

এক বছর পরই পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামি মুসলিম লিগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ২৩৭টি আসনের মধ্যে ২২৩টি আসন লাভ করে ওই দল। বঙ্গবন্ধু মাত্র ৩৪ বছর বয়সে প্রাদেশিক সরকারের কৃষি ও বনমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। মাত্র ১৫ দিন পর মন্ত্রিসভা বাতিল করে তাকে গ্রেফতার করে পাকিস্তান সরকার। পরের বছর ২১ দফা দাবিতে স্বায়ত্বশাসনের জন্য আন্দোলন শুরু করেন মুজিব। এর পর ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং ১৯৬৯ গণঅভ্যুত্থানে মুক্তির পথরেখা তৈরি হয়।

মুজিব উপলব্ধি করেন, গণ অসন্তোষ নিরসনে পূর্ব বাংলায় আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের কোনও বিকল্প নেই। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর শহিদ সোহরাওয়ার্দির মৃত্যুবার্ষিকীতে আওয়ামি লিগের জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ইস্ট পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলা বাদ দিয়ে আমাদের স্বাধীন দেশটির নাম হবে বাংলাদেশ। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭০ সালের ৭ জুন রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামি লিগকে নির্বাচিত করার জন্য আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু। ওই বছরেই ১২ নভেম্বর বরিশালের ভোলায়, গোর্কিতে (বন্যায়) ১০ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের উদাসীনতার নিন্দা জানান এবং বিশ্ববাসীর কাছে সাহায্য চান তিনি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ৩০৫টি আসন লাভ করে মুজিবের আওয়ামি লিগ।

’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিলেন অগুণতি যোদ্ধা।

’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিলেন অগুণতি যোদ্ধা। ছবি আর্কাইভ থেকে।

জেল জীবন আর আন্দোলনই যে নেতার নিয়তি, তিনি ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্সের জনসভায় জনপ্রতিনিধিদের শপথগ্রহণ পরিচালনা করেন। পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানে সর্বাধিক আসন পান। জাতীয় পরিষদে কোয়ালিশন সরকার গঠন করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। বঙ্গবন্ধুকে পার্লামেন্টারি দলের নেতা ঘোষণা করেন তিনি। কিন্তু ঢাকায় ভুট্টো-মুজিব আলোচনা ব্যর্থ হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহ্বান করে তা ভেঙে দেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে ৩ মার্চ হরতাল পালিত হয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জনতার সমুদ্রে বঙ্গবন্ধু অসম্প্রদায়িক এক রাষ্ট্রের রূপরেখা ও মুক্তির ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ‘‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’’

৭ থেকে ২৫ মার্চ প্রকৃত অর্থেই বঙ্গবন্ধু দেশ পরিচালনা করেন। ২৪ মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টো আলোচনা হয়। এবং ২৫ মার্চ আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের নির্দেশনা দিয়ে আত্মগোপনে যেতে বলেন তাজউদ্দিন-সহ তাঁর পরিষদবর্গকে। বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়ির স্টাডিতে তাজউদ্দিন উত্তেজিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “মুজিব ভাই, যুদ্ধ তো চাইনি। ওরা আমাদের অস্ত্রের মুখে ঠেলে দিল। অস্ত্র পাব কোথায়?” প্রত্যক্ষদর্শী ব্যারিস্টার আমিরের কথায়, ‘‘বছরের পর বছর জেলজুলুমে কখনও বঙ্গবন্ধুকে বিমর্ষ চেহারায় দেখিনি। সে বার দেখলাম। ইতস্তত পায়চারি করছেন তিনি। তাজউদ্দিনভাই তাঁকে ধরে চেয়ারে বসালেন। আবার উত্তেজিত ভঙ্গিতে বললেন, পাব কোথায় বলুন, মুজিব ভাই?’’ স্তব্ধতা নেমে আসে ছোট্ট স্টাডিতে। কিছু ক্ষণ পর বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘‘দেখ অস্ত্র কোথায় পাবি জানি না, তবে মানুষ যদি আমাদের ভালবাসে, বিশ্বাস করে, তবে স্বাধীনতা হবে, না হলে কোনও অস্ত্র দিয়েই স্বাধীনতা হবে না।” সত্যিই সাড়ে সাত কোটি বাঙালি তাঁকে ভালবেসেছিল।

তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি আর্কাইভ থেকে।

স্বাধীনতার ঠিক ৫১ বছর পরে আমরা ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখতে পাই, ১৯৪৫ সালে জার্মানিতে ঢুকেছিল মিত্রবাহিনী। ছিল ১৯৫৫ পর্যন্ত। ঘাঁটি গাড়ে কয়েক লাখ মার্কিন, ব্রিটিশ ও রুশ সৈন্য। এখনও সেখানে আছে ৫টি মার্কিন সেনানিবাস, সাড়ে ৩৮ হাজার সৈন্য। পাক্কা ৫০ বছর পূর্ব জার্মানিতে ছিল রুশ সেনা। পোল্যান্ডে ৪৮ বছর। হাঙ্গেরিতে ৪৬। জাপানে মার্কিন ঘাঁটি আছে এখনও। স্বাধীনতার নব্বই দিনের মাথায় ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের ঘটনা বিরল রাজনৈতিক সাফল্য বঙ্গবন্ধুর। শক্তিশালী রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায়ে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের ঘটনা একটা প্রধান অনুঘটকের কাজ করেছে। স্বাধীনতার অন্যতম প্রতীক বিদেশি সৈন্যমুক্ত দেশ।

১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন (ন্যাম) হয়। সেখানে বাদশা ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ’র সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের মুসলিমদের পবিত্র কাবা শরিফে নমাজ আদায়ের জন্য ফয়সালকে অনুমতি দিতে অনুরোধ করেন তিনি। তখন ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে মক্কা যেতে হত। ফয়সাল পাল্টা বঙ্গবন্ধুকে জানান, দেশের নাম ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ রাখতে। তবেই তিনি স্বীকৃতি দেবেন। এ ছাড়া বিনাশর্তে যুদ্ধবন্দিদের মুক্তিও দিতে বললেন ফয়সাল। বঙ্গবন্ধু তখন বলেছিলেন, ‘‘এক্সেলেন্সি ইউনাইটেড কিংডম অব সৌদি আরাবিয়া নাম বাদ দিয়ে আপনি যদি ইসলামি কিংডম অব সৌদি আরাবিয়া রাখেন তবেই আমাদের পক্ষে নামবদল সম্ভব। আমার দেশে এক কোটি অন্য ধর্মের মানুষ আছেন। যাঁরা প্রত্যক্ষ ভাবে যুদ্ধ করেছেন। তাঁদের সঙ্গে বেইমানি করা সম্ভব নয়।’’ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরের দিন যদিও সৌদি আরব ওই স্বীকৃতি দেয়।

এমন এক জন অসাম্প্রদায়িক নেতার কারণেই আমরা নতুন প্রজন্ম ভাষার নামে একটি দেশ পেয়েছি। নব্য-উপনিবেশ থেকে মুক্তি পেয়েছি। স্বপ্ন দেখছি নতুন পৃথিবীতে মুক্তবুদ্ধি চর্চার।

তথ্যসূত্র:

ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম: মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি
বদরুদ্দীন উমর: ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ: কতিপয় দলিল
জামিল বিন সিদ্দিক: মুখোমুখি বঙ্গবন্ধু
এটিএম শামসুদ্দিন: পাকিস্তান যথা ভাঙল
লে. জেনারেল জে এফ আর জেকব: সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা একটি জাতির জন্ম
মিজানুর রহমান খান: মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড
আবদুল্লাহ জাহিদ: বিশ্বসংবাদপত্রে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা

(লেখক ঢাকার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক। মতামত নিজস্ব)

Bijoy Dibos in Bangladesh Bangladesh Sheikh Mujibur Rahman Indira Gandhi India

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

ক্যানসেল করতে পারবেন আপনার সুবিধামতো

Best Value
প্রতি বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
প্রতি মাসে

৪২৯

১৬৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।