এই পরিস্থিতি মানব ইতিহাসে অভুতপূর্ব। নীতিনির্ধারকরা চুল ছিঁড়ছেন সমাধান খুঁজতে। আর তৈরি হচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
কোভিডের প্রথম ছোবলটা কেটেছিল আতঙ্কে। আর স্বজন হারানোর ভয়ে। কিন্তু দ্বিতীয় ছোবলটা ছিল অসহায়তার। আর তৃতীয়টা আসতে আসতে আমরা একে ভবিতব্য হিসাবেই বোধহয় মেনে নিয়েছিলাম। একটা অদ্ভুত অবশ অস্তিত্ব। জানি সময় খারাপ। কিন্তু তবুও তো বাঁচতে হবে। খারাপ সময় চিরকাল থাকে না। আবার সূর্য উঠবে। এই সব ভেবে নিয়েই দিন যাপন।
এর পর শুরু হল চাকরি হারানোর পালা। আবার কাজ খুঁজে পাওয়ার সুযোগও। কিন্তু সব হারানো এবং কিছু ফিরে পাওয়ার এই নাগরদোলায় কারওর ঘরে হারানোটাই সব, আর কারও বা কিছু পাওয়া আর কিছু হারানো। ক’জন ফিরে পেল সবই তার হিসাব কেউ নিয়েছে কিনা জানি না, কিন্তু বিশ্বকে সংসার মানলে সব সমীক্ষাই কিন্তু বলছে হারানোর যাত্রা আমাদের সবে শুরু।
২০২২ সালেই আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার (আইএমএফ) নিদানটা হাঁকে। বিশ্ব জুড়ে মন্দার সম্ভাবনা নিয়ে শঙ্কার শুরুও ২০২২ সালেই। গত বছরের এপ্রিল মাসে বিশ্ব আর্থিক বাজারের ঝুঁকি নিয়ে আশঙ্কার আভাস তাদের অক্টোবর রিপোর্টে বদলে গিয়ে বাস্তব বলে ঘোষণা করে দেয়। মুদ্রাস্ফীতি সামলাতে হবে বলে শীর্ষ ব্যাঙ্কগুলিকে সাবধান করে দেয়। কিন্তু কী ভাবে?
অক্টোবরের এই রিপোর্টের আগেই অবশ্য বিশ্বের প্রতিটি শীর্ষ ব্যাঙ্কই মুদ্রাস্ফীতিতে রাশ পরাতে মাঠে নেমে পড়ে। কিন্তু তাতেও কী সমাধান মিলছে? বিশ্ব জুড়ে আর্থিক বাজারে ঝুঁকি বাড়ছেই। যার অভিঘাত গিয়ে পড়ছে গোটা বাজারে। এ বার রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক সিচুয়েশন অ্যান্ড প্রসপেক্টস’ বিশ্বের বাজারের সামনে যে কঠিন চ্যালেঞ্জ, তা স্বীকার করে নিয়ে আরও শঙ্কার ঘন্টি বাজিয়ে দিয়েছে।
২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী সাসটেইনেবেল ডেভলপমেন্ট বা স্থিতিশীল উন্নয়নের যে লক্ষ্য রাষ্ট্রপুঞ্জের সদস্য দেশগুলি মেনে নিয়েছিল, সেই লক্ষ্য পূরণের যাত্রাটা শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি। আর কোভিড সেই লক্ষ্যপূরণের মাঝরাস্তায় স্থিতিশীল উন্নয়নের স্বপ্নে জল ঢেলে দিল। রাষ্ট্রপুঞ্জের এই রিপোর্ট মনে করছে, এই যাত্রা আবার ঠিক রাস্তায় ফেরানোর কাজটা এ বার আরও কঠিন হয়ে গেল।
গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো ২০২২ থেকেই শুরু হয়ে গেল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বিশ্ব জুড়ে কাঁচামাল সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় যে মুদ্রাস্ফীতির দৈত্য প্রায় প্রতিরোধহীন ভাবে আগ্রাসী হয়ে উঠতে পেরেছিল, তাতে ইন্ধন জুগিয়ে যাচ্ছে এই যুদ্ধ খাদ্যপণ্য সরবরাহে সমস্যা তৈরি করে। বিশ্বের গমের চাহিদার প্রায় ১০ শতাংশ মেটায় ইউক্রেন। আর এই যুদ্ধ সেই সরবরাহ প্রায় পুরোটাই বানচাল করে বসে রয়েছে। অন্য অনেক কিছু ছেড়ে বাঁচা যায়। কিন্তু না-খেয়ে তো থাকা যায় না! কোভিডের কারণে পরিবহণ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত থাকায় খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাও বিপর্যস্ত ছিল। এ বার তার সঙ্গে এই যুদ্ধ হাত মেলাতে মুদ্রাস্ফীতি সুনামির মতো গোটা বিশ্বকে ছেয়ে ফেলল।
ফল? দারিদ্র বৃদ্ধি। জিনিসের দাম বাড়ায় মানুষের প্রকৃত আয়ও কমতে শুরু করেছে। আর এরই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উষ্ণায়নের কারণে বন্যা, খরা, ঝড়। যেমন সোমালিয়ায় দুর্ভিক্ষ। পরিবেশবিদদের মতে যার মূলে রয়েছে উষ্ণায়ন।
নীতি নির্ধারকরা এ বার কী করবেন? মানব সভ্যতা এই আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি কোনও দিন হয়নি। বিশ্বের বর্তমান অবস্থা একেবারেই অন্য রকম। বিশ্ববাজার এই ভাবে কোনও দিন সব দেশকে এক শৃঙ্খলে বাঁধেনি। এই ভাবে তাই কোনও দিনই এক দেশের নীতি অন্য দেশের বাজারকে এতটা প্রভাবিত করতে পারেনি। আজ কিন্তু ইউক্রেনের যুদ্ধ সোমালিয়ার দুর্ভিক্ষের অভিঘাতকে আরও তীব্র করে তোলে। চরম মুদ্রাস্ফীতিতে ইন্ধন দিয়ে।
এই সর্বনাশা মুদ্রাস্ফীতি-দৈত্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সুদকেই অন্যতম অস্ত্র হিসাবে মেনে নিয়েছে সব দেশের শীর্ষ ব্যাঙ্কগুলি। তাই বিশ্ব জুড়েই সুদ বাড়ছে। আর তৈরি হয়েছে এক অদ্ভুত ঝুঁকির আবহ। আর এটাই চিন্তার। এ এক অদ্ভুত দোলাচোল। এক দিকে বেকারি বাড়ছে। অন্য দিকে কর্মসংস্থান তৈরি হলেও তার সুযোগ নিতে এগিয়ে আসছে না কেউ। এই পরিস্থিতি মানব ইতিহাসে অভুতপূর্ব। নীতি নির্ধারকরা চুল ছিঁড়ছেন সমাধান খুঁজতে। আর তৈরি হচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা।
বিশ্ব জুড়ে গড় মুদ্রাস্ফীতির হার ৯ শতাংশ। আর এক শাঁখের করাত কেটে চলেছে বাজারের গলা। মুদ্রাস্ফীতি ঠেকাতে শীর্ষ ব্যাঙ্কগুলির হাতে সেই প্রথাগত অস্ত্র। সুদের হার বাড়ানো। আর বাজারে সুদের হার বাড়া মানেই লগ্নির খরচও বেড়ে চলা। আর লগ্নির খরচ বাড়া মানেই বাজারের আর এক স্তরের ঝুঁকি। বিনিয়োগের ঝুঁকি। যা বাড়ছে। এমতাবস্থায় বাস্তব হল বিশ্ব জুড়েই বৃদ্ধির হার কমা। ২০২২ সালের ৩ শতাংশ থেকে এই হার ১.৯ শতাংশে নেমে আসবে বলে মনে করছে রাষ্ট্রপুঞ্জের সমীক্ষা। এ রকম নয় যে শুধু রাষ্ট্রপুঞ্জের সমীক্ষাই এই কথা বলছে। সব সমীক্ষাই সহমত যে ২০২৩ সালে বৃদ্ধির হার কমবেই। আর বৃদ্ধির হার কমা মানেই সাধারণ মানুষের দুর্দশা বৃদ্ধি। যার অবশ্যম্ভাবী অভিঘাত হল বিশ্ব জুড়ে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি।
কোনও দেশের মধ্যে এই সমস্যা দরিদ্রকে আরও দরিদ্র করে তোলে। মধ্যবিত্তকে নিম্নবিত্ত। আর উচ্চবিত্তের সিঁড়ির শেষ ধাপে দাঁড়ানোদের মধ্যবিত্ত। আর এই একই চল কিন্তু সব দেশের ক্ষেত্রেও সত্যি। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দুনিয়ায়।
যে সমস্যা গোটা দুনিয়াকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখছে সেই সমস্যা রুখতে উপায় একটাই। গোটা দুনিয়ার একজোট হয়ে এই সমস্যার সঙ্গে লড়াই করা। যুক্তি একটাই। আর তা উঠে আসে বাজার থেকেই। আর্থিক আর সামাজিক অশান্তি বাড়লে ক্ষতি সবারই। কারণ এর ফলে বাজার সঙ্কুচিত হবে। যার ফল ভুগতে হবে সবাইকেই।
তাই প্রথম পদক্ষেপটাই হল উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঋণ সমস্যা বাড়তে না দেওয়া। সুদের হার বাড়া মানেই কিন্তু ঋণের খরচ বাড়া। আর ব্যবসার মতোই কিন্তু ঋণগ্রস্থ দেশগুলিরও চাপ একই রকম ভাবে বাড়বে। আর এখানে এসেই কিন্তু রাষ্টপুঞ্জ ইঙ্গিতে দায়ী করেছে আইএম এফ বা বিশ্বব্যাঙ্কের ঋণ লাঘবের পদ্ধতিকে। বলেছে, চলতি পদ্ধতি যে কাজ করে না তা মেনে নিয়েই নতুন পদ্ধতির রাস্তায় হাঁটতে হবে। আরও সহনশীল এবং সহমর্মী ঋণভার লাঘবের রাস্তায় হাঁটতে শিখতে হবে। কিন্তু এ কথা জেফরি সাক্সের মতো অর্থনীতিবিদরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছেন। কিন্তু শুনেছে কেউ?
বর্ধমান ঝুঁকির বাজারে আসলে চ্যালেঞ্জটাই হল ঝুঁকি কমানো। কিন্তু এক বার আর্থিক ঝুঁকি বাড়ার অভিঘাত সামাজিক অস্থিরতায় প্রতিফলিত হতে শুরু করলে তা সামলানো মুশকিল হয়ে যাবে। তাতে যে দুষ্টচক্র তৈরি হবে, তার থেকে কী ভাবে বেরিয়ে আসতে হয় তা কিন্তু কোনও পাঠ্যপুস্তকে লেখা নেই।
সব সমীক্ষাই কিন্তু বলছে এই সমস্যা সামলাতে প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। যা আসলে পড়তে হবে এই ভাবে যে, এই সমস্যা ঘনীভূত হচ্ছে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং সহমর্মিতার অভাবেই। কিন্তু তা আগেও বুঝিনি। এখনও বোঝার কোনও ইঙ্গিত অন্তত এ যাবৎ মেলেনি। যে ডালে বসে আছি সেই ডালে কুঠারাঘাত করার নীতির বিরুদ্ধে তাই সাধারণ মানুষ নিজের অসহায় ক্ষোভ হিংসায় প্রকাশ করবে। আর বিশ্ব জুড়েই সরকার আর নাগরিকের মধ্যে বিভেদ আরও বাড়বে। যা উন্নয়নের অন্যতম বাধা হিসাবে স্বীকৃত। তাই ভবি কবে ভুলবে সেটাই আসল প্রশ্ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy