Advertisement
E-Paper

উত্তরণের পথ জমি থেকেই

বাগদিদের জমি নেই বললেই চলে। তাঁরা বাস করেন গ্রামের নিচু জলা পাড়ের ধারে, মূল সমাজ থেকে অনেক দূরে। সংসার চলে গ্রামের মনিবের বাড়িতে কাজ করে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।

সুজিত মাঝি

শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০২৫ ০৭:১১
Share
Save

পশ্চিমবঙ্গের সমাজে বদল অনেক হয়েছে, আবার অনেক কিছুই হয়নি। যেমন, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখনীতে যাঁরা খেতমজুর হিসাবে উঠে এসেছিলেন, বর্তমানেও তাঁদের সেই অবস্থায় বড় কোনও পরিবর্তন নেই। এঁরা কারা? তথাকথিত নিচু জাতের লোক, যাঁদের মধ্যে বাগদি জাতির মানুষ অন্যতম। বাগদিদের জমি নেই বললেই চলে। তাঁরা বাস করেন গ্রামের নিচু জলা পাড়ের ধারে, মূল সমাজ থেকে অনেক দূরে। সংসার চলে গ্রামের মনিবের বাড়িতে কাজ করে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।

আবার যাঁরা তাঁদের এই কাজে বহাল করেন, তাঁরাও প্রজন্মক্রমে মুনাফা পেয়ে যান। বাগদি জাতির খেতমজুর-ভাগ্য বদলায় না, কিন্তু মনিবের চাষিভাগ্য বদলে গিয়ে হয়ে যায় ব্যবসায়ী, মাস্টার, নেতা, ইত্যাদি। বাগদি সম্প্রদায়ের মানুষরা যে এ-কথা জানেন না তা নয়, কিন্তু তাঁরা নিরুপায়। কারণ, “সিপিএমের সময় আমরা একটু জমি পেয়েছি, ওই বাবুদের সম্পত্তি থেকে কেটে আমাদের দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, তা দিয়ে সারা বছর পেট চলে না। আমাদের কপালে জন্মের সময় থেকেই লেখা হয়ে যায়, খেতমজুর।” ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া হয় না— এক দিকে জমি নেই বলে, অন্য দিকে নিচু জাতের বলে। জমি নেই, টাকা নেই, তাই টিউশনি পড়ানোর পয়সা নেই। আবার ইস্কুলে মাস্টার ভাবেন বাগদির ছানা, সে আবার লেখাপড়া করবে কী! তাই কোনও রকমে প্রাথমিক বা মাধ্যমিক অবধি পড়তে পারলেও ঢের! জমি নেই, টাকা নেই, শিক্ষা নেই, তাই গ্রামের রাজনীতি থেকে উৎসব-আনন্দ, কিছুতেই বাগদির ভাগীদারি নেই।

জমি থাকলে অবস্থাটা অন্য রকম হয়। যেমন, নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর, শান্তিপুর, হাঁসখালি ব্লকের কিছু গ্রামে ছবিটা আলাদা— এখানে বাগদিরা তাঁদের ‘জন্মগত’ দুর্ভাগ্যের বিরুদ্ধে লড়াই সংগঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সৈন্য হিসাবে যুক্ত বাগদি পরিবারগুলি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তৎকালীন সময় থেকে সুবিধা পেয়েছিল। বছরে তিন বার চাষ হয়, পাট, আলু, আনাজ ইত্যাদি। সেখানে পাড়ার ভাগ নেই, গ্রামকে গ্রাম বাগদি সংখ্যাবহুল। সেখানে অর্থনৈতিক সম্পদ তাঁদের দখলে, চাষের যন্ত্রপাতিও। উচ্চ এবং নিম্নবর্ণের মধ্যে যে পাড়াগত সম্পর্ক, তার শিকার হতে হয় না। অর্থনৈতিক প্রতিপত্তির পাশাপাশি স্থানীয় রাজনৈতিক ক্ষমতাতেও তাঁদের কিছু অংশীদারি আছে। পাশাপাশি অনেক বাগদি সম্প্রদায়ের গ্রাম থাকায় এই দরকষাকষি তাঁরা করতে পারেন। সরকারি নানা প্রকল্পের সুবিধাও তাঁরা পাচ্ছেন। রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী তাঁরা নিজেরাই।

বাগদিদের উৎসব বলতে মনসা পূজা। এর বাইরেও যে বাগদিদের উৎসব আছে, তা নদিয়া জেলাতেই দেখা যায়। বোয়ালিয়া নামক স্থানে ধর্মরাজের মন্দির আছে, যাকে কেন্দ্র করে বিরাট মেলা হয়। এখানে কিছু মন্দির আছে যার পূজারি বাগদি সম্প্রদায়ের মানুষ। বুড়োশিব বা বুড়োহাজরা শিবের পূজা বা হরিশপুর পঞ্চানন তলার পূজারি বাগদি জাতির। কৃষ্ণনগরের চূর্ণিপোতা গ্রামের এক বাগদি পরিবার আবার জমিদারি লাভ করেছিল। সেই পরিবার আজও আছে এবং পরিবারের এক নারী সাংস্কৃতিক বিষয়ে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেন। এই পরিবারের তৈরি ‘সুরাঙ্গন’ নামক একটি সাংস্কৃতিক বিদ্যালয় সঙ্গীত এবং নৃত্য সাধনার স্থান হয়ে উঠেছে। সেখানে অনেক বাগদি পরিবারের ছেলেমেয়ে নাচগান শেখে। প্রতি বছর বিশ্বকর্মা পূজার পর দিন গীতিনাট্য অনুষ্ঠান হয়, সেখানে যোগদানকারী সকলেই বাগদি জাতির।

আশেপাশে মতুয়া জনবসতি থাকার জন্য তাঁদের আন্দোলন বা জাতিগত সচেতনতার প্রভাব বাগদিদের উপরে পড়েছে। ভোটের সময় মতুয়াদের মন জয় নিয়ে সব পার্টির মধ্যে যে প্রতিযোগিতা চলে, তা তাঁদের এলাকায় চোখের সামনে ঘটে। সেই উপলব্ধি তাঁদের সংগঠন তৈরির জন্য একটা রাস্তা পাকা করে দিয়েছে, যার ফলে হাঁসখালি ব্লকের পণ্ডিতপুর গ্রামে ‘বর্গক্ষত্রিয় বাগদী সমাজকল্যাণ সমিতি’-র সূত্রপাত হয়েছে। এই সংগঠন বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে বাকি জেলার বাগদি জাতিকে একত্রিত করার প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে।

নদিয়ার এই অবস্থা একটি খণ্ডিত চিত্র। এখনও পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে বলা হয়ে থাকে যাদের জমি তারাই রাজা। কিন্তু রাজারা তো আর গায়েগতরে খাটবে না, সেই খাটনিটা খাটতে হয় অন্যদের— যাঁরা গরিব, অসহায়, নিরক্ষর, রাজনৈতিক ভাবে অক্ষম। তাঁদের কাজ হল অর্থব্যবস্থায় জুড়ে থাকা, উৎপাদনে দু’শো ভাগ গতর দেওয়া, কিন্তু ফলের বিষয়ে টুঁ শব্দটি না করা— কেন না ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলে দিয়েছেন, মা ফলেষু কদাচন!

নদিয়ার ব্যতিক্রমী ছবিটিকে পশ্চিমবঙ্গের দলিত আন্দোলনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার দরকার আছে। নদিয়ার বাগদিদের জমির উপরে অধিকার তাঁদের যে শক্তি দিয়েছে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে ওয়াকিবহাল আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মতুয়ারা তেমনই তুলে ধরতে পেরেছিলেন ফলের উপরে অধিকারের দাবি।অর্থাৎ, এক ধরনের সক্ষমতার মধ্য দিয়ে অন্য ধরনের সক্ষমতার দিকে যাওয়া। ভিন্ন ভিন্ন সক্ষমতার ভিন্ন ভিন্ন পথ ধরেই নিচু-জাতের দুর্ভাগ্যলিপি মুছে ফেলা যাবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Dalit Movement Workers

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}