ইয়ার্কি হচ্ছে? কে অ্যারেস্ট করবে?”— বলে বেআইনি বাজি ফাটানো আটকাতে আসা পুলিশ আধিকারিকদের দিকে যেখানে বছরখানেক আগে তেড়ে গিয়েছিলেন এক তৃণমূল বিধায়ক; সেই ভাঙড় থেকে ঘণ্টা-তিনেকের দূরত্বের পাথরপ্রতিমায় ৩১ মার্চ সন্ধ্যায় ঘটল এক ভয়ানক বাজি বিস্ফোরণ। মারা গেলেন চার জন শিশু ও বালক সমেত আট জন।
পাথরপ্রতিমা ব্যতিক্রম নয়। ২০০৯ সাল থেকে রাজ্যে বাজি বিস্ফোরণের একচল্লিশটি ঘটনায় প্রায় একশো দশ জন মারা গিয়েছেন এবং এমন ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে। এ এক আশ্চর্য সমাপতন (না কি আইন ভাঙার সিলমোহর) যে, ২০১৫ সালের শেষ দিকে জাতীয় পরিবেশ আদালত রাজ্যের যাবতীয় বেআইনি বাজি কারখানা বন্ধ করার রায় দিলেও তার পর থেকেই রাজ্যে একত্রিশটি বাজি বিস্ফোরণের ঘটনায় মারা গিয়েছেন আশি জন! এখানে অবশ্য আইনি-বেআইনি নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই; কেননা সরকারি তথ্যেই প্রকাশ যে, সেই সময় রাজ্যে সম্পূর্ণ ভাবে আইনি পথে চলা বাজি কারখানার সংখ্যা ছিল মাত্র চার (এখন দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ছাড়পত্র পাওয়া বাজি কারখানার সংখ্যা চার)। পরবর্তী সময় রাজ্যের মুখ্যসচিবের মিটিংয়ের ‘মিনিটস’ জানাচ্ছে যে, রাজ্যে রয়েছে ৫৫৫৬টি বাজি তৈরি, মজুত ও বিক্রির সংস্থা; অর্থাৎ সোজা কথায় ৯৯.৯%-ই বেআইনি।
এক সময় সারা দেশে শব্দদূষণ, বিশেষ করে বেআইনি বাজি নিয়ন্ত্রণে মডেল হওয়া পশ্চিমবঙ্গে কেন আজ এই উলটপুরাণ? বাম আমলের শেষের দিকে রাজ্যে শব্দ ও বাজি সংক্রান্ত আইন ভাঙার ঘটনা বাড়লেও, তা নিয়ম হয়ে গিয়েছে বর্তমান সরকারের সময়। সেই প্রবণতায় রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার আশায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ, কম-বেশি ইন্ধন জোগায় সব রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রী। সেই কারণেই পাথরপ্রতিমার বিস্ফোরণে আট জন মারা যাওয়ার পরে সমাজমাধ্যমে সমালোচনা করে বা এনআইএ’র তদন্তের লোকদেখানো দাবি তুলেই ক্ষান্ত হন বিরোধীরা। আসলে, গত কয়েক বছর ধরেই এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে প্রশাসন, বিরোধীরাও কখনও সে বিষয়ে রা-কাড়েননি। যেন পরিবেশের বিরুদ্ধে এ এক মহাজোট। কাকতালীয় নয় যে, বিজেপিশাসিত গুজরাতেও সম্প্রতি বেআইনি বাজি কারখানার বিস্ফোরণে মারা গিয়েছেন ২১ জন; আবার বাম ও কংগ্রেসশাসিত কেরলে বার বার বাজি বিস্ফোরণে বহু মানুষের জীবন গিয়েছে।
এ রাজ্যের ক্ষেত্রে এক-এক করে বেআইনি বাজির বিরুদ্ধে প্রশাসনিক চাপ দুর্বল হয়েছে। প্রথমে, রাজ্যের শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে ঐতিহাসিক ভাবে মূল কান্ডারি রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ হাত গুটিয়ে নিল, বা তাদের হাত গুটিয়ে নিতে বাধ্য করা হল। পাশাপাশি আদালতেও বেআইনি বাজি নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে রাজ্যের আইনি ভূমিকা দুর্বল হল। যখন বোঝা গেল এই যুগলবন্দি যথেষ্ট নয়, তখন হঠাৎ সারা দেশের আইনের অন্য পথে হেঁটে বাজিশিল্পকে প্রায়-দূষণহীন তকমা দিয়ে ‘সাদা’ ক্যাটেগরিতে ফেলা হল, যাতে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ছাড়পত্রই না লাগে! অনুমতি দেওয়ার দায়িত্ব পেল ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প দফতর, যাদের বাজিশিল্পে পরিবেশ রক্ষা নিয়ে মাথাব্যথা বা দক্ষতা; কোনওটাই নেই।
গোটা বিষয়টিতে তালে তাল মেলাল কেন্দ্রীয় সরকারের দফতর পেট্রলিয়াম অ্যান্ড এক্সপ্লোসিভস সেফটি অর্গানাইজ়েশন, সংক্ষেপে পেসো, এবং কেন্দ্রীয় পরিবেশ সংস্থা ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল এঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট, সংক্ষেপে নিরি। কালীপুজোর আগে বাজি মেলায় কার উপর বর্তাবে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশিত সবুজ বাজি পরীক্ষার দায়িত্ব, তা নিয়ে শাটলকক ছোড়াছুড়ি করল দায়িত্বে থাকা রাজ্য ও কেন্দ্রীয় দফতরগুলি। আর ফাঁকা মাঠে গোল করে গেল বেআইনি বাজি ব্যবসায়ীরা, সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশিত শুধুমাত্র সবুজ বাজি ব্যবহারের নিয়ম আটকে রইল সরকারি নির্দেশিকা আর বিজ্ঞাপনে; মাত্র দু’ঘণ্টা বাজি ফাটানোর সময়সীমাও। সরকারি ভাবনায় গরিব মানুষের জীবনজীবিকা বাঁচানোর দাবির সামনে পরিবেশবিদদের করা সাবধানবাণী কল্কে পেল না।
বাজি নিয়ে সরকারি এই ডিগবাজির সঙ্গে যুক্ত হল বেআইনি বাজি ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীদের একাংশের তোলাবাজি। বেআইনি বাজি শিল্পের সঙ্গে জুড়ে থাকা সাধারণ, দিন-আনা-দিন-খাওয়া মানুষরা যাতে নিশ্চিন্তে কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে পারেন, তার জন্য ‘রেন্ট সিকিং’ (ভাড়া নিয়ে ক্ষমতা ধার দেওয়া) মডেল অনুযায়ী প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন এই ব্যবসায়ীরা। শব্দ ও বায়ুদূষণ তো বাড়ছেই; পাশাপাশি একের পর এক বিস্ফোরণে প্রাণ হারাচ্ছেন গরিব মানুষরাই। ক্ষতিকর রাসায়নিক সামগ্রী নিয়ে কাজ করা এই ব্যবসার সঙ্গে দীর্ঘ সময় যুক্ত থাকার ফলে কর্মীদের, বিশেষ করে আশেপাশে থাকা শিশুদের শরীরের কী দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হচ্ছে, সে সব বিষয় নিয়ে পদক্ষেপ দূরে থাক, আলোচনাটুকুও নেই!
এই বেআইনি ব্যবস্থার জাল থেকে অসহায় মানুষদের আইনি পথে পুনর্বাসনের দায়িত্ব সরকারেরই। আজ হয়তো আট জনের মৃত্যুকে সামলে নেওয়া যাচ্ছে, কিন্তু আগামী কাল যদি এই সংখ্যাটা আশি হয়, তা হলে তার থেকে রাজনৈতিক সমস্যা তৈরি হতে পারে। কেননা, সেটা ঘটবে মূলত রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে, যা এখনও অবধি শাসক দলের দুর্গ বলেই চিহ্নিত।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)