মঞ্চে বিভিন্ন চরিত্র নির্মাণের মধ্যেও শাঁওলীর স্পষ্ট উচ্চারণের বাচিক অভিনয়ও কিন্তু লক্ষ্যণীয়।
শাঁওলী চলে গেল। আমাদের সমসাময়িক একটি মেয়ে, আমাদের সহকর্মীও বলা চলে। আর হ্যাঁ, বন্ধু। ঘটনার আকস্মিকতায় ‘থ’ হয়ে গিয়েছি। সে দিন দুপুরেই একটি ফেসবুক লাইভে বেতার তথা শ্রুতিনাটক প্রসঙ্গে আলোচনায় কয়েক বার উঠে এসেছে ওর কথা। তার পর রাত সাড়ে ন’টায়, ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রথমে শম্ভু মিত্র-কন্যা, কিছু পরে শম্ভু-তৃপ্তি মিত্র-কন্যা এই পরিচয়ে ওর ‘মহাপ্রস্থানের’ খবর।
তার পর নাট্যজগতের বিভিন্ন দিকপালের শোকবার্তা। কোথাও বেতার নাটকের উল্লেখ নেই। বাংলার মঞ্চ নাটকে তার সহস্র অবদানের কথা মনে রেখেই বলছি, কোথাও যেন এই অনুল্লেখ তার প্রতি অসম্মানজনক মনে হচ্ছিল।
শাঁওলির সঙ্গে আমার পরিচয় সত্তরের দশকের শুরুতে (খুব ভুল না করি যদি) অ্যাকাডেমির সাজঘরে। নাটক সম্ভবত ‘ঘরে বাইরে’। কিন্তু আমি ওকে চিনি তারও অনেক আগে থেকে, আমার ঘরের মধ্যে বসে বেতার মাধ্যমেই। বহুরূপীর বেতার প্রযোজনা ডাকঘরের ‘অমল’ তখন আমার মতো সবার চেনা। এ ছাড়াও কলকাতা ক-এর বিভিন্ন নাটকের কল্যাণে ও তত দিনে একটি ‘হাউজহোল্ড নেম’।
আমিও তখন নিয়মিত বিবিধ ভারতীর নাটকে অভিনয় শুরু করেছি। কর্নেল বোসের থিয়েটার রোডের লিভিং সাউন্ড স্টুডিয়োতে তখন নিয়মিত নাটক রেকর্ডিং হয়। হ্যাঁ, বেতার নাটক। বিজ্ঞাপনদাতাদের পৃষ্ঠপোষকতায়। প্রযোজক শ্রাবন্তী মজুমদার। নতুন বা ধারাবাহিক নাটক হত বোরোলিনের সংসার, সুচিত্রার সংসার, আরব্যরজনী— আরও অনেক অনেক নামে। ওখানে তখন আমাদের রাজ্যপাটই বলা চলে।
আমরা বলতে গৌতম চক্রবর্তী, উজ্জ্বল সেনগুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, মমতা চট্টোপাধ্যায় আরও অনেকে। টালাপার্কে আমার প্রতিবেশী ভাই, পরবর্তীকালে বেতারের বিখ্যাত কণ্ঠ গৌতম চক্রবর্তী লিভিং সাউন্ডে গেসল আমার সঙ্গেই। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, সৌমিত্র-সুমিতা বসু, ধীমান চক্রবর্তী, শুভাশিস মুখোপাধ্যায়রাও যোগ দেয় এর কাছেপিঠেই। ওদের কিছু আগে হঠাৎ এক দিন সেখানে শাঁওলী এল। অগোছালো এলোমেলো গৃহস্থ বাড়িতে হঠাৎ অতিথির আগমনে যেমন হয়, আমাদের অবস্থা অনেকটা সে-রকম।
শাঁওলী নিম্নকণ্ঠ, ব্যক্তিত্বময়ী, পরিপাটি। শ্রাবন্তীর স্টুডিয়োর আবহ খানিক প্রগলভ, মজাদার। স্বভাবতই মেনে এবং মানিয়ে নিতে হল দু’পক্ষকেই। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। শাঁওলীর প্রতি আমাদের প্রাথমিক সমীহ মিশে গেল নির্ভেজাল বন্ধুতায়। আর সবার সঙ্গে মেতেও ও রইল ওর মতোই। আর সত্যি শাঁওলী ওর মতোই ছিল। কণ্ঠ, স্বরক্ষেপণ আর উচ্চারণের বিশিষ্টতায়। সেই জন্যই বেতার নাটকে ও ছিল স্বতন্ত্র, অননুকরণীয়।
সব কাক, সব ময়ূর, সব কোকিলের মতো সব মানুষের কণ্ঠস্বর তো এক নয়। তাই ইচ্ছে করলেই ওর কণ্ঠ ধারণ করা যেত না। এটা ওর একার পক্ষেই যে চিহ্নিত হওয়ার জন্য সহায়ক হয়েছিল তা নয়। বেতার মাধ্যমও এই স্বাতন্ত্র্য পছন্দ করে। তাতে নিরাবয়ব কণ্ঠগুলি চেনা এবং চেনানো সহজ হয়। শাঁওলীর বোধের ঔজ্জ্বল্যে কণ্ঠটি আরও শাণিত তথা অর্থবহ হয়ে উঠত। এ ছাড়াও ওর কণ্ঠ এবং উচ্চারণের জন্মগত কৌলীন্য তো ছিলই।
বহু মানুষ আছেন, যাঁরা বেতার বা শ্রুতিনাটক শুধুমাত্র পড়তে জানলেই করা সম্ভব বলে মনে করেন। প্রতিটি চরিত্র যে চুলচেরা বিশ্লেষণসাপেক্ষ, তার বাড়ি কোথায়, কী করে, কেমন সাজে, কোন পরিবেশে বড় হয়েছে— সব কথা ভাবতে হয় এবং তার পরেই কণ্ঠের আকিবুঁকিতে তা মূর্ত হয়ে ওঠে। এ সব বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবনা চলত নিরন্তর।
শরৎচন্দ্রের ‘বিন্দুর ছেলে’ নাটকটি মনে পড়ল। সবাই যখন ছেলেটিকে বকাঝকা করছে, কী ক্ষিপ্রতায় অনায়াসে শাঁওলী ছেলেটিকে কোলে তুলে নিল, স্রেফ কণ্ঠস্বরের মোচড়েই হাতে স্ক্রিপ্ট, মাইকে মুখ রেখে— ভাবা যায় না! সত্যি সত্যি কোনও ছোট ছেলে তখন স্টুডিয়োতে উপস্থিত ছিল বলে কেউ ভাববেন না যেন! তেমনই সহজ অনায়াসে জেমস হেডলি চেজের ‘বিষাক্ত অর্কিডে’র ক্যারল ব্যান্ডিশ হয়ে উঠতেও পারত শাঁওলী। শুধুমাত্র কণ্ঠের সামান্য রূপটানে। শাঁওলী অভিনীত অসংখ্য নাটকের মধ্যে এই দু’টির উল্লেখ করলুম শুধুমাত্র বিপ্রতীপ চরিত্রে তার অভিনয়ের মুন্সিয়ানা বোঝানোর জন্য।
এ ছাড়াও আকাশবাণীতে জগন্নাথ বসুর সঙ্গে শাঁওলীর অভিনীত ‘মেঘ বৃষ্টি আলো’র অনুরাধার ‘শান্তনু শান্তনু শান্তনু’ বলে সমর্পণ অথবা ‘কোনি’র সাঁতরাতে সাঁতরাতে ডায়ালগ তো সবার স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল। জগন্নাথের প্রযোজনায় ওই নাটকে স্টুডিয়োয় মাইকের সামনে জল-ভরা গামলায় মুখ ডুবিয়ে অভিনয় করেছিল শাঁওলী।
কিংবদন্তি মা বাবার সন্তান হওয়ার দায় তাকেও বইতে হয়েছে। অনেকেই তার কণ্ঠে মা তৃপ্তি মিত্রের ছায়া দেখেছেন, আবৃত্তির বোধ এবং উচ্চারণে বাবা শম্ভু মিত্রের ধারার মিল পেয়েছেন। কিন্তু সেইটাই তো স্বাভাবিক। তিন ঘরের ছোট্ট ফ্ল্যাটে যে শিশুটি বড় হয়, বাবা-মা’র অনুশীলন এবং দলীয় মহড়ার ছত্রচ্ছায়ায় তার নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে তো তাঁরাই থাকবেন। কিন্তু সেগুলি অন্ধ, নির্বোধ অনুকরণ হলে শাঁওলী আর ‘কথা অমৃত সমান’ সমার্থক হয়ে উঠতে পারত না।
মঞ্চে বিভিন্ন চরিত্র নির্মাণের মধ্যেও শাঁওলীর স্পষ্ট উচ্চারণের বাচিক অভিনয়ও কিন্তু লক্ষ্যণীয়।
আর বেতার অভিনয়ের জন্য তার ভাবনা কি শুধু চরিত্রচিত্রণেই ছিল? কী মিউজিক হবে, নানা সময়ে সে ভাবনাও শাঁওলী ভেবেছে। ১৯৯০ সালে বেতারের তৎকালীন নাট্য প্রযোজক অকাল প্রয়াত পাপিয়া চক্রবর্তীকে গজেন্দ্রনাথ মিত্রের 'মালাচন্দন' গল্পের প্রযোজনা সম্পর্কে তিনি লিখছেন, ‘মেঠো গন্ধ, মেঠো সুর, বাঁশি, খোল এবং ইন্টারল্যুডেও দিশি যন্ত্র ব্যবহার করে ওই কীর্তনাঙ্গের সুর রাখলেই ভাল। তুলসী চরিত্রটি যিনি অভিনয় করবেন, তাঁর কণ্ঠটিও মিষ্টি এবং ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন হতে হবে। আর গান তো তাঁর জানা চাই-ই।’
পারিবারিক বা লিভিং সাউন্ডের আড্ডার অবকাশে ওর ছোটবেলার, ওর নির্মাণের গল্প করতে গিয়ে কত বার বলেছে রবীন্দ্রনাথের কিছু কিছু গান ওর অস্থি-মজ্জায় মিশে গেছে, যার একটি ‘আমি মারের সাগর পাড়ি দেব গো’! আর সেই সাগরই পাড়ি দিল সে। ডাকঘরের অমলের মতো, শান্ত ভাবে ‘ভয়-ভাঙা নায়ের’ বাঁধন খুলে ‘যাই?’ বলে সে চলে গেল বেতার নাটকের সংলাপের মতই প্রায় নিরুচ্চার-উচ্চারণে।
(লেখক খ্যাতনামী বাচিক শিল্পী। পাপিয়াকে লেখা চিঠির সৌজন্য: আশিস চক্রবর্তী)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy