ভারতের বাজার কতটা ‘মুক্ত’? প্রতীকী ছবি।
গত সপ্তাহে এই কলামে আমরা দেখেছিলাম, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতীয় অর্থনীতি বেশ উজ্জ্বল এক অবস্থানে রয়েছে। ব্রিটেনের মতো দেশকে পিছনে ফেলে ভারত এখন বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তর অর্থনীতির দেশ। বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে এক দশকের মধ্যে ভারত জার্মানি (এই মুহূর্তে ভারতের চেয়ে ১৬ শতাংশ বৃহত্তর) এবং জাপান (ভারতের থেকে ২৪ শতাংশ এগিয়ে) টপকে যেতে পারবে বলেই আশা করা যায়। এই গতিছন্দ ধরে রাখতে হলে ভারতকে এই বৃদ্ধির পর্বে যে কোনও বড় রকমের ভুল সামলে চলতে হবে। এমন অবস্থায় একটি জরুরি প্রশ্ন থেকেই যায়— প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা-সহ এ দেশের অন্যান্য চরিত্রবৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে কতখানি মানানসই? প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে বসলে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে— এমন একটি সময়ে এই প্রশ্ন উঠছে, যখন কি না তথাকথিত ‘ব্যক্তিগত তথ্যসুরক্ষা বিল’-এর সাম্প্রতিকতম খসড়া রাষ্ট্রের হাতে কার্যত যেমন ইচ্ছে নিয়ম প্রণয়নের অধিকার দেওয়ার চেষ্টা করছে। এমতাবস্থায় কি ভারতীয় অর্থনীতির চেহারা বেশি আকর্ষণীয় বলে মনে হবে? যখন দেশের আদালতগুলি আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার বিষয়গুলি কোণঠাসা করে ফেলার ব্যাপারে রীতিমতো কুখ্যাত, তখন বিশ্ববাণিজ্যের মানচিত্রে ভারতের নাম ঠিক কতটা গুরুত্ব বহন করছে? সেই সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে দেশের বণিক গোষ্ঠীপতিদের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতার বিষয়টিও ভেবে দেখার মতো। কারণ, এমন ক্ষেত্রে নিয়ম ভাঙার বিষয়টি সব থেকে বেশি মাত্রায় লক্ষ্য করা যায়। সেই সঙ্গে এমন প্রশ্নও থেকে যায় যে, রাষ্ট্র হিসেবে ভারত কিছু একতরফা সিদ্ধান্তে নিতে অভ্যস্ত। আদালতে কোনও মামলা দায়ের না করেও মানুষকে বছরের পর বছর জেলে আটকে রাখার বিষয়টি এমন সিদ্ধান্তের উপযুক্ত উদাহরণ। এই সব প্রশ্নকে কেউ অবান্তর বলে উড়িয়ে দিতেই পারেন। তাঁরা বলতেই পারেন, একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে চিন দশকের পর দশক অর্থনীতির দ্রুত বৃদ্ধিকে সম্ভব করে তুলতে পেরেছে। যেখানে নাগরিকদের দূরবর্তী সব কারাগারে আটকে রাখা হয় এবং বাণিজ্যকেও হতশ্রী অবস্থায় ফেলে রাখা হয়। এটি এমন একটি সময়, যখন বিশ্বে মাঝারি মাপের ক্ষমতাবানেরাও উদারপন্থী গণতন্ত্রের মূল্যবোধগুলিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, ইউরোপীয় জ্ঞানদীপ্তির সময় থেকে জন্ম নেওয়া কিছু গোলমেলে বিষয়ের উত্তরাধিকার হিসেবে সেই সব শক্তি জাতীয়তাবাদের জয়গান গায় এবং সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের সংকীর্ণ রাজনীতির (‘এশীয় মূল্যবোধ’-এর বিষয়টি এর সব থেকে উপযুক্ত উদাহরণ) ধ্বজা তুলে ধরে। বিশ্বায়নের এক বিশেষ পর্বে মুক্তবাজার অর্থনীতির পক্ষে জোরদার সওয়াল করা দেশগুলি যখন অন্তর্মুখী রাজনীতির দ্বারা চালিত হয়, তখন এমন সব প্রশ্নকে অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হতেই পারে।
সুতরাং, সরকার ও বাণিজ্যের মধ্যে সম্পর্ক ঠিক কেমন হবে, তা ভারতকেই ঠিক করতে হবে। এর সঙ্গে রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্কের যোগসূত্রও রয়েছে। সেই সঙ্গে এই প্রশ্নও অনিবার্য ভাবে ওঠে যে, সিঙ্গাপুর ও দুবাইয়ের মতো দেশে বিপুলসংখ্যক ধনী ভারতীয় কেন চলে যাচ্ছেন, কেন নিজেদের দেশ তাঁদের আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে না। এই সব প্রশ্নের উত্তরও ভারতকেই খুঁজতে হবে। এর উত্তর অবশ্যই এমন নয় যে, সেই সব দেশে দূষণমুক্ত পরিবেশ বা উন্নততর স্কুল বা হাসপাতাল রয়েছে বলে তাঁরা সেখানে গিয়ে বাস করছেন। সম্ভবত সেই সব দেশে আইনকানুনের শিথিলতার আশ্বাসও এই অভিবাসনের পিছনে কাজ করছে।
এ বিষয়ে মনস্থির করতে হলে ভারতকে একটি বিষয় মাথায় রাখতেই হবে— ভারত চিনের মতো একটি দেশ নয় যে, তার বিনিয়োগ সংক্রান্ত নীতির নমনীয়তা আর তার প্রয়োগগত অনিশ্চয়তাকে আন্তর্জাতিক বণিক সংস্থাগুলির সামনে নিয়ে আসে। তুলনা করলে দেখা যায়, এই সব আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীর প্রতিযোগী হিসাবে ভারতের নিজস্ব সংস্থাগুলি ক্রিয়াশীল রয়েছে। চিন একযোগে তার অভ্যন্তরীণ বাজারের আয়তন ও গতিশীলতা দিয়ে নিজেকে সেই সব সংস্থার সামনে উৎপাদন ব্যবস্থা পরিচালনার আদর্শ ভূমি হিসাবে তুলে ধরছে। বিনিয়োগের লোভনীয় পরিমণ্ডল হিসাবে উপস্থাপন করছে। সঠিক ভাবে বললে, অভ্যন্তরীণ বাজারের বিপুলায়তন সেখানে এক অতিরিক্ত আকর্ষণ হিসাবে কাজ করছে। দু’দশক আগেও চিন যেখানে ছিল, ভারত ঠিক তেমন অবস্থায় রয়েছে, এমন কথাও এ ক্ষেত্রে বলা যাবে না। সত্যি বলতে, ভারতকে এ বিষয়ে আরও অনেকখানি পথ হাঁটতে হবে এবং চিনের তুলনায় অনেক বেশি সক্ষম হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে।
এ কথাও সত্য যে, রাষ্ট্র তার নাগরিকদের সঙ্গে যে সম্পর্কসূত্র তৈরি করে, তা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে কাজ করে। মুখে এক আর কাজে অন্য রকম— এ ভাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চলা যায় না। শুল্কবিহীন অবাধ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে জাপানের সাফল্যের কথা সকলেই জানেন। এ কথাও জানা যে, আমেরিকা একতরফা নীতিনির্ধারণ করে বিশ্বের বাকি অংশকে জানাতে চায়, কে তার শর্তে বাণিজ্য করতে পারে আর কে পারে না। আমেরিকার তরফে রাশিয়ার বৈদেশিক অর্থসম্পদের উপরে হস্তক্ষেপের বিষয়টিকেও এই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে। বণিকরা এ কথাও জানেন যে, কোনও ভিন্দেশির পক্ষে জাপানের আদালতে সে দেশের কোনও ব্যক্তি বা সংস্থার সঙ্গে মামলা করে জেতা কতখানি কঠিন। তার নিজের স্বার্থ বিঘ্নিত হলে ইউরোপের দেশগুলিও যে অতি মাত্রায় রক্ষণশীল হয়ে ওঠে, তা-ও সকলেরই জানা।
অতীতের নীতিনির্ধারকদের দ্বিচারিতাকে সচেতন নজরে দেখলে বোঝা যায়, তাঁদের দৌলতে ভারতের জাতীয় আবেগের পালে বাতাস লেগেছে। তা সত্ত্বেও এ কথা মানতে হবে যে, ভারতকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সে ঠিক কেমন দেশ হিসেবে বিশ্বের সামনে নিজেকে তুলে ধরতে চায়। নমনীয় বাজার অর্থনীতির কারণে, না কি একুশে আইনের এক দেশ হিসাবে, যে ব্যক্তি ও বণিক সংস্থাগুলিকে তার খেয়ালখুশি মতো নিয়ন্ত্রণ করতে ইচ্ছুক। কারণ, এ দেশের আয়তন এবং আর্থিক গতিশীলতা আন্তর্জাতিক চাপ থেকে তাদের সুরক্ষা দিতে পারে। প্রশ্ন এখানেই যে, ভারত কি ক্ষমতার খেলাই খেলতে চায়, না কি তার খেলায় খানিক মূল্যবোধের পরিচয়ও সে রাখতে চলেছে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy