কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কিরেন রিজিজু ই-আদালত বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করছেন, দিল্লি, ২৪ জানুয়ারি। ছবি: পিটিআই।
সংসদ বড়, না সুপ্রিম কোর্ট— এই প্রশ্নে প্রধান বিচারপতি এস এম সিক্রি ও সুপ্রিম কোর্টের তিন প্রবীণতম বিচারপতি যে সুপ্রিম কোর্টের পক্ষেই রায় দিতে চলেছেন, তা ইন্দিরা গান্ধী আগেই টের পেয়ে গিয়েছিলেন। তাই সুপ্রিম কোর্টের রায়দানের আগেই তিনি ঘুঁটি সাজাতে শুরু করেন।
কোনও সরকার কি চাইলেই সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আমার-আপনার মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে? সংবিধান পাল্টে দিয়ে মৌলিক অধিকার কেড়ে নিতে পারে? না কি, সরকারের সেই পদক্ষেপকে প্রয়োজনে ‘অসাংবিধানিক’ বলে সুপ্রিম কোর্ট নাকচ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে? সুপ্রিম কোর্ট কি বলতে পারে, সংবিধান সংশোধন করা গেলেও তার মূল কাঠামো— যার প্রধান ও জরুরি উপাদান মানুষের মৌলিক অধিকার— তাতে কাটছাঁট করা চলবে না?
সংসদ বড়, না সুপ্রিম কোর্ট, তা নিয়ে মোদী জমানায় নতুন করে ফিরে আসা এই বিতর্কের শুরু প্রায় ছাপ্পান্ন বছর আগে। ১৯৬৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। সে দিন গোলকনাথ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল, সংবিধানের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করার কোনও অধিকার সংসদের নেই। স্পষ্ট বললে, সংসদে ক্ষমতাসীন সরকারের নেই।
ইন্দিরা গান্ধী এই লক্ষ্মণরেখা মানবেন কেন! ১৯৭১-এর লোকসভা নির্বাচনে ‘গরিবি হটাও’-এর ডাক দিয়ে বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতায় ফেরার আগেই তিনি ব্যাঙ্কের জাতীয়করণ করেছিলেন। দেশীয় রাজাদের রাজন্যভাতা (প্রিভি পার্স) বন্ধ করেছিলেন। ফলে গরিবি হটাওয়ের লক্ষ্যে সরকার নাগরিকের সম্পত্তির উপরে মৌলিক অধিকারে হাত দিতে পারে কি না, সে প্রশ্ন উঠেছিল। ভোটের রাজনীতিতেও এ নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল।
নির্বাচনে লোকসভার ৫১৮টি আসনের মধ্যে ইন্দিরা গান্ধী ৩৫২টি আসন দখল করেছিলেন। ইন্দিরার মনে হয়েছিল, গণতন্ত্রে মানুষের রায় তাঁর পক্ষে। অতএব মানুষ তাঁকে সংবিধান সংশোধন করে সম্পত্তির অধিকারে হস্তক্ষেপের অধিকার দিয়েছে। দেরি না করে সংবিধানে ২৪তম সংশোধন করে ফেললেন ইন্দিরা। সংবিধানের ১৩তম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনও সরকারি আইন মৌলিক অধিকার কেড়ে নিতে পারে না। ৩৬৮ অনুচ্ছেদে সংসদ কী ভাবে সংবিধান সংশোধন করতে পারে, তা বলা হয়েছে। দু’টি অনুচ্ছেদেই সংশোধন করা হল। গোলকনাথ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছিল, তাকে ইন্দিরা স্পষ্টতই বুড়ো আঙুল দেখালেন। সংসদের হাতে, বকলমে নিজের সরকারের হাতে সংবিধান রদবদলের পুরো ক্ষমতা তুলে নিলেন।
ইন্দিরা জানতেন, তাঁর সংবিধান সংশোধন সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। আর ঠিক সেই কারণেই দাবার ঘুঁটি সাজাতে শুরু করে দিয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্টে নিজের বাছাই করা বিচারপতিদের নিয়োগ করতে শুরু করেছিলেন। যাতে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা হলেও ‘সরকারের অনুগত’ বিচারপতিরা তা খারিজ করে দেন। আইনমন্ত্রী এইচ আর গোখলে, ইস্পাতমন্ত্রী মোহন কুমারমঙ্গলম ও শিক্ষামন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের কমিটি তৈরি হয়েছিল। তাঁদের কাজ ছিল, গোলকনাথ মামলার রায় উল্টে দিতে সংবিধানে আরও কী কী সংশোধন দরকার, এবং কী ভাবে সরকারের অনুগত বিচারপতিদের নিয়োগ করা যায়, তা নিয়ে ইন্দিরাকে পরামর্শ দেওয়া। বিভিন্ন রাজ্যের হাই কোর্ট থেকে বেছে বেছে সুপ্রিম কোর্টে আধ ডজন বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছিল।
ইন্দিরার অনুমান মিলে গিয়েছিল। সংবিধান সংশোধনকে চ্যালেঞ্জ করে একাধিক মামলা হয়েছিল। কেশবানন্দ ভারতীর মামলা নামে খ্যাত সেই মামলার জন্য শীর্ষ আদালতে তেরো জন বিচারপতির বেঞ্চ তৈরি হয়েছিল। ওই তেরো জনের মধ্যে মামলার আগে ইন্দিরার নিয়োগ করা ছ’জন বিচারপতিও ছিলেন। শুনানির সময়ই টের পাওয়া গিয়েছিল, বিচারপতিদের মধ্যে দু’রকম মত রয়েছে। ১৯৭৩-এর ২৪ এপ্রিল রায় ঘোষণা হয়েছিল। পর দিনই প্রধান বিচারপতি সিক্রির অবসর নেওয়ার দিন। রায়ের ঠিক আগে বিচারবিভাগকে লক্ষ্য করে গোলা দেগেছিলেন ইন্দিরা। তিন জন প্রবীণতম বিচারপতিকে টপকে বিচারপরি এ এন রায়কে পরবর্তী প্রধান বিচারপতি ঘোষণা করে দিয়েছিলেন।
এত করেও শেষ রক্ষা হয়নি। তেরো জনের মধ্যে সাত জনের সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় ছিল সুপ্রিম কোর্টের সর্বোচ্চ ক্ষমতার পক্ষে। বিচারপতি এ এন রায়, যাঁকে ইন্দিরা রায় ঘোষণার আগেই পরবর্তী প্রধান বিচারপতি হিসেবে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, তিনি সুপ্রিম কোর্টের বদলে সংসদের সর্বোচ্চ ক্ষমতার পক্ষে রায় দেন। কিন্তু ‘সরকারের অনুগত’ ভেবে যে ছ’জন বিচারপতিকে ওই মামলার আগে নিয়োগ করা হয়, তাঁদের মধ্যে মাত্র পাঁচ জন সরকারের পক্ষে রায় দেন। ষষ্ঠ জন, বিচারপতি এ কে মুখোপাধ্যায় সে পথে হাঁটেননি। তাঁর রায় গিয়েছিল ইন্দিরা সরকারের বিরুদ্ধে। তিনি বলেছিলেন, সংবিধান সংশোধনে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা সীমিত।
ছাপ্পান্ন বছর পরে মোদী সরকারের শীর্ষস্তর থেকে নতুন করে সেই কেশবানন্দ ভারতীর মামলার রায়ের সমালোচনা শুরু হয়েছে। শুরু করেছিলেন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কিরেন রিজিজু। বিচারপতি নিয়োগের বর্তমান ব্যবস্থা নিয়ে তাঁর বিস্তর অভিযোগ। কারণ, সেখানে সরকারের বিশেষ কিছু করার নেই। প্রায় সবটাই সুপ্রিম কোর্ট, হাই কোর্টের প্রবীণতম বিচারপতিদের নিয়ে তৈরি কলেজিয়ামের হাতে। আইনমন্ত্রী চান, সরকারের হাতেও ক্ষমতা থাকুক। তা নিশ্চিত করতেই মোদী সরকার জাতীয় বিচারপতি নিয়োগ কমিশন আইন তৈরি করেছিল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তা খারিজ করে দিয়েছিল। কারণ তা সংবিধানের বিরুদ্ধে। এর পরে উপরাষ্ট্রপতি তথা রাজ্যসভার চেয়ারম্যান জগদীপ ধনখড় মাঠে নেমেছেন। তিনি প্রথমে মোদী সরকারের বিচারপতি নিয়োগ কমিশন আইন খারিজ করে দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টকে দুষেছিলেন। তার পরে কেশবানন্দ ভারতী মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়কেই ‘খারাপ নজির’ বলে সমালোচনা করেছেন। এই যে সরকার সংসদে আইন পাশ করালে বা সংবিধান সংশোধন করলে, সুপ্রিম কোর্ট তা সংবিধানের মূল কাঠামোর বিরুদ্ধে বলে নাকচ করে দিতে পারে, এতেই দেশের উপরাষ্ট্রপতির ঘোর আপত্তি।
এর মধ্যে বিরোধী শিবির থেকে আইনজ্ঞরা যে বিপদের গন্ধটি পাচ্ছেন, তা খুব স্পষ্ট। কার্যত সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান দখল করে ফেলার পরে মোদী সরকার এ বার পুরোপুরি শীর্ষ আদালতকে নিজের মুঠোয় পুরে ফেলতে চাইছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ। সে ক্ষেত্রে সরকারের হাতে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা থাকবে। সরকার নিজের ইচ্ছে মতো সংবিধান সংশোধন করতে পারবে। সেই সংবিধান সংশোধন সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেও সরকারের অনুগত বিচারপতিরা তা নাকচ করে দেবেন না। ঠিক যেমনটি ইন্দিরা গান্ধী চেয়েছিলেন। উপরাষ্ট্রপতি থেকে আইনমন্ত্রী বার বার মানুষের রায়ের কথা বলছেন। মানুষই ভোট দিয়ে কোনও সরকারকে ক্ষমতায় আনে। সেই সরকার যে কাজ করছে, সেটা আসলে মানুষেরই রায়। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা তো ভোটে জিতে আসেননি! তা হলে তাঁরা বিজেপিকে তিনশোর বেশি আসনে জিতিয়ে আনা মানুষের রায় খারিজ করে দেন কিসের জোরে! সংসদের হাতেই তাই শেষ কথা বলার ক্ষমতা থাকা উচিত।
প্রজাতন্ত্র দিবসের সকালে বসে গণতন্ত্রের দিক থেকে দেখলে এ অকাট্য যুক্তি। কিন্তু গণতন্ত্রের বিপদ হল, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে মানুষের রায়ের দোহাই দিয়ে যে কোনও সরকার বা দল যথেচ্ছ ক্ষমতা হাতে পেয়ে যায়। সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তারা যাতে সংবিধানে হস্তক্ষেপ করে মানুষের অধিকারেই হস্তক্ষেপ করতে না পারে, তার জন্যই সংবিধান প্রণেতারা বলে গিয়েছিলেন, সরকারের কোনও আইন সংবিধান প্রদত্ত মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নিতে পারে না।
দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরাবরই মৌলিক অধিকারের থেকে মৌলিক কর্তব্যকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন। যে মৌলিক কর্তব্য মূল সংবিধানে কোথাও ছিল না। ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থার সময় তা সংবিধানে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। এ-ও এক বিচিত্র সংযোগ। নরেন্দ্র মোদী ভারতের যে কোনও সমস্যার জন্য জওহরলাল নেহরুকে দায়ী করেন। কিন্তু তিনি জওহর-কন্যা ইন্দিরার পথে চলতে ভালবাসেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy