এই ইতিহাস আমাদের জানা থাকলেও চেনা নয়। গোদাবরী, নর্মদা পেরিয়ে যে ভারত, তাকে আমরা যতটা জানি, চিনি ততটা নয়। তাই সালঙ্কারা হয়ে সেই ইতিহাস যখন এসে দাঁড়ায় আমরা অবাক হই, মুগ্ধ হই, সমৃদ্ধ হই।
পোন্নিয়ান সেলভেন বক্স-অফিসের মাপকাঠিতে সর্বোচ্চ স্থানে, এই তথ্যের আলাদা করে হয়তো গুরুত্ব নেই, কারণ ক্যালেন্ডারের মাসতারিখে পরিবর্তিত হতে থাকে এই হিসাব। কিন্তু যে গুরুত্বের খতিয়ানের দিকে চোখ ফেরাতেই হবে, তা হল সম্পূর্ণ ভাবে দাক্ষিণাত্যের ইতিহাস যে চলচ্চিত্রের মূল বিষয়বস্তু, তা চৌকাঠ পেরিয়ে অনায়াসে প্রবেশ করেছে আমাদের ঘরে।
চলচ্চিত্রে দাক্ষিণাত্যের আগ্রাসন নিয়ে আলোচনা কম হয়নি। এ ক্ষেত্রে কিন্তু বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। দক্ষিণী সিনেমার কলাকৌশল চাকচিক্য হয়তো আছেই পোন্নিয়ান সেলভেন-এ, অনেক দক্ষিণী তারকারা আছেন, স্বয়ং মণিরত্নমও আছেন। কিন্তু তার থেকেও বেশি করে আছেন কালকি। রামস্বামী কৃষ্ণমূর্তি (ছবি), যাঁর ছদ্মনাম কালকি, পোন্নিয়ান সেলভেন-এর লেখক— এইটুকু পরিচয়ে বলা হয় না কিছুই। বাজারি অর্থনীতির ভাষায় বলতে গেলে, কালকি ছিলেন স্বাধীনতা-উত্তর তামিল সাহিত্যের এক ‘ব্র্যান্ড’। লেখক নিজে, তাঁর প্রকাশিত কালকি পত্রিকা ছিল সে সময়ের সাহিত্যের মুখ। ধর্মনির্ভর, ধর্মীয় চরিত্রনির্ভর তামিল সাহিত্যে রচিত হয়েছিল প্রকৃত ঐতিহাসিক সাহিত্য। চোল রাজাদের নিয়ে পোন্নিয়ান সেলভেন এবং পল্লব রাজাদের নিয়ে সিবাগামিয়ান শপথম তাঁর কাজের মধ্যে অন্যতম।
চোল রাজবংশের স্বর্ণযুগের আগের সময়, মোটামুটি একাদশ শতাব্দীর প্রেক্ষাপটে রচিত হয় পোন্নিয়ান সেলভেন। যে চোল রাজার কথা আমরা মূলত জানি, সেই রাজারাজা চোলের প্রপিতামহ কারান্থিকারের সময় থেকে শুরু হয় পোন্নিয়ান সেলভেন-এর গল্প। তার পর সেই ইতিহাস কাবেরীর পথ ধরে তাঞ্জাভুর, শ্রীলঙ্কা অবধি যাত্রা করে।
যে কোনও ইতিহাসনির্ভর সাহিত্যের মতোই, কিছু চরিত্র এখানে একেবারে কাল্পনিক, আবার কোনও চরিত্র মেনে চলেছে ইতিহাসের চলন। গল্পের অন্যতম চরিত্র, পোন্নিয়ান সেলভেন বা অরুণমোঢ়ি বর্মণ পরবর্তী কালে হয়ে ওঠেন চোলবংশের অন্যতম বিখ্যাত শাসক রাজারাজা চোল। তাঁর বোন কুন্দাবাই বা তাঁর পিতামহী সেম্বিয়ান মহাদেবীও ঐতিহাসিক চরিত্র, যেমন তাঁর বিরোধী মধুরান্তকন থেভান ঐতিহাসিক চরিত্র উত্তমচোল। গল্পের অন্যতম নায়ক ভাল্লাভারায়ন ভান্দিয়াথেভানও চোলসাম্রাজ্যের এক খ্যাতনামা যোদ্ধা। কিন্তু পর্বতেশ্বর, নন্দিনী বা নাম্বির চরিত্র লেখকের কল্পনার সৃষ্টিমাত্র।
পাঁচটি পর্বে রচিত এই ঐতিহাসিক উপন্যাস জনপ্রিয়তার শিখর স্পর্শ করে। অর্ধশতাব্দী অতিক্রান্ত হলেও জনপ্রিয়তা টাল খায়নি এতটুকু। তাই চলচ্চিত্রায়নের সংবাদেই উত্তেজনা ছিল যথেষ্ট, মুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই সারা বিশ্বের ব্যবসায়িক সাফল্যের ইতিহাস সৃষ্টি হয়। মনে রাখা ভাল, স্বাধীনতা-উত্তর তামিল সাহিত্যে কালকির সমসাময়িক ছিলেন এক চিত্রনাট্যকার, সাহিত্যিক এবং পরে রাজনীতিবিদ মুখ্যমন্ত্রী, যিনি একাধারে লিখেছিলেন সম্পূর্ণ ধর্মভিত্তিক চিত্রনাট্য, যা থেকে তৈরি হচ্ছিল ব্যবসায়িক সাফল্য সৃষ্টিকারী তামিল চলচ্চিত্র, যেমন রাজকুমারী। আবার একই সঙ্গে তিনি লিখেছেন প্রগতিশীল বামপন্থী সাহিত্য। সি এন আন্নাদুরাই-এর সঙ্গে স্থাপন করেছেন তামিলনাড়ুর প্রথম দ্রাবিড় ছাত্র আন্দোলন। দ্য পেন নামের গান্ধীবিরোধী বামপন্থী নাটক, বা পালান্নিপান নামের বর্ণাশ্রমবিরোধী পথনাটিকা। পরবর্তী রাজনীতি ও ইতিহাস তাঁকে মনে রেখেছে করুণানিধি নামে।
তাই পোন্নিয়ান সেলভেন বা তার লেখক কালকি শুধু গুরুত্বপূর্ণ নন, তাঁর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেই সময়কাল— যখন দাক্ষিণাত্যের রাজনীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন বাঁক নিচ্ছে। সেই বাঁকের মুখে আন্নাদুরাই আছেন, করুণানিধি আছেন, তেমনই আছেন তাঁর লেখা চিত্রনাট্যে চলচ্চিত্রায়িত নায়ক এম জি রামচন্দ্রন, আছেন কালকি ও টি সদাশিবন। ঠিক যেমন উপন্যাসে আছেন ধর্মীয় ভাবে অসহিষ্ণু রাজপুত্র মধুরান্তকর, মানুষের স্বার্থে ভাবা রাজপুত্র অরুণমোঢ়ি আবার অন্তঃপুরে আটকে থেকেও রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা নন্দিনী বা কুন্দাবাই।
তাই মণিরত্নমের এই সৃষ্টির হাত ধরে কালকির সৃষ্টির হাত ধরে আমরা এক সময়-বুদবুদে পৌঁছে যাই, যেখানে দক্ষিণ ভারতের একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী যেমন আছে, তেমনই আছে পঞ্চাশের দশক, ষাটের দশকও।
একাধারে ঐতিহাসিক, সমসাময়িক সাহিত্য, চলচ্চিত্র, রাজনীতির এই পদচারণ আমাদের কিছুটা সুযোগ দেয় পাপক্ষালনের। এ পাপ, দেশেরই দক্ষিণে থাকা মানুষদের ইতিহাস রাজনীতি সমাজ না জানার অপরাধ। দেশের ইতিহাসের পেন্ডুলামকে এক দিকে, কোনও এক বিশেষ বলয়ের দিকে নতজানু করার চেষ্টার অপরাধ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy