মানুষ কী করে পথ চেনে? কী ভাবে পথ খুঁজে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছতে পারে? পথ চিনতে পারা, অচেনা পথ মনে রেখে দেওয়াটা বিজ্ঞানের ব্যাপার। তা সম্ভব হয় মস্তিষ্কের অন্দরমহলে এক প্রকার নিউরন, ‘মেমরি সেল’ বা স্মৃতিকোষের দৌলতে।
ব্রেনের মধ্যে ‘প্লেস সেল’ নামে বিশেষ এক স্নায়ুকোষের জন্যে আমরা চিনতে পারি আমাদের অবস্থান। যে পথ ধরে যাচ্ছি, তার প্রতিটি জায়গা। এ ভাবেই প্রতিটি স্থান আলাদা করে চেনা সম্ভব হয়। এ ছাড়াও, কতটা দূর বা কোন দিকে গেলে আমরা গন্তব্যে পৌঁছতে পারব, সেই দিকনির্দেশ চেনানোয় কাজ করে বিশেষ আর এক ধরনের ‘নার্ভ সেল’, যাদের বলি ‘গ্রিড সেল’। প্রতিটি স্থানের ‘ত্রিমাত্রিক মানচিত্র’ ছবির মতো ফুটিয়ে তোলে আমাদের মস্তিষ্কের ভিতরে এই গ্রিড সেলগুলিই। প্লেস সেল ও গ্রিড সেল আবিষ্কারের ফলেই মানুষের পথ খুঁজতে বুঝতে চিনতে পারার রহস্যের উদ্ঘাটন সম্ভব হয়েছে। আমাদের যাত্রাপথের প্রতিটি স্থানের নিখুঁত ও বিশদ মানচিত্র মজুত থাকে মস্তিষ্কে, তার জেরেই সম্ভব হয় ‘নেভিগেশন’ প্রক্রিয়া। গ্রিড সেল অনেকটা মস্তিষ্কের ‘ইন্টার্নাল জিপিএস’-এর মতো কাজ করে। স্থান-জ্ঞানের সঙ্গে জড়িত দূরত্ব ও গতির ধারণা, এই সব কিছুর অভিজ্ঞতা মগজে মজুত থাকে বলেই পরে আমরা যখন আগের জায়গাটিতে আসি, সেই স্থান বা পথ চিনতে পারা সম্ভব হয়। বুঝতে পারি, কোন পথ ধরে গেলে পৌঁছতে পারব গন্তব্যে।
তবু পথ ভুল করে মানুষ। যখন চেনা পথও চিনে ঘরে ফিরতে পারে না সে, চিনতে পারে না রাস্তা বা নিজের অবস্থান— চিকিৎসাশাস্ত্রের পরিভাষায় তখন তা গণ্য হতে পারে অসুখ বলে। ডিমেনশিয়া বা অ্যালঝাইমার’স-এর মতো জটিল ‘নিউরো-ডিজেনারেটিভ’ অসুখে ভুগছেন, এমন মানুষদের অনেক সময়ই দেখা যায় পথ ভুল করতে। স্মৃতি, চিন্তাশক্তি ইত্যাদির উপর ছায়া ঘনানো এই অসুখে গোলমাল হয়ে যায় ‘সেন্স অব ডিরেকশন’-এর গতিপ্রকৃতি, বিজ্ঞানও।
প্লেস সেল ও গ্রিড সেল আবিষ্কারের ফলে অ্যালঝাইমার’স ও ডিমেনশিয়া সম্পর্কে ধারণা আরও পরিষ্কার হয়েছে। অ্যালঝাইমার’স রোগে মস্তিষ্কের এই কোষগুলি নষ্ট হয়ে যায় এবং নিজেদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে পারে না। স্নায়ুবিজ্ঞানীরা দেখেছেন, অ্যালঝাইমার’স রোগীর মস্তিষ্কে জট-পাকানো নিষ্ক্রিয় অ্যামাইলয়েড ও টাউ প্রোটিন জট পাকিয়ে শক্ত হয়ে যায়। ফলে মস্তিষ্কে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের নিউরনগুলি নষ্ট হয়ে যায়। তাঁরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, দীর্ঘজীবী প্রাণী তিমি বা ডলফিন এবং কুকুর গরু ইত্যাদি গৃহপালিত প্রাণীদেরও অ্যালঝাইমার’স জাতীয় রোগ হয়। তবে, গবেষকদের ধারণা, বন্যপ্রাণীদের অ্যালঝাইমার’স হয় না, হলেও তা খুব কম সময়ের জন্য। তাঁরা মনে করেন, সম্ভবত হাতিদের প্রখর স্মৃতিশক্তির কারণেই ওদের স্মৃতি হারায় না। খাদ্য সংগ্রহের জন্য অরণ্যের নির্দিষ্ট স্থান এবং জলের সন্ধানে অরণ্যের বাইরে মাইলের পর মাইল হাতিরা হেঁটে যায়, দশকের পর দশক তারা মনেও রাখতে পারে সেই পথ। তা ছাড়া, তারা খুব ভাল করে নিজেদের চিনতে পারে আর নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যেও সংযোগ রক্ষা করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রখর স্মৃতিশক্তির পিছনে তাদের বড় আকারের মস্তিষ্কেরও ভূমিকা আছে। মানুষের তুলনায় হাতির ব্রেন আকারে চার গুণ বড়, স্নায়ুকোষের সংখ্যা মানুষের চেয়ে আড়াই গুণ বেশি। গবেষকদের ধারণা, বৃহদাকার মস্তিষ্ক ও প্রখর স্মৃতিশক্তির জন্যই হাতিদের অ্যালঝাইমার’স গোছের রোগ হয় না। মানুষের মস্তিষ্ক তো উন্নততম, স্মৃতিশক্তিও প্রখর, তবু মানুষ স্মৃতিশক্তি হারায় বা তার ক্ষয় হয়। হাতিদেরও যে স্মৃতি হারানোর ঝুঁকি থাকে না কোনও, তা কি নিশ্চিত করে বলা যায়?
এমন হতে পারে, খুব কম সময়ের জন্য তাদের রোগের উপসর্গ দেখা দেয়, ঠিক ওই সময়ে পরীক্ষা করলে হয়তো তা ধরা পড়ত। ওয়াইল্ডলাইফ কনজ়ারভেশন সোসাইটি-র রিপোর্ট অনুযায়ী, পৃথিবীর বিভিন্ন অরণ্য থেকে প্রতি দিন অনেক হাতি নিখোঁজ হয়। এদের অধিকাংশেরই পরিণতি হয় চোরাশিকারিদের হাতে পড়ে বেঘোরে মূল্যবান দাঁত ও প্রাণ খোয়ানোয়। জনপদে এসে পথ হারিয়ে আর বনে ফিরতে না পারা, পথভ্রষ্ট হয়ে রেলে কাটা পড়া বা গজদন্ত-ব্যবসায়ী দুষ্টচক্রের হাতে নিখোঁজ হওয়ার আগে হাতির মস্তিষ্ক পরীক্ষার যদি সুযোগ থাকত, তা হলে হয়তো ধরা পড়ত ওদেরও অ্যালঝাইমার’স রোগের লক্ষণ। বনসম্পদ ধ্বংস ও অরণ্যে মানুষের দখলদারির ফলে বন্যপ্রাণীদের উপর বেড়েছে নিরাপত্তার অভাবজনিত চাপ। জঙ্গলের হাতি তাই জনপদে চলে আসছে এ যেমন সত্য, তেমনই স্মৃতিভ্রংশের কারণও কি বাদ দেওয়া চলে?
মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অঞ্চলে অ্যামাইলয়েড ও টাউ প্রোটিন জমে থাকা না-থাকার উপর ভিত্তি করে সাধারণ ভাবে বোঝা যায়, কারও অ্যালঝাইমার’স হয়েছে কি না। হাতির ক্ষেত্রেও এই পরীক্ষা হয়, তবে তা করা হয় ঘেরাটোপে নিয়ন্ত্রিত বা মৃত হাতির উপরে, অরণ্যের হাতির উপর নয়। অ্যালঝাইমার’স রোগে আক্রান্ত কি না, তা নিশ্চিত হতে হাতির আচরণগত পরিবর্তন পর্যবেক্ষণও প্রয়োজন। বন্য হাতির ক্ষেত্রে এই পরীক্ষা যথেষ্ট কঠিন। আবার শুধু অ্যালঝাইমার’স-এই নয়, অন্য রোগেও মস্তিষ্কে অ্যামাইলয়েড ও টাউ প্রোটিন জমতে দেখা যায়। তাই, অ্যামাইলয়েড ও টাউ-এর অনুপস্থিতি মানেই অ্যালঝাইমার’স না-হওয়া— এমনটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। বন্য হাতির ক্ষেত্রে কখন ঠিক কী ঘটছে না ঘটছে, সেই অজ্ঞতা থেকেই মানুষের পক্ষে ওদের উপযুক্ত পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব হয় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy