জোটবদ্ধ: আনন্দ শর্মা, অরবিন্দ কেজরীওয়াল, শত্রুঘ্ন সিন্হা, চন্দ্রবাবু নায়ডু, শরদ পাওয়ার, ফারুক আবদুল্লার সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দিল্লি, ২০১৯।
বাংলার বিজয়ী জনবাদী শক্তি এ বারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারতের অন্যত্র তাদের পতাকা নিয়ে যেতে উদ্যত। এ নিয়ে গাত্রদাহ অনেকের। কারণ বোঝাও দুরূহ নয়। রাজনীতিতে সংঘাত এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবেই। তা ছাড়া বৃহৎ প্রচারমাধ্যম এবং প্রতিষ্ঠিত জাতীয় দলগুলির অসন্তুষ্টিও অনুমেয়।
কিন্তু প্রশ্ন হল, সর্বভারতীয় জনবাদী মঞ্চ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা কতটুকু? লক্ষণীয় যে, আমাদের দেশে জনবাদী শক্তি আঞ্চলিক বাস্তবতায় প্রোথিত। ভাষা, আঞ্চলিক সংস্কৃতি, আঞ্চলিক শ্রেণিবিন্যাস, এবং আঞ্চলিক কৃষ্টি জনবাদী রাজনীতিকে লালন করেছে। কৃষিব্যবস্থার আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য এক-এক ধরনের নির্দিষ্ট জনবাদী রাজনৈতিক পরম্পরাকে সাহায্য করেছে। গত শতাব্দীর শেষ ভাগে মহেন্দ্র টিকায়েত অথবা শরদ জোশীর আন্দোলন, অন্য দিকে বিহারে সামাজিক ন্যায়ের রণধ্বনির পিছনে জনবাদী শক্তির সমাবেশ, তামিলনাড়ুতে ব্রাহ্মণ-বিরোধী ন্যায়ের আন্দোলন, অথবা পশ্চিমবঙ্গে অসংগঠিত শ্রমজীবী জনসাধারণের রক্ষা এবং তাঁদের উপকার ও সামাজিক কল্যাণ— এই রকম নানা বাস্তবতায় জনবাদী রাজনৈতিক শক্তির ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু এই আঞ্চলিক বাস্তবতার কি কোনও সামগ্রিক সমাহার ও দেশব্যাপী সমাবেশ সম্ভব? অথবা এক সর্বভারতীয় স্তরে এই ধরনের সমাবেশকে সংহত করা যাবে? সর্বভারতীয় নির্বাচনের নির্দিষ্ট লক্ষ্যেও কি তা করা সম্ভব হবে?
এই প্রশ্ন নির্বাচন-কেন্দ্রিক হলেও, এই ধরনের সমাবেশ দু’টি শর্তে সফল হতে পারে। এক, যদি বিকল্প সরকার গঠিত হয়, তবে জনবাদী রাজনৈতিক সংহতি প্রশাসনিক কাঠামো এবং জনবাদী কর্মসূচি অবলম্বন করে বাড়তে পারে। দুই, নির্বাচন-কেন্দ্রিক রাজনৈতিক কর্মসূচি নির্দিষ্ট রূপ পেলেও, তার গতি নির্ভর করবে ন্যূনতম সর্বভারতীয় কর্মসূচি জনবাদীরা তাঁদের বিভিন্ন অনুসারী শক্তিসমূহের সামনে আনতে পারছেন কি না তার উপর। আঞ্চলিক শক্তিগুলির সমাবেশ এক জাতীয় রূপ নিতে পারে এই দুই শর্তে।
সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলনের থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। গণ-আন্দোলন পথের রাজনীতিতে নিষ্ঠা, নমনীয়তা এবং অবিচল মনোভাব জাতীয় মানসে দাগ কাটতে সক্ষম। আবার সাম্প্রতিক কয়েক দশকের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া যায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, কয়েক দশক আগে যে ভাবে বামপন্থীরা উদারনৈতিক শক্তির একাংশের সাহায্যে স্বৈরতন্ত্র-বিরোধী জাতীয় সমাবেশকে সম্ভব করেছিলেন। কিন্তু, বামপন্থীরা তাঁদের সেই সাফল্য ধরে রাখতে পারেননি। তাঁরা নিজেরাই এক অলীক ‘জাতীয়’ উপস্থিতির সন্ধানে তথাকথিত জাতীয় শক্তিগুলির লেজুড়ে পরিণত হয়েছিলেন।
প্রশ্ন তোলা উচিত, সনাতন পদ্ধতি অবলম্বন করে আর কি জাতীয় শক্তি বা জাতীয় রাজনৈতিক দলের উত্থান সম্ভব? দেশের দক্ষিণপন্থী, বামপন্থী এবং মধ্যপন্থী শক্তিসমূহের জাতীয় শক্তি রূপে আবির্ভাব হয়েছিল জাতীয় আন্দোলনের যুগে। তার পর কয়েক যুগ কেটে গেলেও আর কোনও বুনিয়াদি সর্বভারতীয় শক্তির আবির্ভাব সম্ভব হয়নি। হয়তো, তেমনটা আর সম্ভবও নয়।
বামপন্থীদের কথা ভাবা যাক। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তাদের দরকার এক মতাদর্শ, দেশব্যাপী গণসংগঠন, দেশব্যাপী রাজনৈতিক দলের কাঠামো, দেশব্যাপী নির্বাচনে অংশগ্রহণ, এবং সর্বভারতীয় দলীয় কাঠামো অবলম্বন করে দেশব্যাপী গণ-আন্দোলনের নকশা— এই পাঁচ উপাদান। এক কালে এ ভাবেই বামপন্থীদের জাতীয় রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। কিন্তু আজ কি এই উপাদানগুলিকে নতুন করে গড়া যাবে? না। অথবা, এই পাঁচ উপাদান কি আর আগের মতো বামপন্থীদের জাতীয় ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারছে? তারও উত্তর, না। কাজেই শুধু অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি কি স্বৈরতন্ত্র-বিরোধী জাতীয় সমাবেশকে সম্ভব করতে পারে? না, অন্তত এই ধরনের ন্যূনতম কর্মসূচিকে সম্ভব করার যে প্রাক্শর্তগুলি আছে, সেগুলির পূরণ না হলে অভিন্ন, ন্যূনতম কর্মসূচি বাস্তব হয়ে ওঠা সম্ভব নয়।
এর অর্থ এই নয় যে, পুরনো ইতিহাসের প্রয়োজন নেই। কিন্তু সেই শিক্ষা নিতে হবে আজকের আলোয়, আজকের মতো করে সেই শিক্ষাকে গড়েপিটে নিয়ে। তাই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ভুল বলেননি, যখন প্রায় স্বগতোক্তির সুরে বলেছিলেন, “ইউপিএ কোথায়? ইউপিএ মৃত।”
স্বৈরতন্ত্রী ও দক্ষিণপন্থী ক্ষমতার বিরুদ্ধে যে ব্যাপক ও যৌথ সমাবেশ প্রয়োজন, তার নেতৃত্ব কোনও জাতীয় শক্তির পক্ষে আজ জোগানো দুরূহ। এই হল বাস্তব। এবং জনবাদীরা এই বিশ্লেষণে যদি উপনীত হয়ে থাকেন, তার ভিত্তি আছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন ওঠে, তবে পথটা ঠিক কী? আঞ্চলিক শক্তি ও জাতীয় শক্তির যৌথ সমাবেশ, কিংবা যে যৌথ সমাবেশ স্বৈরতন্ত্র এবং দক্ষিণপন্থী নয়া উদারনীতিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় চরিত্র ধারণ করবে, তার উপায় কী হতে পারে?
এক অর্থে বাংলা মডেলের প্রাসঙ্গিকতা এ ক্ষেত্রে অনেক। অসংগঠিত শ্রমজীবী মানুষের যথাসম্ভব সামাজিক সুরক্ষা, নারীকল্যাণ-কেন্দ্রিক কর্মসূচি, গণশিক্ষা এবং জনস্বাস্থ্য পরিষেবার প্রসার, কৃষি-উৎপাদনের উন্নতি, পরিকাঠামোর উন্নতির উপর গুরুত্ব এবং রাজনৈতিক সমাবেশকে দলীয় শৃঙ্খলার নিগড়ে বেঁধে না ফেলা— এ সবেরই এক ধরনের দেশব্যাপী তাৎপর্য রয়েছে। এই তাৎপর্য অথবা প্রাসঙ্গিকতার মূল কথা: পরিষেবা এবং সুরক্ষা। জনবাদী এই রণনীতি সমগ্র দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, বিশেষত এমন সময়ে যখন সারা দেশ জুড়ে লক্ষ কোটি মানুষ কর্মহীন, ক্ষুদ্র ব্যবসা সর্বনাশা ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে, কৃষকদের মাথায় হাত, এবং ধন ও সম্পদ বৈষম্য উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে।
একটি সাম্প্রতিক ছোট ঘটনায় জনবাদী নীতির তাৎপর্য বোঝা যাবে। গোয়ায় রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে জনবাদীরা ঘোষণা করেছিলেন যে, তাঁরা গোয়ার নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠনে সক্ষম হলে গোয়ার মহিলাদের মাসিক পাঁচ হাজার টাকা সামাজিক সুরক্ষা হিসাবে দেবেন। কংগ্রেস এই ঘোষণার বিরোধিতা করে শ্লেষের সুরে বলেছিল, অর্থনৈতিক জ্ঞানের জন্য তৃণমূলের নোবেল পুরস্কার পাওয়া উচিত। নয়া উদারনীতিবাদী অর্থনীতির সূচনা কংগ্রেসের হাত ধরে এসেছে। বহু ক্ষেত্রে নয়া উদারনীতিবাদী সংস্কার গতি পেয়েছে কংগ্রেসের নীতির ফলে। কাজেই কংগ্রেসের সঙ্গে জনবাদীদের যে মতপার্থক্য এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে, তাতে বিস্ময়ের কী? বরং এক ক্ষয়িষ্ণু শক্তির অসামর্থ্যের বিশ্লেষণ করে যদি সে শূন্যস্থান পূরণ না করা যায়, তাতে স্বৈরতন্ত্রী, দক্ষিণপন্থী ক্ষমতারই লাভ।
এ দিক দিয়েও জনবাদীদের সামনে সুযোগের সম্ভাবনা, কিন্তু পরিস্থিতি দুরূহ। এই দ্বৈত অবস্থার মধ্য দিয়ে জনবাদীদের এগোতে হবে। শক্তি সঞ্চয় করতে হবে, অথচ সর্বভারতীয় মঞ্চ গড়ে তোলার সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। সাহসী হওয়া চাই, কিন্তু মূর্খামি নয়। অবিমৃশ্যকারিতার কোনও সুযোগ নেই। জনবাদীরা এই মাঝের রাস্তা বার করতে পারেননি বলেই অতীতে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তাঁদের চেষ্টা বিফলে গিয়েছে।
যে কয়েকটি উপাদানের উল্লেখ আমি করেছি জাতীয় সাফল্যের প্রাক্শর্ত রূপে, তার মধ্যে একটিতে শক্তিসঞ্চয়ের ক্ষেত্রে জনবাদীরা এখনও বিফল। সেই বিফলতা হল নতুন জায়গায় জন-আন্দোলন প্রসারের ক্ষেত্রে, যে জন-আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের ভিত্তিরূপে কাজ করেছে।
তবু অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জনবাদীরা তাঁদের রণকৌশলে নতুনত্বের ছাপ রেখেছেন। এই নমনীয়তা তাঁদের সম্পদ। তাঁরা শুধু পুরনো পন্থা আঁকড়ে নেই, এটা লক্ষণীয়।
সর্বভারতীয় গণসংগঠনের সমাহার, ন্যূনতম কর্মসূচি সংসদে লাগাতার বক্তৃতা— এ সব সত্ত্বেও বামপন্থীরা সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে কেন নির্ণায়ক শক্তি হতে পারলেন না? কেন তাঁদের ক্রমাগত ক্ষয় ঘটেই চলেছে, যা কংগ্রেসের ক্ষয়ের থেকেও বেশি? কেন তাঁদের কর্মসূচি গণসমর্থন পায় না, এবং নতুন সঙ্গী লাভেও অসমর্থ? কাজেই সর্বভারতীয় ঐক্য গড়ার ক্ষেত্রে তাঁদের নীতি ও কৌশলের ইতিহাসের যেমন ইতিবাচক শিক্ষা আছে, তেমনই কী করলে সাফল্য আসবে না, তারও পরিষ্কার ইঙ্গিত আছে।
জনবাদীরা যদি অহেতুক আগ্রাসী মনোভাব না দেখান এবং সঙ্গীলাভে নমনীয় থাকেন, তবে আমরা হয়তো অদূর ভবিষ্যতে সর্বভারতীয় জনবাদী শক্তির উত্থান দেখতে পাব। হয়তো তা বিভিন্ন স্বৈরবাদ-বিরোধী শক্তির সমাহার হবে! রোম সম্রাট অগাস্টাস তাঁর সৈন্যবাহিনীকে কী উপদেশ দিয়েছিলেন, মনে আছে তো? ‘‘তাড়াতাড়ি এগোও, কিন্তু ধৈর্য ধরে।’’
সমাজবিজ্ঞানী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy