কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ভারত ও পাকিস্তানকে যুদ্ধের প্রান্তসীমায় নিয়ে এসেছে। দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের ঝুঁকি নেবে কি না, তা এখনও নিশ্চিত নয়। তবে একটি বিধ্বংসী সংঘাতের সম্ভাবনা দিন দিন ভয়াবহ ভাবে বাড়ছে।
দু’টি বিষয় স্পষ্ট। প্রথমত, পরমাণু অস্ত্র উপমহাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বা সীমিত যুদ্ধ প্রতিরোধ করতে পারেনি। ভারত ও পাকিস্তান কার্গিলে চার মাস যুদ্ধ করেছে, যখন উভয় দেশই আনুষ্ঠানিক ভাবে পরমাণু শক্তি অর্জন করেছিল। পাকিস্তান বারবার সন্ত্রাসীদের ভারতীয় জনগণ ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে হামলায় সহায়তা করে প্রায়ই দুই রাষ্ট্রকে যুদ্ধের কিনারায় ঠেলে দিতে বসেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা-অস্থিতিশীলতা আপাতবিরোধিতার এখনও সমাধান হয়নি। রাষ্ট্রতত্ত্বের একটি মতবাদে দাবি করা হয় যে পরমাণু অস্ত্র পাকিস্তানকে ভারতের প্রত্যাঘাতের সীমা পরীক্ষার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ করতে উৎসাহিত করেছিল। আবার একই ভাবে, ভারতের বিমানবাহিনীর সুনির্দিষ্ট প্রত্যাঘাত (সার্জিক্যাল স্ট্রাইক) পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্রভান্ডার সত্ত্বেও আটকানো যায়নি। সুতরাং, দুই দেশের দ্বন্দ্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে স্থিতিশীলতা আনেনি পরমাণু অস্ত্র, বরং একে আরও অনির্দিষ্টতার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, পাকিস্তান কখনওই অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে চায় না। তাই নজিরবিহীন ভাবে অর্থনৈতিক সঙ্কট ও কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার সম্মুখীন হয়েও, বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক স্থান হিসেবে স্বীকৃত হয়েও সেই দেশে সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতার উপর আরও দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করছে। এত সঙ্কট সত্ত্বেও, পাকিস্তানে কোনও অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন ঘটতে দেখা গেল না। ইসলামাবাদের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের ফলে আমেরিকা, চিন, সৌদি আরব ও তুরস্কের মতো দেশ হয়তো আজও তাকে ত্রাণ পেতে সহায়তা করে— যদিও এই দেশগুলোর ধৈর্যও ক্রমে কমছে। বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পগুলি মোটের উপর ব্যর্থ। চিনের সঙ্গে ‘সব মরসুম’-এর সম্পর্কেও নানা সমস্যা দেখা যাচ্ছে। ট্রাম্পের নতুন বিদেশনীতিতে লেনদেনমূলক সুবিধা ছাড়া আর্থিক সহায়তার কথা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত— যে-হেতু পাকিস্তান আমেরিকাকে এই মুহূর্তে আর্থিক দিক দিয়ে কোনও কিছুই দিতে অক্ষম। ধর্মীয় বিশ্বাসের মিল বিশ্ব-রাজনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে এখনও কোনও প্রমাণ নেই। প্যালেস্টাইনিদের ভাগ্যই প্রমাণ করে দেয়, আজকের দুনিয়ায় ধর্মীয় বিশ্বাসের মিল থাকা সত্ত্বেও সম্মিলিত ঝুঁকি ভাগাভাগিতে তা কতটা অকার্যকর।
তবে পাকিস্তান কেন এমন আচরণ করছে? এর তিনটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা: প্রথমত, ক্রমবর্ধিত সংঘাতের প্রতিকল্প (স্পাইরাল মডেল) অনুযায়ী, যখন কোনও পক্ষ অপর পক্ষকে শাস্তি দিয়ে তার আচরণে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে, তখন সংঘর্ষ আরও গভীর হয়ে ওঠে। শাস্তি পেয়ে প্রতিপক্ষ আত্মসমর্পণ না করে বরং অপমানিত বা হুমকিগ্রস্ত বোধ করে। সে আরও আগ্রাসী হয়ে ওঠে, দাবি বাড়িয়ে দেয়। প্রথম পক্ষ তখন মনে করে, তার শাস্তি হয়তো যথেষ্ট কঠোর ছিল না, ফলে সে তার প্রতিক্রিয়া আরও বাড়ায়। এতে একটি ছোট মতবিরোধ ধীরে ধীরে ভয়াবহ সংঘর্ষ বা এমনকি যুদ্ধের রূপ নিতে পারে। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, শান্তি বজায় রাখার সবচেয়ে ভাল উপায়: বোঝাপড়া ও আপস— ভয় দেখানোর পরিবর্তে আশ্বাস দেওয়া। সংক্ষেপে, মিলনের ইঙ্গিত শাস্তির চেয়ে বেশি কার্যকর।
এর বিপরীতে, প্রতিরোধমূলক প্রতিকল্প (ডেটারেন্স মডেল) মনে করে যে তোষণ প্রায়ই বুমেরাং হয়ে ফিরে আসার ঘোর সম্ভাবনা। যখন কোনও পক্ষ প্রতিপক্ষকে অপরাধের পরও ছাড় দেয়, তখন দ্বিতীয় পক্ষ একে দুর্বলতার লক্ষণ হিসেবে দেখতে পারে, এবং আরও আগ্রাসী দাবি করতে উৎসাহ পায়। এ দিকে প্রথম পক্ষ মনে করে যে চাপ ও হুমকি কাজ করছে, তাই সে চাপ বজায় রাখে। পরে, যদি আপসকারী পক্ষ দৃঢ় অবস্থান নিতে চায়, তবে তার হুমকি গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হয় না, আর তাতে ভুল বোঝাবুঝি ও যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়ে। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, শান্তির পথ হল শক্তি ও দৃঢ়তার প্রদর্শন, ফলে আগ্রাসনের জবাব কঠোর ভাবে দেওয়াই ঠিক। এখানে শান্তি বজায় রাখতে পারে ‘শক্তি’, ‘সহযোগিতা’ নয়।
রাষ্ট্রনীতির গবেষক-অধ্যাপক সুমিত গঙ্গোপাধ্যায় যথার্থ ভাবে দেখিয়েছেন যে পাকিস্তান নিঃসন্দেহে প্রতিরোধমূলক প্রতিকল্পের উপযুক্ত উদাহরণ। কারণ, তারা ধারাবাহিক ভাবে ঝুঁকিপূর্ণ নীতি অনুসরণ করেছে এই ধারণায় যে, ভারত তার প্রতিক্রিয়ায় সংযত থাকবে এবং কঠোর শাস্তির পথে হাঁটবে না। অন্য ভাবে বললে, পাকিস্তানের কৌশলগত আচরণ ব্যাখ্যা করতে নিরাপত্তা দ্বিধার দৃষ্টিকোণ (সিকিয়োরিটি ডিলেমা) কার্যকর নয়। পাকিস্তান ভারতের ক্রমবর্ধমান শক্তির আশঙ্কায় আগাম আগ্রাসনমূলক আচরণ করে না। তাদের লক্ষ্য প্রতিরক্ষা নয়, বরং এটি একটি লোভী রাষ্ট্রের উৎকৃষ্ট উদাহরণ, যারা বিশাল ঝুঁকি নিয়ে সমগ্র কাশ্মীর তাদের বৈধ অধিকার বলে দাবি করে থাকে, এবং এই লক্ষ্যভেদের জন্য সব ধরনের ঝুঁকি নিতে সদা প্রস্তুত থাকে।
তৃতীয় ব্যাখ্যাটি পরিচয় ও রাজনৈতিক কাঠামোর ভিত্তিতে নির্মিত। পাকিস্তান ভারতকে অস্তিত্বগত ভাবে অস্বীকার করার মানসিকতা থেকে সরিয়ে ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে এবং একই সঙ্গে তার নিরাপত্তাকে সামরিকীকরণ ও সামরিক বাহিনীর নিরাপত্তাকরণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের প্রতি পাকিস্তানের ঝোঁকই তার ভারতের বিপরীতে ভারসাম্য রক্ষা করার একমাত্র অবলম্বন। অসামরিক রাজনৈতিক শক্তি যে-হেতু পাকিস্তানের রাজনীতিতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ, সে দেশ অনিবার্য ভাবে একটি ব্যর্থ সেনা-রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত, ভারতবিরোধী মনোভাবই এখন সেই রাজনৈতিক উপাদান, যা সে দেশের বিভিন্ন বিভাজিত অংশকে একত্রে রেখেছে।
ফলে, যত বড় সঙ্কটই আসুক না কেন, পাকিস্তান একটি বিভাজনমূলক মতাদর্শ অনুসারেই চলবে, এবং এমন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি বহন করবে যা সঙ্কটের কথোপকথনকে আসলে জাতীয়তাবাদের শক্তিপরীক্ষার ছাঁচের মতো ব্যবহার করে। রাষ্ট্রীয় আত্মপরিচিতি পাল্টে ফেলা খুব কঠিন। কিন্তু কোনও দেশের ভিত্তিই যদি হয় ভারত-বিরোধিতা, সে দেশের পক্ষে সদর্থক যৌথ-সত্তা নির্মাণ অসম্ভব।
চূড়ান্ত কোণঠাসা অবস্থায় পড়লে মরিয়া রাষ্ট্রগুলি কখনও কখনও সাত পাঁচ না ভেবে অতি সত্বর ঘোড়া টিপে দিতে পারে। স্পষ্টত, পাকিস্তান ভয় পেয়েছে। ভারতে এখন দৃশ্যত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক রকম শত্রুভাবাপন্ন মানসিকতা বিরাজ করছে। একের পর এক ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ফলে জনমনে ক্ষোভ ও অসন্তোষ জমে উঠেছে। তাই রাষ্ট্র জানে, যদি তারা দীর্ঘ ও কঠিন যুদ্ধে প্রস্তুতি নেয়, তা হলে সাধারণ জনগণের সমর্থন তাদের পাশে থাকবে। মোদীর জনপরিচালিত রাজনীতিও মহৎ উদ্দেশ্যে গণবলিদানের ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি। তাই যদি আন্তর্জাতিক কূটনীতি পুরো শক্তি দিয়ে দুই রাষ্ট্রকে আলোচনার টেবিলে আনতে না পারে, তা হলে পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার পূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে।
দুঃখজনক ভাবে, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল ট্রাম্পের চরমপন্থী নীতির কারণে আহত ও বিভ্রান্ত। ফলে সাম্প্রতিক অতীতে যে সক্রিয় হস্তক্ষেপ আন্তর্জাতিক স্তরে দেখা গেছে, তা এখন অনুপস্থিত। যখন জনমনে প্রবল ক্ষোভ তীব্র আবেগে রূপ নেয়, তখন যুক্তিনির্ভর চিন্তা-ভাবনা দিয়ে রাষ্ট্রগুলির আচরণ ব্যাখ্যা করা যায় না। মোদ্দা কথা, পাকিস্তান বারবার প্রমাণ করেছে যে তারা ভারতবিরোধী আচরণে দায়িত্বশীলতা দেখাতে অক্ষম। অনেক রাষ্ট্রই যে ন্যায়ের পথে চলতে ইচ্ছুক নয়— তা এখন একটি বিতর্কাতীত বিষয়। রাশিয়া ও ইজ়রায়েল দেখিয়েছে যে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলি কত দূর পর্যন্ত যেতে পারে। বর্তমানে ন্যায় ও মূল্যবোধের দাবি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রীতিমতো অসার। তাই, নৈতিক সদিচ্ছা দিয়ে এই সংঘাতের সমাধান হবে না।
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের একমাত্র নিয়ন্ত্রক হল পরমাণু সীমারেখা। কিন্তু আগেই বলেছি, অতীতের কর্মকাণ্ড প্রমাণ করেছে— পারমাণবিক নিরোধকের কার্যকারিতা অনিবার্য বা স্থায়ী বলে এ ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যাবে না। যুদ্ধ একেবারেই বাঞ্ছিত নয়, সুতরাং তা অনিবার্য বলে ভাবা কারও পক্ষেই উচিত হবে না। কিন্তু এও ঠিক, কিছু বিষয়ে দৃঢ় আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ জরুরি। নয়তো দু’টি দেশেই স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যেতে পারে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)