ছবি: সংগৃহীত।
প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে নির্মলা সীতারামন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিজেকে উন্নততর প্রমাণে সচেষ্ট হয়েছেন। ২০১৯-এর অন্তর্বর্তীকালীন বাজেটে তাঁর পূর্বসূরি যে সব অবাস্তব কাণ্ডের ছাপ রেখে গিয়েছিলেন এবং প্রকৃত খতিয়ানগুলি এড়িয়ে গিয়েছিলেন, তা অবশ্যই তাঁকে কিছু ভুল পদক্ষেপ করতে বাধ্য করে। নির্মলার প্রাথমিক কাজই ছিল সেই সব ভ্রান্তি দূর করা। সেই সঙ্গে হিসেব-বহির্ভূত খরচকে হিসেবের মধ্যে নিয়ে আসা। এর ফলে রাজস্বের আগমন এতটাই নিয়মিত এবং দ্রুততর হয় যে, করদাতারা বিস্মিত হন। পাশাপাশি, বাজেট তৈরির ক্ষেত্রেও অনেক বেশি স্বচ্ছতা তৈরি হয়। কর নির্ধারণের প্রক্রিয়াকে ব্যক্তিগত স্তর থেকে বার করে এনে তার ‘ডিজিটাইজেশন’ এবং তা আরও বেশি স্বচ্ছ করে তোলার কাজটিও নির্মলা সম্পন্ন করেন। নিয়মিত কর আদায় পরিচালনার বিষয়টি দীর্ঘকাল ধরে দুর্নীতিগ্রস্ত এবং হয়রানির ক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিশেষত নির্মলার মহান পূর্বসূরিদের দৌলতে। বর্তমান অর্থমন্ত্রী সেই প্রক্রিয়া অনেক বেশি মসৃণ করে তুলেছেন। দুর্ভাগ্যবশত বৃহত্তর কর আদায় সংক্রান্ত ব্যাপারে তাঁর সাফল্য ছিল সীমিত (এবং সেই কারণে অপর্যাপ্ত)। একপ্রকার আপস-রফার মধ্য দিয়ে ওই সংক্রান্ত অসংখ্য সমস্যার সমাধানের চেষ্টা তাঁকে করতে হয়েছিল।
ওই সংক্রান্ত পরিবর্তন পণ্য ও পরিষেবা সংক্রান্ত কর (জিএসটি) পর্যন্ত গড়ায়। জিএসটি-র বিষয়টি এতকাল কর ও গড় জাতীয় উৎপাদন অনুপাতের (জিডিপি) বৃদ্ধি ও সর্বোপরি জিডিপি-র বিবর্ধনের প্রাথমিক প্রতিশ্রুতিকে মিথ্যায় পর্যবসিত করে রেখেছিল। কিন্তু ই-ইনভয়েসিং, আধার এবং আয়কর ফাইলিংয়ের মধ্যে যোগসাধন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে নকল চালান ঘটিত জটিলতা এবং কর ফাঁকি দেওয়ার সমস্যাগুলির সমাধান করতে সমর্থ হন নির্মলা। সেই কাজ অবশ্য এখনও চলছে। কারণ, জিএসটি সংগ্রহ দীর্ঘ চার বছর পরে এক উৎসাহব্যঞ্জক স্তরে পৌঁছেছে বটে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনও বড় রকমের লাফ তার মধ্যে দেখা যায়নি। এই কাজ আরও বেশি মাত্রায় করা সম্ভব হবে তখনই, যখন প্রয়োগযোগ্য হারে বিষয়টির বিন্যাস সম্পন্ন হবে এবং পূর্ব প্রতিশ্রুতি মোতাবেক রাজস্ব-নিরপেক্ষ হারে তাকে ফিরিয়ে আনা যাবে।
বর্তমান অর্থমন্ত্রীর উপর ভাগ্যলক্ষ্মী সুপ্রসন্ন। এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে করসংগ্রহ, বিশেষত কর্পোরেশন কর, কর্পোরেট ব্যবসায় লাভের তরঙ্গে তা প্রতিফলিত। এর কারণ বড় প্রতিষ্ঠানগুলি অতিমারি পরিস্থিতিতে ব্যয়সংক্ষেপ করে, সুদপ্রদানকেও সীমায়িত রাখে। ব্যক্তিগত আয়কর সংগ্রহও অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় বৃদ্ধি পায়। রাজ্যগুলিতে এই সময়ে চালু হওয়া লকডাউন গত ত্রৈমাসিকে তেমন একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি। যতখানি গত বছর প্রথম ঢেউয়ের কালে জাতীয় স্তরে লকডাউন ফেলেছিল। এই সব প্রবণতার ফলে ২০২০-২০২১ সালের সরকারি বার্ষিক হিসেবে বাজেট পেশের সময় উল্লিখিত হিসেবের তুলনায় কিছুটা আশাব্যঞ্জক পরিসংখ্যান দেখিয়েছে। চলতি আর্থিক বছরের শেষে এই আশাব্যঞ্জক প্রবণতা বজায় থাকতেই পারে। যদি সার্বিক ভাবে রাজস্ব ব্যবস্থা আংশিক চাপে থাকে। কারণ অর্থমন্ত্রী তাঁর হাতে থাকা যাবতীয় কর আদায়ের প্রক্রিয়া প্রয়োগ করতে চাইছেন না।
যেহেতু অর্থমন্ত্রী যাবতীয় সরকারি আর্থিক বিষয়ের প্রধান অছি, তাঁর প্রাথমিক কর্তব্যই হল প্রধানতম অর্থনৈতিক গতিছন্দকে অর্থাৎ অর্থনীতির বিকাশ, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা (মূলত পণ্যমূল্যের) ইত্যাদি ধরে রাখা। জিডিপি বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণীগুলির প্রবণতা তার পুনরুজ্জীবনের কথাই জানায়। যদিও সেই পুনরুজ্জীবনের চরিত্র এই বছর তুলনামূলক ভাবে ধীরগতির হবে বলে প্রাথমিক ভাবে জানানো হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তা দ্রুত হবে, এমন আশা করাই যায়। এর পরবর্তী বৃদ্ধি বা বিকাশের বিষয়ে প্রশ্নগুলি কিন্তু ঝুলেই থাকছে। বহির্জগতে ভারত বেশ স্বচ্ছন্দ পরিস্থিতিতেই রয়েছে। যার পিছনে রয়েছে পর্যাপ্ত বৈদেশিক বিনিময় তহবিলের পরিমাণ এবং চলতি হিসেবে ঘাটতির সহনীয় মাত্রা।
কিন্তু এর পরেও যা দুশ্চিন্তা, তা হল পাইকারি পণ্যমূল্যের দুই অঙ্কের বৃদ্ধি এবং আর্থিক নীতির জন্য নির্ধারিত পণ্যের খুচরো মূল্যের বৃদ্ধি। এই দুইয়ের পিছনেই রয়েছে আবিশ্ব পণ্যমূল্য বৃদ্ধি এবং পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে সঙ্কোচন। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম দ্রুত কমলে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু সরকারি ভাবে আশা করা হচ্ছে, মূল্যবৃদ্ধির এই পরিস্থিতির খানিক উন্নতি ঘটতে পারে তৃতীয় ত্রৈমাসিকের সময়।
রাজস্ব-প্রশাসন ও বৃহত্তর অর্থনৈতিক প্রেক্ষিত থেকে দেখলে জোড়াতালি দেওয়া হলেও এই উৎসাহব্যঞ্জক পরিস্থিতি, বিশেষত এই অতিমারি পরিস্থিতিতে কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ নেতিবাচক নীতিকে সামনে না নিয়ে এলে, অসম্পূর্ণ থেকে যায়। যার মধ্যে একটি হল বেসরকারিকরণের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম কার্যকারিতা প্রদর্শন। আরেকটি বিষয় ব্যাঙ্কিং-ঘটিত জটিলতার সঠিক সমাধানে ব্যর্থতা। তৃতীয় বিষয়টি অতিমাত্রায় সংরক্ষণ-প্রবণতা, যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শুল্ক হ্রাস বন্ধ করার প্রস্তাব। পরিশেষে, এনফোর্সমেন্ট বিভাগ এবং আয়কর বিভাগের গোয়েন্দাদের সরকারের বিরোধীপক্ষ ও সমালোচকদের পর্যুদস্ত করতে অপব্যবহারের প্রবণতাও সমস্যার সৃষ্টি করছে। প্রশ্ন এখানেই যে, এই চৌকিদারবৃত্তি থেকে রাজনীতিকে মুক্ত রাখলে কি সার্বিক মঙ্গল হয় না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy