সামাজিক পরিচিতির অজুহাতে কর্ণকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ না দিতেও পিছপা হননি অর্জুনের শিক্ষকেরা। ফাইল চিত্র।
শিক্ষক দ্রোণ ছাত্রদের লক্ষ্যভেদের পরীক্ষা নিতে গাছের উপরে কাঠের পাখি বসিয়ে ছাত্রদের বলছেন মনঃসংযোগ করতে। কেবলমাত্র অর্জুনই পেয়েছিলেন গুরুর প্রশংসা, কারণ তিনি পাখির মাথাটুকু বাদে আর কিছু দেখেননি। শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের এক আশ্চর্য পাঠ নিহিত এই আখ্যানে। পরীক্ষায় সফল, একমুখী, সংসারবিচ্ছিন্ন, কেরিয়ারিস্ট ছাত্রই এখানে গুরুর প্রিয়। তাঁকে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে দিতে প্রতিস্পর্ধী নিম্নবর্গীয় একলব্যকে পঙ্গু করে দিতে, সামাজিক পরিচিতির অজুহাতে কর্ণকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ না দিতেও পিছপা হননি অর্জুনের শিক্ষকেরা। কারণ, তাঁরাও জানেন যে, এই অর্জুনই পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে বন্দি করে এনে চরিতার্থ করবেন দ্রোণের প্রতিশোধস্পৃহা। যে কোনও উপায়ে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছনোই ছাত্রের অভীষ্ট, আর তাঁকে সেই সাফল্যে পৌঁছে দিয়ে স্বার্থসিদ্ধির রাস্তা খোঁজেন শিক্ষক— এই শিক্ষাব্যবস্থাকেই কি আমরা পরম্পরাগত আদর্শ বলে ভাবতে অভ্যস্ত হয়েছি?
এই স্বার্থসর্বস্ব, নম্বরমুখী, উচ্চবর্গকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক আগ্রাসন এখন সমস্ত স্তরে— একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের চিন্তাশীল ছাত্রছাত্রীদের উপর রাজনৈতিক আক্রমণে, কেন্দ্রের প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষানীতিতে সার্বিক ভাবে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ও ইতিহাসবিকৃতির আয়োজনে, শিক্ষক নিয়োগে বিপুল দুর্নীতিতে, শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ওঠা যৌন হেনস্থার অভিযোগে, দৃশ্যতই টুকে পরীক্ষা দিয়ে নম্বর বাড়িয়ে নেওয়ার প্রত্যাশায় ছাত্রসমাজের একাংশের অনলাইন পরীক্ষা চেয়ে আন্দোলনে, প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরেই জাতিবৈষম্যে। অথচ, ভারতীয় পরম্পরায় শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক এই একমুখী, স্বার্থকেন্দ্রিক দ্রোণাচার্য-অর্জুন মডেলে সীমাবদ্ধ থাকার কথা ছিল না।
শুধুমাত্র মহাভারতেই শিক্ষক-ছাত্র কত রকম মডেল আমরা পাই— গুরু আয়োদধৌম্যের আদেশে প্রাণপাত করতে চাওয়া আরুণি-উপমন্যু-বেদ থেকে গুরুপত্নী-গমনের দোষে অভিশপ্ত ইন্দ্র ও চন্দ্র; গুরু পরশুরামের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে না চেয়ে কীটদংশনের অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করেও পরিচয় গোপনের অপরাধে শাস্তি পাওয়া কর্ণ থেকে প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য ওই একই গুরুর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণকারী ভীষ্ম; নিজেরই শিষ্যদের নিদ্রারত সন্তানদের হত্যালীলায় যোগ দেওয়া কৃপাচার্য থেকে অন্যায় যুদ্ধে ছাত্রের মৃত্যু মেনে নিতে না পেরে আশৈশব সঙ্গী ভাই কৃষ্ণের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে প্রস্তুত বলরাম। শিক্ষকতা হতে পারে দ্বিমুখীও— রাজা নলের কাছে অশ্ববিদ্যা শিখে তাঁকে পাশাখেলার প্রশিক্ষণ দেন রাজা ঋতুপর্ণ।
যে শিক্ষাকে মানুষের অন্তর্নিহিত পূর্ণতার বিকাশ হিসাবে দেখেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ, চিন্তার মুক্তিতে যে শিক্ষা বিশ্বকে এক নীড়ে পরিণত করতে পারে রবীন্দ্রনাথের ভাবনায়, তাঁর নাটকে ‘অচলায়তন’ ভেঙে যে শিক্ষার মুক্তি ঘটাতেই আসেন গুরু, দ্রোণাচার্যের মতো বৃত্তিমুখী শিক্ষকরা তার মূল্য বুঝতে অপারগ। তাই তাঁর কাছে বকুনি খান যুধিষ্ঠির, যাঁর দৃষ্টি কখনওই তার সার্বিকতা হারায় না। আনৃশংস্য ও অনুক্রোশ (সার্বিক সমানুভূতি)-এ বিশ্বাসী যুধিষ্ঠির তাই ধর্মবকের সামনে এক ভাইকে বাঁচানোর সুযোগ পেলে অভীষ্টসিদ্ধির যন্ত্র হিসাবে ভীম বা অর্জুনের উপরে দৃষ্টি সীমাবদ্ধ রাখতে পারেন না, বেছে নেন মৃত বিমাতা মাদ্রীর স্মৃতিস্বরূপ নকুলকে; সশরীরে স্বর্গলাভের লক্ষ্যপূরণের শেষ ধাপে পৌঁছেও তাঁর নজর এড়ায় না গোটা পথ সঙ্গে আসা কুকুরটি।
প্রাচীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষক গৌতম বুদ্ধের শিক্ষাতেও এই ‘সম্যক দৃষ্টি’ গুরুত্বপূর্ণ— সেই সার্বিক দৃষ্টি জাগ্রত করেই তিনি গণিকা আম্রপালীকে শিখিয়েছেন রূপযৌবনের অনিত্যতা; স্বজন-হারানোর যন্ত্রণায় কাতর পটাচারা বা কিসাগৌতমীকে শিখিয়েছেন মৃত্যুর অমোঘতাকে স্বীকার করেও দুঃখনিবৃত্তির উপায়। আবার সেই সর্বজনীনতার যুক্তিতেই, নিজে বৌদ্ধ সঙ্ঘে নারীর প্রবেশাধিকারে অনাগ্রহী হয়েও শিষ্য আনন্দের যুক্তি মেনে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন ভিক্ষুণী-সঙ্ঘ। মহাপরিনির্বাণের ঠিক আগে, গুরুবাক্যে অন্ধ আনুগত্যের নির্দেশের বদলে আনন্দকে বুদ্ধ বলে গিয়েছেন শিক্ষার মূল মন্ত্র: ‘আত্মদীপো ভব’।
আত্মনির্ভর স্ব-শিক্ষা, স্বাধীন মুক্ত চিন্তার বিকাশ যে শিক্ষার ভিত্তি, এ কথা বার বার উঠে আসে ছান্দোগ্য উপনিষদ-এ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করে আসা পণ্ডিত পুত্র শ্বেতকেতুকে তাই হাতেকলমে একের পর এক পরীক্ষার মাধ্যমে আত্মব্রহ্মতত্ত্বের পাঠ দেন উদ্দালক আরুণি। আবার পিতৃপরিচয় না জানা দাসীপুত্র সত্যকাম জাবালকে সত্যনিষ্ঠার জন্য ব্রাহ্মণের স্বীকৃতি দিয়ে ব্রহ্মবিদ্যা-শিক্ষার অধিকার দেওয়ার পর গুরু হরীদ্রুমত গৌতম তাঁকে বার বার প্রেরণ করেন প্রকৃতির মাঝে। সেখানে ষাঁড়, আগুন, হংস, মদ্গু (জলচর পাখি)-র কাছে হয় তাঁর ব্রহ্মবিদ্যার পাঠ। এই দর্শনই বোধ হয় প্রতিফলিত সুনির্মল বসুর কবিতায়, বিশ্বজোড়া পাঠশালায় সবার ছাত্র হওয়ার স্বীকৃতিতে। জ্ঞানচর্চার সর্বজনীনতায় যে সামাজিক বিন্যাসকে উল্টে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল এমনকি প্রাচীন ভারতেও, তার প্রমাণ মেলে যখন মহাভারতের শান্তিপর্বে এক উদ্ধত ব্রাহ্মণকে মিথিলার ব্যাধের থেকে নিতে হয় বর্ণব্যবস্থাসম্মত অনৃশংসতার শিক্ষা, আবার বৌদ্ধ গ্রন্থ শার্দুলকর্ণাবদানম্-এ গর্বিত ব্রাহ্মণ পুষ্করসারীকে বর্ণব্যবস্থার অযৌক্তিকতা মেনে নিয়ে জ্যোতির্বিদ্যার পাঠ নিতে হয় চণ্ডাল ত্রিশঙ্কুর কাছে। যোদ্ধা ও সারথির সামাজিক উচ্চাবচতা উল্টে যায় নতজানু অর্জুনকে সারথি কৃষ্ণের গীতাকথনে।
শিক্ষার উৎস যে একমুখী হতে পারে না, তা বহুধাবিস্তৃত, এ কথা বিশ্বাস করতেন ষোড়শ শতাব্দীর আগরার শিক্ষক শেখ মুবারক। আকবর যখন তাঁর প্রথম জীবনে শ্রদ্ধাস্পদ দুই গোঁড়া ইসলামি শিক্ষাবিদ মখদুম-উল-মুল্ক এবং আবদুন নবি-র আর্থিক দুর্নীতি ও অসৎ স্বজনপোষণ সামনে আসায় বীতশ্রদ্ধ ও হতাশ, তখনই আকবরের সভায় জ্ঞানচর্চার নতুন দিগন্ত খুলে দেন ফৈজ়ি ও আবুল ফজ়ল, যাঁরা তাঁদের শিক্ষক ও পিতা শেখ মুবারকের মুক্তচিন্তার আলোতে ইসলামি দর্শনের পাশাপাশি গ্রিক দর্শন ও সংস্কৃত ভাষাতেও ছিলেন সুপণ্ডিত। আবার আকবরের ঘনিষ্ঠতা লাভের লড়াইয়ে এঁদের সঙ্গে এঁটে উঠতে না পেরে সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঝুঁকে পড়া ইতিহাসবিদ আব্দুল কাদির বদায়ুনি আকবর, আবুল ফজ়ল, ফৈজ়ির উদারনীতির বিরূপ সমালোচনা করলেও শেখ মুবারক সম্পর্কে ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আকবরের সভার মহাভারত-অনুবাদ প্রকল্পে যে ফৈজ়ির মতো তিনিও হাত লাগিয়েছিলেন, তার থেকে বোঝা যায় যে, মোল্লাতন্ত্রের উদগ্র সমর্থক বদায়ুনির আড়ালে বেঁচে ছিলেন শেখ মুবারকের সংস্কৃতজ্ঞ ছাত্রটিও।
মুক্ত, বহুমুখী, স্বাধীন জ্ঞানচর্চার এই ভারতীয় ঐতিহ্যর অন্যতম অংশীদার কি এই শহরও নয়? মনে পড়ে, প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিহাস বিভাগের নবাগত ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে কলেজ-পরিক্রমায় বেরোতেন অধ্যাপক রজতকান্ত রায়। ডি এল রিচার্ডসন, হিউ মেলভিল পার্সিভ্যাল, ই এফ ওটেন, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, কুরুভিল্লা জ়াকারিয়া, সুশোভনচন্দ্র সরকার, প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, তারকনাথ সেন, অশীন দাশগুপ্ত প্রমুখের মতো কিংবদন্তি শিক্ষকদের কথা বলে শেষে তিনি মুখোমুখি হতেন প্রতিষ্ঠানের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের— সত্য ও যুক্তির আলোতে একটা প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করে বিতাড়িত শিক্ষক হেনরি লুইস ভিভিয়ান ডিরোজ়িয়ো তাকিয়ে থাকতেন ছবি থেকে। আবার, স্বাধীন ভারতে মুক্ত, আধুনিক, সামাজিক ন্যায়ভিত্তিক জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান হয়ে ওঠা যে বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসসাধনে আজ সাম্প্রদায়িক অশুভ শক্তি কৃতসঙ্কল্প, সেই জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল দিনের চমকপ্রদ আখ্যান তুলে ধরেছন শিক্ষক, ছাত্র, কর্মীরা— সদ্যপ্রকাশিত জেএনইউ স্টোরিজ়: দ্য ফার্স্ট ফিফটি ইয়ার্স বইতে। শিক্ষাক্ষেত্রের এই সার্বিক অবক্ষয়ের দিনেও যখন চোখে পড়ে চিন্তার মুক্তিকে রক্ষা করতে অসীম-শক্তিধর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় বা জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের ঐকান্তিক প্রতিরোধ, আর কর্মক্ষেত্রে নিত্য হেনস্থার ঝুঁকি, রাজনৈতিক প্রসাদ হারানোর ভয় অগ্রাহ্য করে বহু শিক্ষক যখন ঢাল হয়ে দাঁড়ান আক্রান্ত ছাত্রদের সঙ্গে, কখনও শরীরী মানববন্ধনীতে, কখনও বৌদ্ধিক প্রতিরোধে— তখন মনে হয়, হাজার দ্রোণার্জুনের ভিড়ে এখনও হারিয়ে যায়নি উদ্দালক আরুণি ও বুদ্ধের, শেখ মুবারক ও ডিরোজ়িয়োর ভারতবর্ষ।
প্রাচীন ভারতীয় ও বিশ্ব ইতিহাস বিভাগ, সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy