Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
polyamory

একই অঙ্গে বহুপ্রেম! না হয় মেনেই নিক সমাজ

সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে না ঠকিয়ে একই সঙ্গে একাধিক প্রেমে অংশ নেওয়া তাঁদের চোখে আদৌ অপরাধ নয়। অনৈতিক, অস্বাভাবিকও নয়।

প্রতীকী ছবি

সুস্নাত চৌধুরী
সুস্নাত চৌধুরী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০২১ ১৫:১০
Share: Save:

এক সন্তানের মা। সব ভালবাসা উজাড় করে দেন ছোট্ট শিশুটির প্রতি। ধরা যাক, তিনি ফের সন্তানসম্ভবা হলেন। ভাই কিংবা বোন আসবে, শিশুটিকে বোঝানোর ভার নিলেন আত্মীয়রা। আর সদ্যোজাতকে সঙ্গে নিয়ে মা অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরনো মাত্রই সেই অবোধ অগ্রজের মনে জন্ম নিল অজানা আশঙ্কা— তা হলে কি বাবা-মা এ বার আমাকে কম ভালবাসবেন?

শিশুমনে তৈরি হওয়া ভালবাসা হারানোর এই ভয় যে আগাগোড়া অমূলক, তা আমরা বড়রা সহজেই বুঝি। দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের পর প্রথম সন্তানের উপর থেকে বাবা-মায়ের স্নেহ উবে তো যায়ই না, বরং দুই সন্তানই হয়ে ওঠে তাঁদের নয়নের মণি। কিন্তু অগ্রজ শিশুটি শুরুতে চট করে বুঝতে চায় না সেসব। এই যে স্নেহের পাত্র এক থেকে একাধিক হয়ে গেলেও আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি ভালবাসার বিভাজন ঠেকিয়ে রাখতে পারে, প্রেমের পাত্রের প্রসঙ্গ এলে সেই পাটিগণিত কি বদলে যায়? তা না হলে এক জন মানুষ কেন ঘোষিত ভাবে একই সঙ্গে একাধিক মানুষের প্রেমে পড়তে পারেন না? কেন বড়দের ভাবনাও হয়ে পড়ে ওই অবোধ শিশুটির মতো? দ্বিতীয় জনের সঙ্গে প্রেম শুরু করলে কেন তৎক্ষণাৎ প্রথম জনকে ‘এক্স’ করে দিতে হয়? একজনের প্রতি প্রেম দেখে কেন তীব্র ঈর্ষায় জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যান অপরজন? আর একই সঙ্গে দুই বা ততোধিক মানুষকে ভালবাসতে গেলে সমাজ কেন সেই প্রেমকে ‘অবৈধ’ বলে দেগে দেয়?

আমাদের ‘সভ্য’ সমাজের চলতি চিন্তাভাবনার প্রেক্ষিতে এ প্রশ্ন ঘোর অসঙ্গত। মনে হতে পারে, এ সব কথায় প্রশ্রয় দিলে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে এতদিনের একগামিতা লালিত, ‘মনোগ্যামি’ পালিত সাধের সভ্যতা। কিন্তু সত্যিই কি তাই? এইখানেই আজ বার বার টোকা দিতে চাইছেন আবিশ্ব ছড়িয়ে থাকা ক্ষুদ্র এক শ্রেণির মানুষজন। সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে না ঠকিয়ে একই সঙ্গে একাধিক প্রেমে অংশ নেওয়া তাঁদের চোখে আদৌ অপরাধ নয়। অনৈতিক বা অস্বাভাবিকও নয়। তাঁদের এই অবস্থান ও অভ্যাসের নাম ‘পলিঅ্যামোরি’।

লন্ডনের রাস্তায় বহুপ্রেমীদের মিছিল।

লন্ডনের রাস্তায় বহুপ্রেমীদের মিছিল। ছবি: উইকিপিডিয়া

মোটে তিন দশকের পুরনো ইংরাজি শব্দটি খটমট। বাংলায় এর অর্থ করা যেতে পারে ‘বহুপ্রেম’। কিন্তু ‘বহুকাম’ নয়। জীবনযাপনে এই পলিঅ্যামোরি অভ্যাসকারীদের ক্ষেত্রে যৌনতা আবশ্যক হয়ে ওঠে না। অর্থাৎ, এক জন ‘পলিঅ্যামারাস’ বা ‘বহুপ্রেমী’ ব্যক্তি তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হতে পারেন, না-ও পারেন। যদি লিপ্ত হন, তা উভয়ের সম্মতিক্রমেই হবেন। আর সে কথা তাঁর বাকি পার্টনারদের কাছেও গোপন করার দরকার পড়বে না। কারণ, তাঁদের ভালবাসায় প্রধানতম পূর্বশর্ত হল মনের যোগ। পারস্পরিক সততা, সম্মান, দায়িত্ববোধ এবং বিশ্বাস বজায় রেখে তবেই যৌন সম্পর্কে সামিল হওয়ার কথা বলেন তাঁরা।

ভালবাসার এই রূপটি আইনের চোখে এখনও স্বীকৃত নয়। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে মানুষের প্রেম কি এমনই হওয়ার কথা ছিল না? পাখির পালকের মতো হালকা। মৃদু সুগন্ধীর মতো মসৃণ। যেখানে হাত বাড়ালে অন্য হাতের ছোঁয়া লাগে নিঃশর্তে। যেখানে চেপে বসে না অধিকারবোধের ফাঁস। প্রেমের দেওয়ালে ফাটল ধরায় না তেতো ঈর্ষা। সম্পর্কের বাঁধনে বজ্র আঁটুনি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। উল্টে তা আপনিই আগলে রাখে স্থিতিস্থাপক আদরে। সেই ভালবাসার মধ্যে দেনাপাওনা নেই। সে সম্পর্কে চোখের বালি হয়ে ওঠার ভয় নেই। সে প্রেমের পরিণতিতে গৃহদাহের আতঙ্ক নেই।

পুরোদস্তুর একটি প্রেমে থেকেও অন্য কারও প্রতি আসক্ত হয়ে পড়লে অনেককেই গ্রাস করে দ্বিধা। বিবাহিত হলে সে দ্বিধা হয়তো আরও খানিক বাড়ে। আর মহিলা হলে তো কথাই নেই! নীতি-নৈতিকতার জাল চারদিক থেকে ঘিরে ধরতে থাকে। হয় ‘কে, কী বলবে’-র আশঙ্কা লিউকোপ্লাস্ট হয়ে সেঁটে যায় মুখে। নয়তো কলঙ্কিনী রাধার শিরোপা চিরতরে চরিত্রের জাঙ্ক জুয়েলারি হয়ে ওঠে। কিন্তু ভালবাসার উথালপাতাল বাতাস কি আর মনজানালায় ধাক্কা দেওয়ার আগে কখনও নীতিপুলিশের অনুমতি নেয়? দ্বিধার পরিমাণ আরও বাড়ে যখন পূর্বতন প্রেমিক বা প্রেমিকাটির প্রতিও প্রেমের অনুভূতি অটুট থাকে। কী করবে তখন সে? কার দিকে বাড়িয়ে দেবে হাত? টস করবে? না কি খতিয়ে দেখবে আগামী জীবনের চাওয়াপাওয়ার সমীকরণগুলি? ঠিক এই সময়েই ভালবাসার মধ্যে প্রবেশ করে প্রতিযোগিতা। টক্কর। সিনেমার প্লট। পরিণতি যে দিকেই গড়াক, এর পর অন্তর থেকে কুরে কুরে খাওয়া আর আটকানো যায় না।

প্রেম কি এমনই হওয়ার কথা ছিল না? পাখির পালকের মতো হালকা। মৃদু সুগন্ধীর মতো মসৃণ।

প্রেম কি এমনই হওয়ার কথা ছিল না? পাখির পালকের মতো হালকা। মৃদু সুগন্ধীর মতো মসৃণ।

একই পুরুষের একাধিক স্ত্রী কিংবা একই মহিলার একাধিক স্বামী অতীতে খুব বিরল ছিল না। কিন্তু একে সর্বদা ‘বহুপ্রেম’ বলা যায় না। ‘পলিঅ্যামোরি’ আর ‘পলিঅ্যান্ড্রি’ এক জিনিস নয়। সহজ উদাহরণ হতে পারে দ্রৌপদী আর পঞ্চপাণ্ডবের সম্পর্ক। বহুপ্রেমের ক্ষেত্রে সঙ্গী বা সঙ্গিনীদের প্রতি পক্ষপাতহীনতা আবশ্যক। কিন্তু মহাভারতের উক্ত সম্পর্কে তা ছিল কি? মহাপ্রস্থানিক পর্বে দ্রৌপদীর মৃত্যুর দিকে তাকানো যেতে পারে। রাজশেখর বসুর অনুবাদে পাই— ‘পাণ্ডবগণ হিমালয় পার হয়ে বালুকার্ণব ও মেরুপর্বত দর্শন করে যোগযুক্ত হয়ে শীঘ্র চলতে লাগলেন। যেতে যেতে সহসা দ্রৌপদী যোগভ্রষ্ট হয়ে ভূপতিত হলেন। ভীম যুধিষ্ঠিরকে বললেন, দ্রুপদনন্দিনী কৃষ্ণা কোনও অধর্মাচারণ করেননি, তবে কেন ভূপতিত হলেন? যুধিষ্ঠির বললেন, ধনঞ্জয়ের উপর এঁর বিশেষ পক্ষপাত ছিল, এখন তারই ফল পেয়েছেন।’ বহুপ্রেমের সম্পর্কে পার্টনারের প্রতি এই পক্ষপাতের প্রশ্নই থাকে না। কারণ সেখানে সব ক’টি প্রেমই পৃথক ভাবে স্বাধীন, স্বতন্ত্র। অতএব, তুলনারহিতও।

শুধু বিলেত-আমেরিকা নয়, আমাদের দেশেও আজ এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা এই মতবাদে বিশ্বাস রাখেন। কলকাতা বা বেঙ্গালুরুর মতো শহরে তাঁরা স্বাধীন ভাবে বাঁচতে চাইছেন। চাইছেন, এক নয়, অনেককে ভালবাসার এই জীবন চুটিয়ে যাপন করতে। তাঁদের দিকে ছুড়ে দেওয়া বাঁকা চাউনি আর ছুটে আসা কটূক্তির পরিমাণ স্বাভাবিক কারণেই ঢের। নয়ের দশকে এই কলকাতায় ‘অন্য প্রেমের গান’ শুনিয়েছিলেন নচিকেতা চক্রবর্তী। সে গান শুরুতেই বলেছিল – ‘যদি ভালবাস কোনও এক জনকে, তবে নিশ্চয় বোলো আই লভ ইউ। যদি ভালবাস একাধিক জনকে, তবে দ্বিধাহীন হয়ে থাকো, নিজেকে ঠকিয়ো নাকো, চিৎকার করে বোলো বার বার – আই লভ ইউ, আই লভ ইউ, আই লভ ইউ!’

অন্য বিষয়গুলি:

polyamory Relationship digital essay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE