ইয়াসের জেরে এ রাজ্যে ক্ষয়ক্ষতি কিছু কম হয়নি। পূর্ব মেদিনীপুর ও দুই ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বাড়িঘর, দোকানপাট, খেত তছনছ হয়ে গিয়েছে, বহু জায়গায় নদীবাঁধ ধুয়েমুছে সাফ। সমুদ্রের নোনা জলে প্লাবিত হয়েছে হাজার হাজার হেক্টর চাষের জমি। নষ্ট হয়েছে চাষের ফসল, নোনা জলে মরে গিয়েছে পুকুর ও ভেড়ির মাছ। দুর্যোগ কেটে যাওয়ার বেশ কয়েকদিন পরেও পূর্ব মেদিনীপুর এবং দুই ২৪ পরগনার সুন্দরবন সন্নিহিত কিছু গ্রাম জলের তলায়, পথঘাট ও সেতু ভেঙে বহু এলাকা যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। দুর্যোগে সর্বস্ব খোয়ানো বহু মানুষ এখনও ঘরে ফিরতে পারেননি। অনেকেই সরকারি আশ্রয় শিবিরে, কেউ গবাদি পশুগুলি নিয়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় আত্মীয়ের বাড়িতে। বাঁধের উপর খোলা আকাশের নীচে দিনযাপন করছেন, এমন মানুষও কম নয়। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের পাশাপাশি তীব্র সঙ্কট পানীয় জলেরও।
অবশ্য প্রতিশ্রুতিমাফিক সরকারের ‘দুয়ারে ত্রাণ’ কর্মসূচি শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রাথমিক ভাবে পঞ্চায়েত অফিস থেকে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ হচ্ছে, পাড়া বা মহল্লা স্তরে সম্প্রসারিত করার পরিকল্পনাও করা হচ্ছে। তবে সরকারি ত্রাণ বণ্টন নিয়ে কিছু কিছু অভিযোগও উঠতে শুরু করেছে। বহু মানুষকে গলা জল পেরিয়ে এসে ত্রাণ সংগ্রহ করতে হচ্ছে, কেউ কেউ ত্রাণ বণ্টনের ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্বের পুরনো অভিযোগ তুলছেন। অপেক্ষাকৃত দুর্গম এলাকায় ত্রাণ না পৌঁছনোয় কোনও কোনও এলাকার মানুষকে ক্ষোভ জানাতেও দেখা যাচ্ছে।
এ ধরনের বিপুলায়তন বিপর্যয় মোকাবিলায় শুধু সরকারের উপর দায় চাপিয়ে হাত ধুয়ে ফেলাটা যে দায়িত্বশীল নাগরিকের ভূমিকা হতে পারে না, কার্যত অনেকেই তা মানেন। বরাবরের মতো এ বারেও তাই সরকারের পাশাপাশি বহু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ক্লাব, ব্যক্তিগত উদ্যোগেও বহু মানুষ দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। চাল-ডাল, তেল-নুন, ত্রিপল, মশারি, জামাকাপড়, ওষুধ, শিশুখাদ্য-সহ দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় নানা জিনিস দুর্গত এলাকায় পৌঁছে দিচ্ছেন তাঁরা। তবে এই আন্তরিক উদ্যোগকে প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন বিবেকবর্জিত প্রমোদপ্রিয় কিছু মানুষ। এঁরা ত্রাণ বিতরণের অছিলায় লকডাউন উপেক্ষা করে পর্যটনে মেতে উঠেছেন। রোজ রাস্তা দিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছে ম্যাটাডর, মিনি ট্রাক, আরও বহু গাড়ি। সামনে পিছনে ব্যানার, তাতে বিভিন্ন ক্লাব, পাড়া ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নাম লেখা। গাড়ির ডালার উপর বিপজ্জনক ভাবে বসা মানুষ, কারও গন্তব্য সুন্দরবন, কারও দিঘা, মন্দারমণি। দলে দলে তাঁদের সোল্লাস যাত্রা, যেন এক উৎসব চলছে।
এঁদের মধ্যে অনেকেই বন্যাদুর্গতদের সঙ্গে ছবি তুলে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করে ‘মহান’ হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। বন্যাদুর্গতদের জন্যে সাহায্য চেয়ে একের পর এক আবেদনও পোস্ট করা হচ্ছে। অনেকেরই সন্দেহ, এ ভাবে সংগৃহীত অর্থের পুরোটা দুর্গতদের কাছে না-ও পৌঁছতে পারে। সে সন্দেহ অমূলক নয়, মানুষের দুর্দশাকে ঢাল করে অর্থ আত্মসাৎ করার ঘটনা এ দেশে বিরল নয়। একাধিক জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকরা ইতিমধ্যেই বহু ত্রাণ বণ্টনকারীর কাছ থেকে দুর্গত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী বিতরণ ‘কভার’ করার অনুরোধ পেয়েছেন। বোঝা যাচ্ছে, ত্রাণ বিতরণের চাইতে আত্মপ্রচারে এই মানুষগুলির উৎসাহ অনেক বেশি।
সুন্দরবন এবং সমুদ্রতীরবর্তী পর্যটন কেন্দ্রের কাছাকাছি সহজগম্য এলাকাগুলিতে ত্রাণের আড়ালে এ ধরনের ভ্রমণেচ্ছু ও প্রদর্শনকামী মানুষের ঢল এক দিকে যেমন প্রকৃত ত্রাণদাতাদের শুভ উদ্যোগকে লঘু ও কলঙ্কিত করছে, অন্য দিকে তেমনই ক্রমহ্রাসমান কোভিড পরিস্থিতি পুনরায় জটিল হয়ে ওঠার আশঙ্কাও সৃষ্টি করছে। এই সব অবাঞ্ছিত মানুষের উপস্থিতি অনেক সময়ই বাগড়া দিচ্ছে ত্রাণ বিতরণ প্রক্রিয়াতেও, যা প্রশাসনেরও মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছে।
এক সময় হয়তো জল নেমে যাবে, এই ধরনের মানুষের আনাগোনাও কমবে। তবে দুর্গতদের অনেকেই বলছেন, এতে যে তাঁদের দুর্দশা ঘুচবে, তেমন সম্ভাবনা কম। কারণটা কারও অজানা নয়। ঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসে তাঁরা যে শুধু নিজেদের বাড়িঘর, গেরস্তালির জিনিসপত্র, খাদ্যসামগ্রী ও সঞ্চিত সম্পদ হারিয়েছেন, তা-ই নয়; গৃহপালিত হাঁস, মুরগি ও গবাদি পশু মারা পড়েছে অনেক। মাছ ধরার জাল, নৌকা, অন্যান্য সরঞ্জাম ভেসে গিয়েছে। নোনা জলে কৃষিজমি, বাগান, পুকুর চাষবাস বা মৎস্য পালনের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। অনেক মানুষেরই জীবিকার্জনের পথ পাকাপাকি ভাবে রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে।
ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন— ত্রাণ, তা সে সরকারি উদ্যোগেই হোক কিংবা বেসরকারি উদ্যোগে, অনন্তকাল ধরে চলতে পারে না। ফলে কোভিড-অতিমারির ছায়া ফেলা আগামী দিনগুলিতে কী করে তাঁরা দিন গুজরান করবেন, তা নিয়ে প্রত্যেকেই চিন্তিত।
এই মুহূর্তে তাই দুর্গত এলাকায় ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই সব মানুষের স্থায়ী পুনর্বাসন ও বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করাও অত্যন্ত জরুরি। শুধু ত্রাণ বিতরণ আর বিনামূল্যের রেশন দিয়ে কোনও জনগোষ্ঠীর যথার্থ উন্নয়ন কখনও সম্ভব নয়। একের পর এক বা দীর্ঘমেয়াদি দানখয়রাতি মানুষকে বরং ক্রমশ শ্রমবিমুখ ও পরমুখাপেক্ষী করে তোলে, যা রাজ্য তথা দেশের সার্বিক প্রগতির পরিপন্থী। বানভাসি মানুষদের পুনরায় স্বাবলম্বী করে জীবনের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনাটাই প্রশাসনের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy