ডিসেম্বর মাসে নাগাল্যান্ডের মন জেলায় সেনা কমান্ডোর চালানো গুলিতে কয়লাখনি থেকে সপ্তাহান্তে ঘরফেরতা শ্রমিকদের প্রাণহানির ঘটনায়, নাগা ছাত্র সংগঠন আফস্পা প্রত্যাহারের পাশাপাশি দাবি করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার যেন ব্যর্থতা স্বীকার করে নাগা জনগোষ্ঠীর কাছে ক্ষমা চায়। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দায়সারা দুঃখ প্রকাশ করলেও প্রধানমন্ত্রী সে পথ মাড়াননি। কৃষক আন্দোলনে চাষিদের মৃত্যুর ঘটনাতেও একই দাবি উঠেছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ক্ষমা চেয়েছিলেন দেশের অন্য সব চাষির কাছে, কারণ তিনি নাকি আন্দোলনকারী চাষিদের বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছেন। নোটবন্দির সময়ে লাইনে দাঁড়িয়ে মারা যাওয়া মানুষ এবং রেললাইনে ঘুমিয়ে পড়া ক্লান্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যু— এ সব কিছুই ক্ষমা প্রার্থনার যোগ্য মনে হয়নি তাঁর। ভুল বা অপরাধ স্বীকার করা, এবং তার দায় নিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করা যে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর ধাতে নেই, তা অবশ্য অনেক আগেই প্রমাণিত হয়েছে। ২০০২ সালের গুজরাত দাঙ্গার জন্য ক্ষমা চাওয়ার সম্ভাবনা তিনি বহু বার জোর গলায় উড়িয়ে দিয়েছেন। অবশ্য এই ব্যাপারে দেশের অন্য তাবড় নেতারাও কমবেশি একই পথের পথিক। ইন্দিরা গান্ধী হত্যার পর দিল্লি শহরে শিখ নিধনের ঘটনায় দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী ক্ষমা চেয়েছিলেন বলে শোনা যায় না। কিন্তু রাষ্ট্রীয় তথা সামাজিক অপরাধের দায় স্বীকার করে রাষ্ট্রপ্রধান বা রাষ্ট্রের প্রতিনিধির ক্ষমা চাওয়ার ঘটনা পশ্চিমের দেশে বিরল নয়।
নাৎসি জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোল্যান্ডের জনগণ, বিশেষত সেখানকার ইহুদিদের উপর যে অত্যাচার চালিয়েছিল, তার জন্য সর্বসমক্ষে সরকারি ভাবে ক্ষমা চেয়েছেন জার্মান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্ক-ওয়াল্টার স্টাইনমায়র। ২০১৯ সালে, অত্যাচারের ৮০ বছর পরে। স্পষ্ট ভাষাতেই জানিয়েছেন যে, তিনি নতজানু অত্যাচারিত পোলিশ মানুষদের সামনে, তাঁদের কাছে তিনি ক্ষমা ভিক্ষা করেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষী জমানার শেষ প্রেসিডেন্ট এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্ক— যাঁর হাত ধরে পালা বদল ঘটেছিল সে দেশে— নিজে ১৯৯৭ সালে ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’-এ হাজিরা দিয়ে, কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের উপর অতীতে সংঘটিত অত্যাচারের জন্য প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে, এবং দেশের জীবিত ও মৃত শ্বেতাঙ্গদের তরফ থেকে ক্ষমা চান। সে দেশের ঔপন্যাসিক জে এম ক্যুটসি-র লেখা বেশ কয়েকটি উপন্যাসে ফিরে ফিরে আসে শ্বেতাঙ্গ শাসক বা শাসকস্থানীয় ব্যক্তির প্রায়শ্চিত্ত এবং ক্ষমা ভিক্ষার অনুষঙ্গ। ওয়েটিং ফর দ্য বারবেরিয়ানস উপন্যাসের নামহীন ম্যাজিস্ট্রেট যে ভাবে জনজাতি গোষ্ঠীর পঙ্গু এক মেয়ের সেবা করেন, তা যে আদতে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে শ্বেতাঙ্গদের শতবর্ষ ধরে করে আসা অপরাধের জন্য ক্ষমা ভিক্ষার রূপক, তা বুঝতে পাঠকের অসুবিধা হয় না। রাষ্ট্র তথা রাষ্ট্রের প্রতিনিধি-স্থানীয়দের এই রকম ক্ষমা প্রার্থনার পিছনে থাকা রাজনীতিকে স্বীকার করে নিয়েও এগুলির গুরুত্ব উপেক্ষা করা যায় না, কারণ এর মধ্য দিয়ে সূচিত হয় রাজনৈতিক এবং সামাজিক স্তরে রক্তাক্ত সম্পর্কের শুশ্রূষা।
আসলে ব্যক্তি, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক— সব ক্ষেত্রেই ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়টি নিয়ে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক জটিলতা রয়েছে। ফরাসি দার্শনিক জাঁক দেরিদা ‘অন ফরগিভনেস’ শীর্ষক সন্দর্ভে বলেছেন যে, ক্ষমা হতে হবে শর্তবিহীন। বিশেষ কোনও লক্ষ্য— যেমন ক্ষতিপূরণ, সমন্বয়সাধন, ন্যায়প্রতিষ্ঠা, আত্মিক শান্তি— কোনওটিই এর চালিকা শক্তি হতে পারে না। কোনও মধ্যস্থতাকারীর উপস্থিতিও এই প্রক্রিয়াকে ব্যর্থ করে। সর্বোপরি, ক্ষমা করার জন্য ক্ষমা প্রার্থনার প্রয়োজনীয়তা নেই, কারণ যিনি ক্ষমা প্রার্থনা করছেন এবং অপরাধী ব্যক্তি অর্থাৎ যাঁকে ক্ষমা করা হচ্ছে, ক্ষমা চাওয়ার মুহূর্ত থেকেই তাঁরা পৃথক মানুষ। আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু— যাঁর নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকায় কাজ করেছিল ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’— ক্ষমা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন জুলু প্রবাদবাক্যে ব্যবহৃত ‘উবুন্তু’ শব্দটি। ‘উবুন্তু’ সব মানুষের পারস্পরিক বন্ধনের কথা বলে। অপরাধী যখন অপরাধ করে, তা সব মানুষকেই মানবিকতা থেকে নীচে নামায়। ফলে ক্ষমা ভিক্ষা এবং ক্ষমা করা— এর মধ্যে দিয়ে উভয়েরই আবার মানবিক স্তরে উত্তরণ ঘটে। মহাভারতের বনপর্বে ক্রোধ, অক্রোধ ও ক্ষমা বিষয়ে দ্রৌপদীর সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের একটি দীর্ঘ বিতর্ক আছে। বলি-প্রহ্লাদের আখ্যান বিবৃত করে পাঞ্চালী যুক্তি দেন যে, বিরতিহীন ক্রোধ যেমন অশুভ, নিরবচ্ছিন্ন ক্ষমাও তেমনই অনিষ্টসাধক। এর উত্তরে তাত্ত্বিক দিক থেকে দ্রৌপদীর কথা মেনে নিয়েও যুধিষ্ঠির জানান যে, “ক্ষমাই ধর্ম... ক্ষমাই এই পৃথিবীকে ধারণ করে আছে।” বিতর্কের শেষাংশে যুধিষ্ঠির বলেন যে ক্ষমা তাঁকে ‘আশ্রয়’ করেছে। ক্ষমা যে সত্যিই তাঁকে ‘আশ্রয়’ করেছে, তা প্রমাণিত হয় যখন তিনি নিজে ক্ষমাপ্রার্থী হন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধান্তে নিদারুণ শোকগ্রস্ত গান্ধারী প্রশ্ন করেন, কেন তাঁর শত পুত্রের এক জনকেও পাণ্ডবেরা নিস্তার দেননি— যুধিষ্ঠির এগিয়ে এসে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। আমরা জানি, যুদ্ধের জন্য যুধিষ্ঠিরের দায়িত্ব অনেকের চেয়েই কম। কিন্তু তিনি অন্যদের কৃত অপরাধও নিজের বলে স্বীকার করে, সব পাপাত্মার মুখপাত্র হয়ে আনতশিরে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন গান্ধারীর কাছে। ক্ষমা করা যে শক্তিমানের শোভন কর্ম তা আমরা মানি, কারণ ‘সত্যপি সামর্থে পরাপকারসহনং ক্ষমা’ (প্রতিকারের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও পরের অপকার সহ্য করা হল ক্ষমা)। কিন্তু শক্তিমান যখন ক্ষমা ভিক্ষা করেন, তার মধ্যে থাকে এক বৃহত্ত্বের ব্যঞ্জনা, এক দার্ঢ্যের ইঙ্গিতও। এবং, সেই শক্তিমান মানুষ যদি হন শাসক, তবে এই ক্ষমা ভিক্ষার সঙ্গে যুক্ত হয় রাজধর্মের অনুষঙ্গ। যুধিষ্ঠিরের ক্ষমা ভিক্ষা তাই উত্তরপুরুষের জন্য এমন এক উপহার, যা মানুষকে মনুষ্যধর্মের পথে, এবং শাসককে রাজধর্মের পথে চলার দিশা দেখায়।
কিন্তু এই উপহারের ভার বহন করার সামর্থ্য আমাদের দেশের শাসকদের মধ্যে অধুনা অতি বিরল। আসলে এর মধ্যে বৃহতের যে ব্যঞ্জনা রয়েছে, সে থেকে ক্রমে দূরে সরে চলেছে আমাদের দেশ। আক্ষরিক অর্থে যা কিছু বৃহৎ, সে সবই এখন সদর্পে প্রদর্শিত হয়। ফলে আমরা পাই পৃথিবীর উচ্চতম মূর্তি, বিশ্বের বৃহত্তম স্টেডিয়াম, বুলেট ট্রেন চালনোর স্বপ্ন। দেশের প্রধানমন্ত্রী ৫৬ ইঞ্চি ছাতি বাজিয়ে অতিকায় সংসদ ভবন নির্মাণের কথা ঘোষণা করেন। পিছনে পড়ে থাকে দেশে ক্রমবর্ধমান দারিদ্র, অসাম্য, কর্মহীনতার মতো বিষয়। বিরুদ্ধ মত প্রকাশের স্বাধীনতা, নিজ ধর্মাচরণের, এমনকি পোশাক পরা বা খাদ্যগ্রহণের অধিকারটুকু নিষ্পেষিত হয় রাষ্ট্রযন্ত্রের দানবীয় প্রকরণে। বহিরঙ্গের আড়ম্বরের আড়ালে এই দেশ আজ ক্ষুদ্রের সাধনায় মগ্ন। সেই সাধনার প্রধান পুরোহিত যে ক্ষমা চাওয়াকে দুর্বলতার লক্ষণ বলে গণ্য করবেন, সে কি আর বিস্ময়ের কথা?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy