Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Shambhu Mitra

যে কথা কখনও হয়নি বলা আগে, জন্মদিনের চিঠি রক্তকরবীর রাজাকে

জানি আপনার মেধা, মননকে ছোঁয়ার ক্ষমতা আমার নেই। তবু আপনার কাজ আমাকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছে।

ছবি সৌজন্য: অর্পিতা ঘোষ

অর্পিতা ঘোষ
অর্পিতা ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০২১ ১০:১১
Share: Save:

শ্রী শম্ভু মিত্র সমীপেষু,

আমার প্রণাম নেবেন। আপনাকে কোনওদিন সামনাসামনি দেখার সৌভাগ্য হয়নি। আসলে একটা ছোট্ট মফস্সলে বড় হয়েছি তো। কলকাতা আমাদের কাছে দূরতর দ্বীপ ছিল। আমাদের ঐ ছোট্ট শহরে বছরে একবার পুজোর সময় যাত্রা হত। বাবার হাত ধরে নিয়মিত সেই যাত্রা দেখতে যেতাম।

কিন্তু দূর থেকে হলেও আপনাকে আমি জানি। প্রতিটি ছুটির দিনে বাবা আমাদের পুরনো রেকর্ড প্লেয়ারটায় রেকর্ড বাজাতো, কবিতার। বই পড়তে পড়তে কিংবা খেলতে খলতে সে সব কবিতা মনের অন্দরে ঢুকে পড়ত। বাবা বলতো, ‘‘শম্ভু মিত্রের কবিতা।’’ শম্ভু মিত্র কে? জানা ছিল না। তবু শুনতে শুনতে কী যেন হত একটা। সম্যক বোঝাতে পারব না। আর নাটক শুনতাম, রেডিয়োতে। শুক্রবার রাত ৮টা, শনিবার দুপুর ৩টে আর রবিবার দুপুর আড়াইটে। তবে আপনার চেয়ে আপনার কন্যা শাঁওলী মিত্রের নাটক শুনেছি অনেক বেশি। শুক্র, শনি, রবি ছাড়াও বোরোলীনের সংসার, পি থ্রি, শনিবারের বারবেলা— এরকম কত। আর সেই সময়ে বেশিরভাগ নাটকই শেষ হত ‘এবং শাঁওলী মিত্র’ বলে। শুনতাম আর ভাবতাম, কোন মন্ত্রবলে এঁরা আমাদের রেডিয়োর সামনে থেকে নড়তে দেন না। ইনিই যে সেই শম্ভু মিত্রের কন্যা, তখন অবশ্য তা জানা ছিল না।

স্কুল শেষ করে কলকাতায় পড়তে এলাম, ইলেভেন। স্কটিশ চার্চ কলেজ। হস্টেলে থাকতাম। নাটক কী, তখনও জানি না। একদিন হস্টেলের এক দিদি এসে বললেন, ‘‘রবিবার অ্যাকাডেমিতে নাটক দেখতে যাবি?’’ সকাল ১০টায় নাটক। তার ভাই নাকি অতি কষ্টে টিকিট জোগাড় করেছে। নাটকের নাম ‘নাথবতী অনাথবৎ’। শাঁওলী মিত্রের নাটক— সেই শাঁওলী মিত্র। উত্তেজনায় শনিবার রাতে ঘুমোতে পারিনি। নাটক দেখার পর কী হয়েছিল বলতে পারব না, শুধু মনে হয়েছিল, ‘নাটক’ এইরকমই হয়!

আপনি কি সেদিন ছিলেন অ্যাকাডেমিতে? সাজঘরে? জানি না। তবে সেই শুরু। শাঁওলী মিত্রর মধ্য দিয়ে বাংলা থিয়েটারকে চেনা।

আপনি কি সেদিন ছিলেন অ্যাকাডেমিতে? সাজঘরে? জানি না। তবে সেই শুরু। শাঁওলী মিত্রর মধ্য দিয়ে বাংলা থিয়েটারকে চেনা।

আপনি কি সেদিন ছিলেন অ্যাকাডেমিতে? সাজঘরে? জানি না। তবে সেই শুরু। শাঁওলী মিত্রর মধ্য দিয়ে বাংলা থিয়েটারকে চেনা। ছবি সৌজন্য: অর্পিতা ঘোষ

কালক্রমে একটি ছোট থিয়েটার দল ঘুরে ২০০০ সালে শাঁওলী মিত্রের পঞ্চম বৈদিকে এসে পৌঁছলাম। তখন আপনি আর নেই। কিন্তু সত্যিই কি নেই? পঞ্চম বৈদিকে শাঁওলীদির সংস্পর্শে এসে প্রতিনিয়ত আপনাকে যে আমি অনুভব করেছি। এত দিন ধরে থিয়েটারের আনাচেকানাচে আপনাদের সম্পর্কে যে সব কথা শুনেছিলাম, সব মিথ্যে মনে হতে লাগল। আপনার লেখা সব বই পড়ে ফেললাম। মনে হত লাগল, এই মানুষটিকে আমরা বোধহয় কখনও ছুঁতে পারিনি। আর সেই ছুঁতে না পারার বেদনাই কি থিয়েটারের অন্দরে এত কুৎসার জন্ম দিয়েছে? কে জানে! আমি আমার এই স্বল্প বুদ্ধি দিয়ে শুধু আপনাকে বোঝার চেষ্টা করেছি। আজও করে চলেছি। একটা কথা বলি, জানি যে আপনার মেধা, মননকে ছোঁয়ার ক্ষমতা আমার নেই। তবু আপনার কাজ আমাকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছে। এটা পড়ে নিশ্চয়ই মৃদু মৃদু হাসছেন। ভাবছেন, আপনার কাজ তো আমি দেখিইনি। তাহলে প্রভাবিত হলাম কী করে? আমার কেমন জানি মনে হয়, পাশে বা কাছে থাকলেই যে সবটুকু জানা বা বোঝা যায়, তা বোধহয় নয়। যেমন আমি শাঁওলীদির কাছ থেকে আপনার নাট্যনির্মাণের কথা শুনে প্রভাবিত হয়েছি বারংবার।

এই সূত্রে একটা গল্প বলি। তখন সদ্য পঞ্চম বৈদিকে এসেছি। ২০০০ সাল। একদিন শাঁওলীদি রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’ নাটকটি পাঠ করলেন এবং আপনার উপস্থাপনার বৃত্তান্ত বললেন। সেখানে ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে’ গানটি আপনি নাটকের বিভিন্ন মুহূর্তে লয় বদলে বদলে কী ভাবে ব্যবহার করেছেন, সেটিও বললেন। আমি চমকিত হয়েছিলাম। আর আমার অবচেতনে তা অদ্ভুত ভাবে প্রবেশ করে গিয়েছিল। ২০০৬ সালে আমি যখন ‘পশুখামার’ করছি, আমি ঠিক একই ভাবে নাটকটির মূল গানটি বিভিন্ন নাট্যমুহূর্তে ব্যবহার করেছিলাম। এমন আরও অনেক উদাহরণ দিতে পারি।

আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করার খুব ইচ্ছা ছিল। করি?

একটা কথা বলি, জানি যে আপনার মেধা, মননকে ছোঁয়ার ক্ষমতা আমার নেই। তবু আপনার কাজ আমাকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছে।

একটা কথা বলি, জানি যে আপনার মেধা, মননকে ছোঁয়ার ক্ষমতা আমার নেই। তবু আপনার কাজ আমাকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছে। ছবি সৌজন্য: অর্পিতা ঘোষ

আপনার বহু লেখায় নাট্যচর্চার ভবিষ্যৎ ও তার সম্ভাব্য স্খলন নিয়ে অনেক কথা আছে, যা আজকের দিনের নাট্যচর্চার ধারার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। আপনি কি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ছিলেন? নাকি তখন থেকেই এই স্খলনের বীজ রোপণ করা হয়ে গিয়েছিল! আর এই সম্ভাব্য স্খলনই কি আপনাকে মঞ্চ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল? থিয়েটার থেকে আপনি কোনওদিনই সরে যাননি। সে কথা আপনার বিভিন্ন সাক্ষাৎকার দেখে বা পড়ে, শাঁওলীদির মুখে শুনে বুঝেছি। কিন্তু মঞ্চে আপনাকে আর পেলাম না। আপনার নির্দেশনায় যে সমস্ত নাটক হয়েছে, সেগুলি দেখলেই আপনার সমাজচেতনার একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। কিন্তু আপনি কখনও সোচ্চারে রাজনৈতিক বয়ান দেননি। নিজেকে নিঃশব্দে আপনি সরিয়ে রেখেছিলেন সমস্ত কলুষতা থেকে দূরে।

আপনি যে সৎ নাট্যের স্বপ্ন দেখেছেন, যা আজকের নাট্যচর্চায় ইউটোপিয়া বলে বোধ হয়। অথচ আপনি তো পেরেছিলেন! সন্মার্গের সপর্যা যে সম্ভব, তা তো আপনি আপনার কাজ, আপনার যাপন দিয়ে প্রমাণ করে গিয়েছেন। অল্প দিনের জন্য হলেও বেশকিছু মানুষ তো এই সৎনাট্যের সহযোগী হয়েছিলেন। কিন্তু কেন তা ধরে রাখা গেল না? কেন সেই মানুষগুলি পরবর্তী সময়ে অন্যরকম হয়ে গেলেন? এ কি আমাদের এই গুলিয়ে যাওয়া সমাজের কারণে? নাকি রাজনৈতিক চেতনার অভাবে? এই প্রশ্নগুলো আমাকে সব সময় তাড়িয়ে বেড়ায়। মনে হয়, আপনাকে জিজ্ঞাসা করি। কিন্তু সে উপায় আর নেই। সেই কবে নিঃশব্দে কন্যা শাঁওলী মিত্রের কাছে ‘ইচ্ছাপত্র’ রেখে মৃত্যুর পরে ঠুনকো শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের অবকাশ না দিয়েই আপনি চলে গেলেন। অনেকে বলেন ‘অভিমানে’। আমি বলি ‘সম্ভ্রমে’। শম্ভু মিত্রর গমন তো সম্ভ্রমযাত্রা। জানেন তো, আজ আমরা এই সম্ভ্রম শব্দটি আর খুঁজে পাই না। না জীবনে, না থিয়েটারে। আজ আপনাকে বাংলা থিয়েটারের বড় প্রয়োজন। আসবেন? আর একবার? অপেক্ষায় রইলাম।

ইতি

বাংলা থিয়েটারের নগণ্য শিল্পী

(লেখক নাট্যনির্দেশক ও সাংসদ। মতামত ব্যক্তিগতছবি সৌজন্য: লেখক)

অন্য বিষয়গুলি:

Shambhu Mitra arpita ghosh digital essay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy