Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Indian Constitution

সংরক্ষণ হোক আর্থিক ভিত্তিতেই

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, যদি কদাচিৎ অনগ্রসর শ্রেণির কোনও ছেলেমেয়ে সরকারি চাকরি পান, তা হলে তাঁদের পরিবার আদৌ উপকৃত হয় না।

সংবিধান প্রণেতারা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে।

সংবিধান প্রণেতারা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে। প্রতীকী ছবি।

অমলকুমার মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২২ ০৫:৪৭
Share: Save:

মূল ভারতীয় সংবিধানে ছিল দু’টি ধারা— ১৬(৪) ও ৩৩৫। প্রথমটিতে বলা হয়েছিল যে, অনগ্রসর শ্রেণির জন্য সরকারি চাকরিতে পদ সংরক্ষণ করতে হবে; দ্বিতীয়টিতে বলা হয়েছিল, প্রশাসনের উৎকর্ষ ব্যাহত না করে তফসিলি জাতি ও জনজাতির জন্য কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ করা যাবে। পরবর্তী কালে ১৯৯৩ সালের ইন্দ্র সাহনি মামলায় সুপ্রিম কোর্ট দু’টি নির্দেশ দেয়। এক, শুধু সামাজিক ভাবে অনগ্রসরদের ক্ষেত্রে ১৬(৪) ধারা প্রযোজ্য হবে; দুই, কোনও অবস্থাতেই সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ পঞ্চাশ শতাংশের বেশি করা যাবে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায় নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক। কারণ, এই রায়ে তথাকথিত ‘জেনারেল ক্যাটেগরি’র অর্থনৈতিক দিক থেকে পশ্চাৎপদ শ্রেণির জন্য দশ শতাংশ সংরক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এত দিন ধরে তফসিলি জাতি, জনজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। এই প্রথম ‘জেনারেল ক্যাটেগরি’র জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তৃতীয়ত, পঞ্চাশ শতাংশের উপর আরও দশ শতাংশ সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। এই তিন ক্ষেত্রেই ইন্দ্র সাহনি মামলার রায়ের বিরোধিতা করা হয়েছে। সেই জন্যই এই রায় ঐতিহাসিক।

সংবিধান প্রণেতারা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সংবিধান প্রবর্তনের পর বিগত বাহাত্তর বছর পরে এই সামাজিক ন্যায় আদৌ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। ৩৩৫ ধারা যে উৎকর্ষের শর্ত আরোপ করেছিল, তার তোয়াক্কা না করে নির্বিচারে পদ সংরক্ষণ করা হয়েছে ক্রমাগত। আজকের এই তীব্র বেকারত্বের যুগে তথাকথিত উচ্চবর্ণের যোগ্য প্রার্থীরা সরকারি চাকরি না পেয়ে চোখের জল ফেলে চলেছেন। অন্য দিকে, তফসিলি জাতি ও জনজাতিদের অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি। সংরক্ষণের সুবিধা পেয়ে চলেছে এদের সম্পন্ন শ্রেণি, অর্থাৎ, বড় বড় সরকারি চাকুরেদের ছেলেমেয়েরা। অন্য দিকে, অর্থনৈতিক দিক থেকে নিতান্ত দুর্বল তফসিলি জাতি ও জনজাতি যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই পড়ে রয়েছে। ইন্দ্র সাহনি মামলায় এদের (‘ক্রিমি লেয়ার’) সংরক্ষণের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত ‘ক্রিমি লেয়ার’ কারা, তা নির্ধারিত হয়নি। কাজেই সংরক্ষণের সুবিধা দেওয়া হয়েছে অবাধে।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, যদি কদাচিৎ অনগ্রসর শ্রেণির কোনও ছেলেমেয়ে সরকারি চাকরি পান, তা হলে তাঁদের পরিবার আদৌ উপকৃত হয় না। কারণ, এই কৃতী ছেলেমেয়েরা তাঁদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। অন্য দিকে, তাঁদের বাপ-ঠাকুর্দার পেশায় তাঁরা স্বভাবতই আর যুক্ত হন না। এই অবস্থাটা বেশি দেখা যায় কৃষিকর্মের ক্ষেত্রে। ধরা যাক, তাঁদের পরিবার জমি চাষের কাজে নিযুক্ত। কিন্তু বার্ধক্যের জন্য তাঁরা এই কাজে অক্ষম হয়ে পড়লেন। তখন তাঁদের অন্নসংস্থান কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে কৃষি-উৎপাদন যে ব্যাহত হয়, সে কথাও উল্লেখ করা প্রয়োজন।

কোনও সরকার বা রাজনৈতিক দলই এ নিয়ে মাথা ঘামায় না। পক্ষান্তরে সংবিধানের ১ (৪) ধারা বার বার সংশোধন করে পশ্চাৎপদ শ্রেণির সংরক্ষণ অনেক সহজ ও সুবিধাজনক করা হয়েছে। এ বিষয়ে সংসদে কোনও রাজনৈতিক দলকেই কখনও বিরোধিতা করতে দেখা যায়নি। কারণটা নিতান্তই স্পষ্ট। তফসিলি জাতি, জনজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি মিলে এ দেশে বড় এক ভোটব্যাঙ্ক, এবং এই ভোটব্যাঙ্কের সুবিধা নিতে সব দলই আগ্রহী। তাই ভোট পাওয়ার স্বার্থে তারা সকলেই দরাজ হাতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে সতত ব্যস্ত। সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য আজ বিস্মৃত— সব দলই ভোট দখলের স্বার্থে সংরক্ষণকে কার্যকর মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করে চলেছে। ভোটসর্বস্ব রাজনীতির প্রাবল্যে ন্যায়বিচারের আদর্শ আজ ভূলুণ্ঠিত। ফলে এক অর্থে ভারতীয় সমাজ আজ চরম সঙ্কটের মুখোমুখি।

এই সঙ্কটের আবর্ত থেকে পরিত্রাণের উপায় রাজনৈতিক দলগুলির কাছ থেকে আশা করা বৃথা। এ জন্য একমাত্র আশা-ভরসার স্থল হল সুপ্রিম কোর্ট। উচ্চ আদালত ইতিমধ্যেই এক কদম এগিয়ে গিয়েছে সাম্প্রতিক রায়ে অর্থনৈতিক দিক থেকে পশ্চাৎপদতার বিষয়টি উত্থাপন করে। আশা করব, সুপ্রিম কোর্ট আরও এগিয়ে যাবে। যা হওয়া প্রয়োজন তা হল, জাতপাতের ভিত্তিতে সংরক্ষণ ব্যবস্থা তুলে দিয়ে শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকে অনগ্রসর শ্রেণির জন্য (জাতপাত ও বর্ণ নির্বিশেষে) সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। সে ক্ষেত্রে আমাদের দেশে ন্যায়বিচারের আদর্শ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। তবে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার জন্য একমাত্র আদালতই আমাদের ভরসা।

অন্য বিষয়গুলি:

Indian Constitution Supreme Court EWS
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy