থ্যাঙ্কসগিভিং উৎসব প্রতি বছর বিশ্বাসের গল্প বলে।
সাধারণত নভেম্বর মাসের শেষ বেলায়, পশ্চিম গোলার্ধের উত্তর-পূর্বের আমেরিকা মহাদেশে হেমন্তের অরণ্যে ঘুরে বেড়ায় সময়ের পোস্টম্যান। রঙিন পাতা-ঝরা খামে ‘এসো সুসংবাদ’ লেখা চিঠির ঠিকানা মানুষের হাতে পৌঁছে দেয় সে। ঋতু পরিবর্তনের হাত ধরে ‘ফল সিজ়ন’ মাটিতে বিছিয়ে রাখা লাল-হলুদ গাছের পাতায় হিমেল পরশের ক্যালাইডোস্কোপিক নকশা বুনে যায় এই সময়ে। এ বারও যাচ্ছে। গত আড়াই বছর পৃথিবীজোড়া অতিমারিতে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুমিছিলে হারিয়ে গিয়েছে বহু চেনা-অচেনা আত্মীয়-বন্ধু, স্বজনের মুখ। চলে গিয়েছেন আজীবনের অবলম্বনেরা; তবুও সেই ‘মেঘপিয়নের ব্যাগের ভেতরের মনখারাপের দিস্তা’ সরিয়ে রেখে সূর্য ওঠা-ডোবার সঙ্গে ভেসে আসছে সবাইকে ভাল রাখার প্রার্থনার আজান, মৌন মন্ত্রপাঠ।
‘থ্যাঙ্কসগিভিং’ পালনের সময় এটা। ধর্ম-বর্ণ-জাত-পাত, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, রাজনীতি-অর্থনীতি সব ভুলে সবারই প্রাণে এখন খানিক খুশির ছোঁয়া। চোখের সামনে পাল্টাতে থাকা এই রঙিন পৃথিবীর সুসময়ও হয়তো ক্যালেন্ডারের পাতায় লাল কালিতে লেখা আশার চিঠি সবার মেলবক্সে পৌঁছে দেয়। আমেরিকায় রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মেরুকরণে বিভক্ত হয়ে যাওয়া মানুষ, অতিমারির প্রকোপে প্রায় দশ লক্ষ মৃত্যুর পরেও, একে-অন্যের মাঝে তুলে রেখেছে ভেদাভেদের দেওয়াল। তাই, প্রতীকী হলেও, নভেম্বরের শেষ বৃহস্পতিবারের বারবেলায় এখানকার সবচেয়ে বড় ঐতিহ্যশালী উৎসব ‘থ্যাঙ্কসগিভিং’ সেই দেওয়াল খানিকটা ভেঙে ফেলতে পারে কি না, দেখতে ইচ্ছে করে। বুকে নতুন করে শ্বাস ভরে আত্মীয়-বন্ধুদের নিয়ে এক সঙ্গে খাওয়ার টেবিলে বসে গল্প করার কথা ভাবতে পারছেন অনেকে, এটাও কম কী।
তবে এ দেশের বা বহু দেশের মানুষই এখনও তাঁদের পারিবারিক ভোজে আদৌ বসতে পারবেন কি না, সেই চিন্তায় আছেন। অর্থনৈতিক মেরুকরণের শিকার সাধারণ মানুষ কোণঠাসা হয়ে রয়েছেন দিনের পর দিন, সঙ্গে হারিয়ে ফেলছেন ক্রমশ কমতে থাকা সরকারি তহবিল ও অনুদানের ‘সেফটি নেট’। আর ঠিক তারই পাশাপাশি তুমুল বৈভব আর ক্ষমতার অধিকারী রাজনৈতিক গোষ্ঠী আরও প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। আর এই ‘হ্যাভ’ আর ‘হ্যাভ-নটস’-এর মূল সমস্যা এড়িয়ে, একনায়কতন্ত্রী রাষ্ট্রনেতারা ভেদাভেদের আগুনে ইন্ধন জুগিয়ে সামাজিক মূল্যবোধের ভিতটাকে এখনও তছনছ করছেন। মানুষে মানুষে ধর্ম ও বর্ণের বিদ্বেষ, লিঙ্গবৈষম্য, সামাজিক নীতির মতবিরোধ, অভিবাসীদের প্রতি ঘৃণা— কমবেশি মাত্রায় আজও রয়েই গিয়েছে। ক’দিন আগের মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির আবার খানিক শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসাটাও সেই মেরুকরণ আর বৈষম্যকে আরও প্রভাবান্বিত করবে। এ দেশে এখনও অর্থনৈতিক জাঁতাকলে পিষে যাওয়া শ্রমজীবীদের হতাশা, অবসাদ, আত্মহত্যা আর বন্দুকবাজদের দৌরাত্ম্যের খুব একটা হেরফের হয়নি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের যূপকাষ্ঠে হারিয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের স্বপ্ন। অন্য দিকে, পরিবেশ দূষণের অভিঘাতে পৃথিবীও পাল্টে যাচ্ছে দ্রুত।
অথচ মানুষের জীবন ও জীবিকানির্বাহের মূল কাঠামোগুলোর পরিবর্তন করা কিন্তু কঠিন নয়। উদাহরণও রয়েছে হাতের কাছেই। বিশ্বযুদ্ধের তুমুল ক্ষয়ক্ষতির পর প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন রুজ়ভেল্ট যে ‘নিউ ডিল’ প্রবর্তন করেছিলেন, সেই আর্থ-সামাজিক নীতি মানুষকে নতুন সুযোগ দিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে সাহায্য করেছিল। অতিমারি-উত্তীর্ণ পৃথিবী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সেই ‘পুরনো হলেও নতুন’ রাজনৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ আজও কতটা প্রয়োজন। শত পরিবর্তন হলেও, এখনও সব গোষ্ঠীর মানুষ কিছু কিছু পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের প্রতি আস্থাশীল। এঁরা কঠিন সময়ে প্রতিবেশীর পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে দ্বিধা করেন না। বহু বছর ধরেই এখানে বহু মানুষের মধ্যে সেই সহমর্মিতার প্রকাশ দেখেছি, শুনেছি মানুষে মানুষে বিশ্বাসের ভিত তৈরির গল্প।
থ্যাঙ্কসগিভিং উৎসব প্রতি বছর সেই বিশ্বাসের গল্পটাই বলে। যদিও উত্তর আমেরিকায় এই প্রথার উৎসে আছে ইউরোপের শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদের যূপকাষ্ঠে বলি এ দেশের মূল অধিবাসী ‘ইন্ডিয়ান’দের করুণ কাহিনি, তবু জর্জ ওয়াশিংটন ও আব্রাহাম লিঙ্কনের হাত ধরে জাতীয় ছুটির এই দিনটি হতাশার বদলে আশাব্যঞ্জক বার্তাই পাঠায়। যতই বাণিজ্যিক মনোরঞ্জনের হাতছানি থাকুক; মা-বাবা-ছেলে-মেয়ে, পরিবার-পরিজন একত্র হয়ে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের এই ছুটির দিনটা কিন্তু সত্যিই সবার দরকার। খাদ্য-বস্ত্র-আচ্ছাদনের জন্য একে অন্যের কাছে কৃতজ্ঞতা জানানোর এই প্রথার মানবিক দিকটি মানসিক শান্তিরও সহায় হতে পারে। কাছের মানুষটিকে পাশে রেখে, সূর্যাস্তের রঙিন আলোর বর্ণালি মেখে, নশ্বর জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের জন্য কৃতজ্ঞ থাকার ও ধন্যবাদ দেওয়ার এই দিন, অন্ধকার দূর করে আবার কি নিয়ে আসতে পারে না প্রথম আলোর প্রতিশ্রুতি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy