আন্তর্জাতিক সীমান্তরেখা থেকে ১৫ কিলোমিটার ভিতর পর্যন্ত বিএসএফ-এর টহল দেওয়ার কথা। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সেই পরিধি বাড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গ, পঞ্জাব ও অসমে আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত কাজ করার ক্ষমতা দিয়েছে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীকে। রাজ্য সরকার তার প্রতিবাদ করেছে, যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো লঙ্ঘন হচ্ছে বলে।
উঠতে পারে একটা অন্য প্রশ্নও। ‘সীমান্তের সুরক্ষা’ বললেই মনে ভেসে ওঠে কাঁটাতারের বেড়া, আর তার সামনে টহলরত সশস্ত্র জওয়ান। কিন্তু যেখানে সীমান্ত নির্দেশ করে নদী? পশ্চিমবঙ্গে ৫২টি ‘ট্রান্সবাউন্ডারি’ নদী আছে। ‘সীমানাদিহী খাম্বা’-র মতো বুক চিতিয়ে থাকে সে সব নদী। নদীর যে অংশ সীমান্ত থেকে একটু দূরে থাকে, সেখানে গোল পেঁচানো কাঁটাতারের বেড়া দেয় বিএসএফ। কিন্তু নদী যখন সীমান্তের একেবারে লাগোয়া থাকে, তখন নদী আর তীরবর্তী জনবসতির মাঝে ফাঁকা জায়গা থাকে কম। তখন কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া সম্ভব হয় না। খোলা আকাশের তলায় সীমান্ত পাহারা দেয় একলা নদী। তাই পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে বিএসএফ-এর এক্তিয়ারভুক্ত এলাকা বৃদ্ধি করলেই সুরক্ষা হাতের মুঠোয় চলে আসবে, এমন ভাবার যুক্তি কতটুকু? বাংলার ভৌগোলিক অবস্থানে নদীকে নিয়ন্ত্রণ করা সীমান্ত প্রহরীদের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ।
যেমন মাথাভাঙা নদী। এক দিকে নদিয়ার শিকারপুর, আর অন্য দিকে বাংলাদেশ। শিকারপুরের কাছে পদ্মা থেকে উৎসারিত হয়ে সামান্য পথ চলার পর নদী ঢুকে পড়ে বাংলাদেশে। বানপুর মাটিয়ারি পঞ্চায়েতের সীমানাকে স্পর্শ করে আবার নদীর ভারতে প্রবেশ। তার পর পাবাখালির কাছে গিয়ে মাথাভাঙা দুটো ভাগে ভাগ হয়। একটা ইছামতী, আর অন্য ধারাটি চূর্ণি।
মাথাভাঙা তার গতিপথ বার বার পরিবর্তন করেছে— অতীতে দেশের ভাগাভাগি না থাকায়, সমস্যা হয়নি। উনিশ শতকে কখনও মাথাভাঙা ও জলঙ্গি নদী দু’টির উৎসমুখ এক হয়ে গিয়েছে, কখনও আবার কোনও বন্যায় একে অন্যের থেকে দূরে সরে গিয়েছে। ১৮৫৯ মাথাভাঙায় জলের জোগান বজায় রাখতে পদ্মা থেকে পাঁচটি খাল কেটে যুক্ত করে দেওয়া হয় মাথাভাঙার সঙ্গে। ১৮৭১ সালে বন্যার পলিতে খালগুলো বুজে যায়। এমন লাগাতার চলেছে। ২০০৪-০৫ সালে মাথাভাঙার সঙ্গে পদ্মার কোনও যোগ ছিল না। কিন্তু বর্তমানে পদ্মার জল ঢুকছে মাথাভাঙায়। নদী যেখানে যেখানে চঞ্চল, সেখানে সীমান্তও অস্থির। কোচবিহারের সিতাই, মুর্শিদাবাদের টলটলির পদ্মা, দত্তপুলিয়া ও বসিরহাটের কাছে ইছামতী, দক্ষিণ দিনাজপুরের হিলির কাছে যমুনা এমন চঞ্চল সীমান্তের উদাহরণ।
নদীর ধারে বাস, চিন্তা বারো মাস। সীমান্ত-নদীর বন্যা, ভাঙন, সব কিছুর প্রভাব পড়ে নদী পারের মানুষদের উপর। নদী-লাগোয়া গ্রামগুলোতে অল্পবয়সি ছেলেদের চোখেই পড়ে না। অধিকাংশ গ্রামছাড়া, গ্রামে কাজ নেই। একশো দিনের কাজ পঞ্চায়েত থেকে পাওয়া যায়। কিন্তু ওই অল্প টাকাতে তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ নেই। সেই কাজ করতে যাঁরা যান, তাঁদের গড় বয়স কম-বেশি পঞ্চাশ। তাঁদের দিয়ে আবার একশো দিনের কাজ করাতে চায় না সীমান্তের প্রহরীরা, কারণ তাঁদের সময় বেশি লাগে। তবুও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা চালাচালির পর গ্রামবাসীরা কাজ করতে গেলে নানা ভাবে হেনস্থার সম্মুখীন হতে হয়। ভোটার কার্ড জমা রেখে, খাতায় সই, না হলে টিপছাপ দিতে হয়। ‘বডি সার্চ’-এর নাম করে বিশ্রী ভাবে গায়ে হাত দেওয়া হয়। বাহান্ন বছরের পার্বতী মণ্ডলের এমন অভিজ্ঞতা অনেক বার হয়েছে। কিন্তু নিরুপায় পার্বতী। ছেলে কাঠের কাজ করতে আন্দামানে। স্বামী কর্মক্ষমতা হারিয়ে বাড়িতে। একশো দিনের কাজের টাকাটা তাঁর অবলম্বন।
সীমান্তের বহু মানুষের কাছে রোজগার মানে চোরাচালান, না হলে দূর দেশে কাজ জুটিয়ে অন্নসংস্থান। চোরাচালানকারী আর বিএসএফ-এর মধ্যে একটা চোখ পিটপিট-করা সম্পর্ক রয়েছে। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে কখনওই নির্মূল করে না। কিছুটা দমিয়ে রাখে, আবার কিছুটা ছাড় দেয়, বলছেন সীমান্তের সমস্যা নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার ও পরিবেশ কর্মীরা। মূলত শিশু আর বয়স্ক মহিলা পাচারকারীদের ‘সফট টার্গেট’। ফেন্সিডিল সিরাপ বা মদের বোতল পাচার করতে গিয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত বাহিনী বিডিআর-এর হাতে ধরা পড়েন অনেকে। পরিবারের লোকজন এসে কান্নাকাটি জুড়ে দেয়। কাজেই বিডিআর-এর সঙ্গে ‘হোয়াইট ফ্ল্যাগ মিটিং’ করে ছাড়িয়ে আনতে হয় বিএসএফ-কেই। ঘন ঘন ফ্ল্যাগ মিটিং হলে উপরমহলে জবাবদিহি করতে হয় কোম্পানি কমান্ডারকে।
এত বছরে এ কথা স্পষ্ট যে, নদী যেখানে সীমান্তের প্রহরী, সেখানে চোরাচালান আটকানো কঠিন কাজ। সীমান্ত লাগোয়া গ্রামের মানুষগুলোর জীবন যাপনের মানের উন্নতি দরকার। বিকল্প রোজগার নিয়ে কথা বলা হয় অনেক, কাজ হয় সামান্যই। স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নতি, সরকারি প্রকল্পগুলোকে আরও সাফল্যের সঙ্গে পৌঁছে দেওয়া দরকার সীমান্তের গ্রামগুলোতে।
সেগুলি কতটা কার্যকর হচ্ছে, তা বুঝতে ‘সোশ্যাল অডিট’ করা দরকার। সীমান্ত, নদী ও তার সঙ্গে জুড়ে থাকা মানুষগুলোর সুরক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশেরও সুরক্ষা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy