কয়েক দিন আগে একটি পারফর্ম্যান্স আমাকে হতবাক করে দিয়েছে। ভাল অভিনয় বলে নয়, বরং তাতে ভালত্বের কিছুই ছিল না। কিন্তু এই পারফর্ম্যান্স সফল। কারণ, অভীষ্ট নির্দিষ্ট শ্রোতা/দর্শকেরা তা দেখে হেসেছেন, তাঁদের আসল চেহারা বেরিয়ে এসেছে। ওই পারফর্ম্যান্সে আমার মন ভেঙে গিয়েছে, কারণ, দেশের সবচেয়ে শ্রদ্ধার পদে যিনি আসীন, তিনি এক জন প্রতিবন্ধী সাংবাদিককে নকল করে দেখিয়েছেন এবং তাতে কিছু লোক হেসেছে। আমার মন-মাথা থেকে এটা কিছুতেই সরাতে পারছি না, কারণ, এই পারফর্ম্যান্স সেলুলয়েডে ঘটেনি, বাস্তবে ঘটেছে। যিনি তা করলেন, তিনি জানতেন যে ওই সাংবাদিক, পদে, শক্তিতে তাঁর চেয়ে অনেক পিছনে— প্রত্যাঘাতের কোনও ক্ষমতাই তাঁর নেই। এবং তিনি কাজটা করেছেন প্রকাশ্যে। কোনও শক্তিধর এ কাজ করলে অন্যরাও তা করার অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে যায়। চিন্তা সেখানেই। শক্তিধরেরা যখন নিজেদের পদ, ক্ষমতা ব্যবহার করে অন্যদের ভয় দেখায়, দাবিয়ে রাখে, তা আমাদের সবারই পরাজয়।”
যে বক্তৃতা থেকে এই অংশটা তুলে দিলাম, তাতে আরও বলা হয়েছিল— সে দেশের সবচেয়ে সরকার-সমালোচিত, সরকার-নিন্দিত তিন পক্ষই ওই প্রেক্ষাগৃহে আছে। তারা কারা? সাংবাদিক, অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং বিদেশি (আসলে অভিবাসী)-ভরা হলিউড, বক্তার কথায় যে তথাকথিত বিদেশিদের বার করে দিলে শিল্পকলা সে দেশ থেকে উধাও হয়ে যাবে। বক্তা সেই অভিবাসী অভিনেতাকুলের নাম ধরে ধরে তির্যক স্বরে বলেছিলেন “হোয়্যার ইজ় ইয়োর বার্থ সার্টিফিকেট?”
বক্তৃতার মূল সুরটা চেনা লাগছে?
২০১৭ সাল। আমেরিকায় তখন ‘বিদেশি’ হটাও রব উঠেছে, সংবাদপত্র বা টেলিভিশন চ্যানেলে পছন্দের রিপোর্ট না হলেই তা ‘ইয়েলো জার্নালিজ়ম’ বা ‘পেড নিউজ়’ বা ভুয়ো খবর, সাংবাদিক, অভিবাসী (কারও চোখে ঘোর বিদেশি) এবং হলিউডের একাংশ তখন আক্রমণের মুখে। গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কারপ্রদান অনুষ্ঠানে অভিনেত্রী মেরিল স্ট্রিপ দিয়েছিলেন এই বক্তৃতা। হোয়াইট হাউসে তখন কে আসীন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সত্যকে সহজে গ্রহণ করার সাহস আমাদের অনেকেরই নেই। আমরা বড় শাসক হই বা মেজো শাসক বা ছোট শাসক বা শাসকের প্রহরী, বা নিদেনপক্ষে শাসকের ঘরের কোণ মোছার ন্যাতাধারী, নিজস্ব একটি বৃত্তে এক সময়ে আমরা সবাই রাজা। রাজার পায়ে যে ধুলো, তাতে বিষ্ঠা থাকলেও সে রাজধুলো। ক্ষমতার গণতন্ত্র সর্বব্যাপী। ফলে শাসককুল যে দর্প দেখাবে, সত্য প্রকাশ করলে সে গলা টিপে ধরবে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার খুব কিছু নেই। বরং ক্ষমতার নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশই যুগধর্ম।
এখানে আবার একটা মজাও আছে। আমার গণতন্ত্র, তোমার গণতন্ত্র, আমার সাংবাদিক, তোমার সাংবাদিক, আমার মত প্রকাশের স্বাধীনতা বনাম তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতা। বড় রাজা যখন সত্যবাদীকে শূলে চড়াবেন, মেজো রাজা বলবেন, অহো কী দুঃসহ স্পর্ধা; আবার নিজের রাজত্বে তিনিই সত্যকে ধরবেন গলা টিপে। ছোট রাজা আবার দুই রাজারই নিন্দেমন্দ করে বিদ্রোহী হবেন, কিন্তু তলে তলে নিজের রাজত্বে সত্যকে সম্মার্জনী দিয়ে বিদেয় করবেন। দলমত নির্বিশেষে সত্য, তথ্য লুকোতে সব শাসকই সমান পারদর্শী। সদা সত্য কথা বলিলে হাতে বা ভাতে মৃত্যু অনিবার্য। তাই কোনও রাজ্যে নদীর চরে করোনায় পুঁতে দেওয়া দেহের ছবি, খবর প্রকাশ করলে আয়করের শূলে চড়ানো হবে; মিড-ডে মিলে রুটি-নুন দেওয়ার খবর লিখলে তা রাষ্ট্রদ্রোহ; আবার কোনও রাজ্যে প্রাকৃতিক প্রলয়ের পরে ক্ষতিপূরণ বণ্টনে অনিয়মের কথা লিখলে তা রাজকালিমা লেপনের অপচেষ্টা বলে গণ্য হবে। সব নিখুঁত, সব সুন্দর। রাজার কোনও দোষ নেই। রাজা উলঙ্গ বললে তো কথাই নেই, শাসকের কাপড়ে একটি সুতো উঠলেও তা বলা ঝুঁকির। সত্যই সেলুকাস, কী বিচিত্র এই সত্য।
রক্তকরবী-তে বিশু পাগলাকে হাতকড়ি পরিয়ে যখন নিয়ে যাচ্ছে প্রহরী, তখন তাকে দেখল নন্দিনী।
নন্দিনী। কী দোষ করেছ যে এরা তোমাকে বেঁধে নিয়ে চলেছে।
বিশু। এতদিন পরে আজ সত্যকথা বলেছিলুম।
নন্দিনী। তাতে দোষ কী হয়েছে।
বিশু। কিচ্ছু না।
নন্দিনী। তবে এমন করে বাঁধলে কেন।
বিশু। এতেই বা ক্ষতি কী হল। সত্যের মধ্যে মুক্তি পেয়েছি— এ বন্ধন তারই সত্য সাক্ষী হয়ে রইল।
নন্দিনী। ওরা তোমাকে পশুর মতো রাস্তা দিয়ে বেঁধে নিয়ে চলেছে, ওদের নিজেরই লজ্জা করছে না? ছি ছি, ওরাও তো মানুষ!
বিশু। ভিতরে মস্ত একটা পশু রয়েছে যে— মানুষের অপমানে ওদের মাথা হেঁট হয় না, ভিতরকার জানোয়ারটার লেজ ফুলতে থাকে, দুলতে থাকে।
নন্দিনী। আহা পাগলভাই, ওরা কি তোমাকে মেরেছে। এ কিসের চিহ্ন তোমার গায়ে।
বিশু। চাবুক মেরেছে, যে চাবুক দিয়ে ওরা কুকুর মারে। যে রশিতে এই চাবুক তৈরি সেই রশির সুতো দিয়েই ওদের গোঁসাইয়ের জপমালা তৈরি। যখন ঠাকুরের নাম জপ করে তখন সে কথা ওরা ভুলে যায়, কিন্তু ঠাকুর খবর রাখেন।
আর সেই যক্ষপুরীতে নন্দিনী দেখেছিল ‘রাজার এঁটো’দের। তারই গ্রামের সব প্রাণচঞ্চল লোকজন, আর যখন সে দেখল, তখন ‘কিন্তু এ-সব কী চেহারা! ওরা কি মানুষ! ওদের মধ্যে মাংসমজ্জা মনপ্রাণ কিছু কি আছে!
সর্দার। হয়তো নেই।
নন্দিনী। কোনোদিন ছিল?
সর্দার। হয়তো ছিল।
নন্দিনী। এখন গেল কোথায়?
সত্যিই তো, গেল কোথায়?
আসলে আধুনিক যক্ষপুরীতে স্বেচ্ছায় ‘রাজার এঁটো’ হওয়ার প্রলোভন, এবং শাসানির অভাব নেই। তেমনই আছে বিশু পাগলারা। গ্রামেগঞ্জে, পাহাড়ে, এ দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় অনেক বিশু পাগলা আছে, নন্দিনী আছে যারা বলতে পারে ‘সত্য কথা বলেছিলুম’। চতুর্থ স্তম্ভের কাজও সেটাই।
পেগাসাস আড়ি পাতা কাণ্ডের সূত্রে আসছে আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির স্মৃতি। অনেকেই মনে করাচ্ছেন তৎকালীন আমেরিকায় ওয়াশিংটন পোস্ট বা নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদনগুলোর কথা। ১৯৭১ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধ সংক্রান্ত সরকারি গোপন নথি প্রকাশ করা নিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট-কে সুপ্রিম কোর্টে নিয়ে গিয়েছিল তৎকালীন আমেরিকান সরকার। পেন্টাগন পেপারস নামে খ্যাত সেই নথি প্রকাশ করা হবে কি না, তা ঘিরে সংবাদপত্রের সর্বোচ্চ মহলেই চলেছিল তুমুল তর্কবিতর্ক। সেই ঘটনাকে ভিত্তি করে তৈরি ফিল্ম দ্য পোস্ট-এ, প্রবাদপ্রতিম সম্পাদক বেন ব্র্যাডলি বলেছিলেন, “ওদের ক্ষমতায় লাগাম পরানোর কাজটা তো আমাদের। আমরা যদি সরকারকে তাদের অপকর্মের জন্য দায়ী না করি, আর কে করবে?” আর ওই সংবাদপত্রের পক্ষে রায় দেওয়ার সময় এক বিচারকের বক্তব্য ছিল, “গণতন্ত্রে নিজেদের যথাযথ ভূমিকা পালন করার জন্য স্বাধীন সংবাদপত্রকে যে রক্ষাকবচ দেওয়া দরকার, সংবিধান প্রণেতারা তা দিয়ে গিয়েছেন। সংবাদপত্রের কাজ শাসকের সেবা করা নয়, প্রশাসিতের সেবা করা।”
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্পর্কিত মামলায় মাদ্রাজ হাই কোর্টের বিচারপতি পি এন প্রকাশ যেমন বলেছেন, “ফোর্থ এস্টেট তথা সংবাদপত্র ভারতীয় গণতন্ত্রের অপরিহার্য অঙ্গ। যদি তার কণ্ঠরোধ করা হয়, ভারত একটি নাৎসি রাষ্ট্র হয়ে উঠবে এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং সংবিধান প্রণেতাদের কঠিন পরিশ্রম বিফলে যাবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy