মোট কার্বন নিঃসরণের নিরিখে ভারত বিশ্বে তৃতীয় স্থানে রয়েছে— বিশ্বের সমগ্র কার্বন নিঃসরণের ৭.৩ শতাংশ উৎপন্ন হয় ভারতে। যদিও ভারতে বার্ষিক মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণ মাত্র ১.৮ টন, যেখানে আমেরিকা এবং চিনের মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ যথাক্রমে ১৪.৭ ও ৭.৬ টন। বিশ্বের মাথাপিছু গড় নিঃসরণের পরিমাণ ৪.৫ টন। জলবায়ু পরিবর্তন এবং উষ্ণায়নের কারণে অন্য অনেক দেশের মতো ভারতও পরিবেশ রক্ষার শপথ নিয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেছিলেন, ভারত ২০৭০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের নেট জ়িরো মাত্রায় পৌঁছবে, অর্থাৎ বছরে ততটুকুই কার্বন নিঃসরণ হবে, যা সেই এক বছরে প্রকৃতি শোষণ করে নিতে পারবে।
ভারতের নেট জ়িরো লক্ষ্য অর্জনের জন্য পরিবহণ ক্ষেত্রে পরিবর্তন আবশ্যিক, কারণ ভারতের মোট কার্বন নিঃসরণের ১০.৭ শতাংশ ঘটে পরিবহণ ক্ষেত্রে। পরিবহণ ক্ষেত্রে সম্ভাব্য নেট জ়িরো বিকল্প পথগুলোকে স্বল্প, মাঝারি এবং দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অনুযায়ী চিহ্নিত করে উপযুক্ত স্বতন্ত্র পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। এ ছাড়াও পরিবহণ ক্ষেত্রের অন্তর্গত বিভিন্ন বিভাগগুলির (ব্যক্তিগত পরিবহণ, গণপরিবহণ ও ভারী পরিবহণ) নিজস্বতা অনুযায়ী স্বতন্ত্র পরিকল্পনা প্রয়োজন।
বর্তমান পরিবেশ-সম্পর্কিত নীতি পরিবহণ ক্ষেত্রে প্রধানত বিদ্যুৎচালিত পরিবহণকেই (ইলেকট্রিক ভেহিকল বা ইভি) প্রাধান্য দিয়েছে। ইভি ব্যক্তিগত যানবাহনে স্বল্প ও মাঝারিমেয়াদি লক্ষ্য হিসাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাব্য পরিবেশবান্ধব সমাধান। কিন্তু গণপরিবহণ ও ভারী পরিবহণের ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব সমাধান হিসাবে ইভি স্বল্পমেয়াদেও খুব উপযুক্ত নয়। বরং, হাইড্রোজেন চালিত বাহন ভারী ও যাত্রী পরিবহণের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশবান্ধব বিকল্প হতে পারে।
২০১৪-১৫ সালে ভারতে মোট ২৩৪৪টি ইভি পঞ্জিকরণ হয়েছিল। ২০১৫-১৬ সালে তা বেড়ে হয় ১৭,৯২১। ২০১৫ সালের মার্চ মাসে ভারত সরকার বিদ্যুৎচালিত যানবাহনের ক্ষেত্রে ফাস্টার অ্যাডপশন অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং অব ইলেকট্রিক ভেহিকলস (এফএএমই) নীতি প্রণয়ন করে। এই নীতি ইভির প্রাথমিক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভাবে সাহায্য করেছে, এবং ভারতে বিদ্যুৎচালিত পরিবহণ ব্যবস্থার তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি হয়েছে। ২০১৮-১৯ সালে ইভি পঞ্জিকরণের সংখ্যা ছিল এক লক্ষ সাতচল্লিশ হাজার, যা ২০১৯-২০ সালে হয়েছে এক লক্ষ আটষট্টি হাজার। ২০২১-২২ সালে সংখ্যাটি চার লক্ষ ত্রিশ হাজারে পৌঁছেছে— সে বছর ভারতে মোট যত গাড়ির রেজিস্ট্রেশন হয়েছিল, তার ২.৬%। ২০৩০ সালের মধ্যে ইলেকট্রিক ভেহিকল-এর সংখ্যা আরও অনেক বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা হচ্ছে।
দুঃখজনক ভাবে, এফএএমই-র প্রথম ও দ্বিতীয় দফা, প্রডাকশন-লিঙ্কড ইনসেনটিভস (পিএলআই) ব্যবস্থা, বা সম্প্রতি পরিকল্পিত ব্যাটারি বদল নীতি বিদ্যুৎচালিত গাড়ির গ্রহণযোগ্যতা দ্রুত বাড়ানোর চেষ্টা করলেও, সেই গাড়ির ব্যাটারির পুনর্ব্যবহার বা পুনর্নবীকরণের জন্য এখনও কোনও নীতি প্রণীত হয়নি। একটি লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির গড় আয়ু তিন বছর বা ৩০০-৪০০ চার্জিং চক্র, অর্থাৎ এফএএমই-এক’এর অধীনে কেনা বিদ্যুৎচালিত গাড়িগুলির ব্যাটারির আয়ু ফুরিয়ে এসেছে, সেগুলি এখন বর্জ্য। ই-বর্জ্য পরিবেশের জন্য বিশেষ ক্ষতিকর। তা ছাড়াও, বিদ্যুৎচালিত গাড়ির ক্ষেত্রে চার্জিং স্টেশন পরিকাঠামো তৈরির জন্য বিপুল প্রাথমিক বিনিয়োগের প্রয়োজন।
ভারতের ইভি পরিকল্পনা প্রধানত আমদানি-নির্ভর। বিদ্যুৎচালিত গাড়ির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ব্যাটারি, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে ভারতে যার উৎপাদন এখনও সন্তোষজনক নয়। কাজেই, বর্তমানে ব্যাটারি চাহিদা মেটাতে তা প্রধানত চিন থেকে আমদানি করতে হয়। ব্যাটারি উৎপাদন বা তার কাঁচামাল সরবরাহের ক্ষেত্রে চিনের একক আধিপত্য রয়েছে। দেশে বিদ্যুৎচালিত গাড়ির ব্যবহার যত বাড়বে, উপযুক্ত দেশীয় প্রযুক্তি ও কাঁচামালের অভাবে চিনের উপরে নির্ভরতাও তত বাড়বে। বর্তমানে জীবাশ্ম জ্বালানির জোগানও মূলত আমদানি-নির্ভর, কিন্তু সেই আমদানি কোনও একটি নির্দিষ্ট দেশের উপরে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল নয়। বিদ্যুৎচালিত গাড়ি-নির্ভর পরিবহণ ব্যবস্থা তৈরি হওয়ার পরও যদি ব্যাটারি ও অন্যান্য জিনিস আমদানির ক্ষেত্রে ভারত শুধুমাত্র চিনের উপর নির্ভরশীল থাকে, তবে ভূ-রাজনৈতিক কারণে তা ভারতের পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে।
স্বল্প বা মাঝারি মেয়াদে অন্য একটি পরিবেশবান্ধব বিকল্প হতে পারে প্রাকৃতিক গ্যাস। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার যে, সদ্যসমাপ্ত জলবায়ু সম্মেলনে ভারত শুধু কয়লা নয়, সব ধরনের জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারই কমানোর কথা বলেছে। কিন্তু, সেই প্রস্তাবটি এ বারের সিদ্ধান্তের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। যদি এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়, তবুও স্বল্প বা মাঝারি মেয়াদে এটি গ্রহণযোগ্য বিকল্প। ভারতের প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদার অনেকটাই আমদানি করতে হলেও এ ক্ষেত্রে কোনও একটি নির্দিষ্ট দেশের উপর নির্ভরতার ঝুঁকি থাকবে না; এবং বিদ্যুৎচালিত গাড়ির তুলনায় এর পরিকাঠামো তৈরির জন্য এবং প্রাথমিক বিনিয়োগের প্রয়োজন তুলনায় অনেক কম। ২০১৮ সালে, ভারতে মোট ২.৩ কোটি নতুন গাড়ির পঞ্জিকরণ হয়, যার মধ্যে সিএনজি (পরিবহণে ব্যবহৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) গাড়ির সংখ্যা ছিল ২৯,৪৭৪ এবং হাইব্রিড সিএনজি গাড়ি ছিল ১,১১,২৩৬। সে বছর ১,৩২,৩৩৯টি বিদ্যুৎচালিত গাড়ির পঞ্জিকরণ হয়েছিল। ২০২১ সালে অতিমারির কারণে গাড়ি পঞ্জিকরণের সংখ্যা ১.৭ কোটিতে নেমে আসে, যার মধ্যে সিএনজি ছিল ১,৬৫,০২৭টি, এবং হাইব্রিড সিএনজি ছিল ২,৩৮,৬৫২টি।
বিদ্যুৎচালিত গাড়ির তুলনায় বর্তমানে ভারতে সিএনজি এবং হাইব্রিড সিএনজি, দু’ধরনের গাড়ির ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো অপেক্ষাকৃত ভাল জায়গায় আছে। এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে সিএনজি-চালিত যানবাহন প্রচারের জন্য রাজ্য সরকারগুলির (বিশেষত দিল্লিতে) সক্রিয় ভূমিকা পরিকাঠামো উন্নয়নে এবং গ্রাহকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরিতে বিপুল সহায়তা করেছিল। উন্নত পরিকাঠামো না থাকলে গ্রাহক বিকল্প জ্বালানি-চালিত গাড়ির প্রতি আকৃষ্ট হবেন না। গাড়ির দামও ভারতীয় ক্রেতাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে— বিদ্যুৎচালিত গাড়ির তুলনায় হাইব্রিড সিএনজি গাড়ির দাম কম হওয়ায় ক্রেতাদের কাছে তা বিকল্প হিসাবে অধিকতর গ্রহণযোগ্য। এ ছাড়াও এই ধরনের গাড়ির যন্ত্রাংশ তুলনায় সহজলভ্য। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে সব ধরনের যানবাহনে সবুজ হাইড্রোজেন জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। কিন্তু স্বল্প ও মাঝারি মেয়াদে লক্ষ্য হিসেবে সিএনজি বা হাইব্রিড গাড়ি বিকল্প হিসেবে বেশি গ্রহণযোগ্য। তার প্রধান কারণ, বিদ্যুৎচালিত গাড়ির জন্য সম্পূর্ণ নতুন পরিকাঠামো নির্মাণ প্রয়োজন।
বিশেষত ভারী যানবাহন আর জলপথ পরিবহণের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসাবে হাইড্রোজেন-চালিত যানবাহনের সম্ভাবনা বিপুল। ভারত ইতিমধ্যেই হাইড্রোজেন-চালিত গণপরিবহণের পথে হাঁটতে শুরু করেছে— পুণেতে তেমন বাস পরিষেবা চালু হয়েছে, আগামী বছর জলপথ পরিবহণও চালু হবে। অস্ট্রেলিয়ায় হাইড্রোজেন চালিত ট্রাক চালু হতে চলেছে।
জীবাশ্ম জ্বালানির মেয়াদ যে ফুরিয়ে আসছে, সে কথা প্রায় নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। সিএনজি বা হাইব্রিড সিএনজি-চালিত গাড়ি, বিদ্যুৎচালিত গাড়ি, হাইড্রোজেন-চালিত গাড়ি— ভবিষ্যতের পরিবহণের চেহারা কী হবে, সে বিষয়ে অবিলম্বে বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রয়োজন। মনে রাখা প্রয়োজন যে, এই নীতির প্রভাব পড়বে বহু ক্ষেত্রে— পরিবেশের উপরে, অর্থব্যবস্থায়, জীবনযাত্রার স্বাচ্ছন্দ্যের পরিমাণে। কাজেই, সব দিক মাথায় রেখেই এই পরিকল্পনা তৈরি করা প্রয়োজন।
দি এনার্জি অ্যান্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট; ইন্ডিয়া ডেভলপমেন্ট ফাউন্ডেশন
ো
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy