দলিত শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়েছে প্রায় দেড়শো বছর আগে, মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলের মুখ দিয়ে। অবশ্য এই বঙ্গে শব্দটিকে প্রচলনে আনতে লোকেদের কালঘাম ছুটে গেছে। হয়তো এই দূরত্বের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আরও একটি প্রশ্নের উত্তরও: শ্রমিক-কর্মচারীদের নিজস্ব পেশা অনুযায়ী সংগঠন থাকা সত্ত্বেও দলিত শ্রমিক-কর্মচারীদের আলাদা করে সংগঠন কেন গড়তে হয়, এবং গড়ার পরেও তা কেন ট্রেড ইউনিয়ন বিশেষজ্ঞদের নজরে পড়ে না।
প্রথমেই বলা যেতে পারে, ট্রেড ইউনিয়ন যদি দলিত শ্রমিক-কর্মচারীদের সংবিধানসম্মত সুযোগসুবিধা আদায় ও তাঁদের মর্যাদার প্রশ্নে আন্তরিক থাকত, তা হলে স্বতন্ত্র দলিত সংগঠনের প্রয়োজন হত না। কিন্তু, শ্রেণি-রাজনীতির মাহাত্ম্যের কাছে জাতের প্রশ্নটি বিভেদকামী ও প্রতিক্রিয়াশীল। অতএব, দলিতের অস্তিত্ব যেমন তাঁর অমর্যাদার মধ্যেই থেকে গেছে, বৃহৎ শক্তিগুলির কাছে দৃশ্যমান হয়নি, তেমনই তাঁদের দাবি নিয়ে সরব হওয়ার দায়িত্বটাও দলিতদের উপরেই বর্তেছে— সামাজিক পরিসরে তার জায়গা হয়নি। ফলে অফিস কাছারিতে কর্মরত দলিত মানুষ নিজের নিজের ট্রেড ইউনিয়নের সদস্যপদ বজায় রেখেও নিজেদের জন্য স্বতন্ত্র সংগঠন গড়ে তুলতে বাধ্য হয়েছেন।
মহারাষ্ট্রে জ্যোতিরাও ফুলের সত্যশোধক আন্দোলনের যে সহযোগীকে ভারতীয় ট্রেড ইউনিয়নের জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তিনি নারায়ণ মেঘাজি লোখান্ডে। গুরুচাঁদ ঠাকুরের সমবয়সি তিনি। ১৮৮৪ সালে বম্বে মিল হ্যান্ডস অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা। নিয়মিত প্রকাশ করতেন দীনবন্ধু নামে পত্রিকা। শ্রমিকদের জন্য রবিবার ছুটির দিন আদায় ও ভারতের প্রথম ত্রিপাক্ষিক বৈঠকেরও কারিগর তিনি।
কৃষক প্রজা পার্টির নেতা ও পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য, বহুভাষাবিদ বিরাটচন্দ্র মণ্ডল ১৯২৫ সালে গঠন করেন কাঁচরাপাড়া রেলওয়ে ওয়ার্কসম্যান ইউনিয়ন। ১৯২৭-এ ইন্ডিয়ান স্ট্যাটুটরি কমিশনের সামনে ওই ইউনিয়নের পক্ষে ভারতীয় শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ ও তাঁদের প্রতিনিধিত্ব বিষয়ে সাক্ষ্য দেন। ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি বাবু জগজীবন রামের হাত ধরে গড়ে ওঠা ভারতীয় ডিপ্রেসড ক্লাসেস লিগের সভাপতি ছিলেন বাংলার রসিকলাল বিশ্বাস, পুণা চুক্তির স্বাক্ষরকারীর অন্যতম। তাঁর কলকাতার বাসভবন থেকেই জাগরণ পত্রিকা ও ইংরেজিতে পিপলস হেরাল্ড পত্রিকা প্রকাশিত হত। দ্বিতীয়টির উদ্বোধন করতে এসেছিলেন বি আর আম্বেডকর। এই সব কার্যক্রমের গতিশীলতা জোর পেয়েছিল গুরুচাঁদ ঠাকুরের গভীর ও বহুব্যাপী শিক্ষা আন্দোলনের মাধ্যমে।
অর্থাৎ, মহারাষ্ট্রের মতো অখণ্ড বাংলাতেও কিন্তু দলিত আন্দোলনের একটা জোরালো ধারা বহমান ছিল। নতুবা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল কংগ্রেসের আপ্রাণ বাধাদান সত্ত্বেও আম্বেডকরকে বাংলা থেকে নির্বাচনে জিতিয়ে গণপরিষদে পাঠাতে পারতেন না। ট্রেড ইউনিয়ন গঠন ও পত্রিকার বিষয়বস্তু থেকে প্রমাণ করা কঠিন নয়, দলিত-চেতনার পাশাপাশি শ্রেণি-চেতনার উপাদানও তাতে কিছু কম ছিল না। এই চেতনারই পরবর্তী প্রকাশ দলিত কর্মচারী সংগঠন, যার মাধ্যমে উঠে এল অমর্যাদা ও আর্থিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে মানুষের ভিন্ন এক রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর।
স্বাধীন ভারতের সংবিধান অনুযায়ী পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য শিক্ষা ও চাকুরিতে সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু হয়। ফলে সরকারি দফতরগুলিতে দলিত মানুষের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। তাঁরা বাস্তব অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারেন তথাকথিত উচ্চশ্রেণির মানুষ তাঁদের এই উপস্থিতি সহজ ভাবে মানতে পারছেন না। চাকরিতে এত দিনের একচেটিয়া আধিপত্য হারাতে উচ্চবর্ণের মানুষ রাজি ছিলেন না। সহকর্মী হলেও ব্যক্তিগত বা ট্রেড ইউনিয়ন স্তরে দলিত মানুষের সহমর্মী হওয়া ছিল বেশ কষ্টকর।
ষাটের দশকের একেবারে শেষ দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ব্যাঙ্ক ও জীবনবিমা-সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র জাতীয়করণ করেন এবং সেখানে সংরক্ষণ ব্যবস্থার সুযোগ সৃষ্টি হয়। অনেক দলিত মানুষের চাকরিতে প্রবেশাধিকার ঘটে। সংখ্যাবৃদ্ধির কারণে দলিত কর্মচারীদের সামনে নিজেদের সংগঠিত করার একটা সুযোগ আসে। রাজনৈতিক অভিভাবকত্ব না থাকা সত্ত্বেও রেল, ডাক-তার, ব্যাঙ্ক, জীবনবিমা , ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স, কোল ইন্ডিয়ার মতো সংস্থায় এবং রাজ্য সরকারি দফতরে গড়ে ওঠে দলিত কর্মচারী সংগঠন। নামে কল্যাণমূলক সংগঠন হলেও এগুলো চরিত্রে ছিল ট্রেড ইউনিয়নের মতো। আম্বেডকর চর্চা, মুখপত্র প্রকাশ, সম্মেলন, সেমিনার, ইত্যাদির মধ্য দিয়ে তাদের ঐক্যবোধ সম্প্রসারিত হতে শুরু করে।
ট্রেড ইউনিয়নের পদাঙ্ক অনুসরণ করে গড়ে ওঠে দলিত কর্মচারীদের ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ় ফেডারেশন, দলিত কর্মচারী সংগঠনের কো-অর্ডিনেশন ১৪ এপ্রিল কমিটি। উচ্চশিক্ষায় দলিত মানুষের অধিকাররোধী একটি সার্কুলার প্রত্যাহারের দাবিতে এই কমিটির ডাকে ১৯৯৫ সালের ৯ জানুয়ারি থেকে শিয়ালদহ স্টেশনের বাইরের চত্বরে ১১ দিনব্যাপী আমরণ অনশন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এর ফলে রাজ্য সরকার অধ্যাপক বাসুদেব বর্মনকে নিয়ে একটি কমিশন গঠন করতে বাধ্য হয়।
দুর্ভাগ্য, বাংলায় এই সংগঠনগুলি সম্পর্কে জানার আগ্রহ যতটা কম, এঁদের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও রাজনৈতিক অবদানের কথা বিস্মরণের মাত্রাও তত বেশি। দলিত বাংলা চিরকালীন অস্পৃশ্যতার অভিজ্ঞান হয়েই থেকে গেল, এখনও পর্যন্ত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy