E-Paper

পূর্ণতা খোঁজার অধিকার

যাঁরা বিশেষ ভাবে সক্ষম, তাঁদের যৌনতার বোধ, যৌন আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কথা এড়াতে চান তাঁদের চার পাশের মানুষ। এ বিষয়ে সমাজের মনোভাব কেবল রক্ষণশীলই নয়, নেতিবাচক।

সুদেষ্ণা গোস্বামী

শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২৫ ০৪:১৩
Share
Save

লোকে ভাবতে পারে মেয়েটা বিগড়ে গিয়েছে, তাই রূপরেখা চুপ করে থাকে। কলের পুতুলের মতো স্নান, খাওয়া, পড়াশোনা করে। যে কথাগুলো তার মনে তোলপাড় করে, সেগুলো বলে না। প্রশ্নগুলো কাউকেই করে না। রূপরেখার বয়স উনিশ, কিন্তু এক জন সেরিব্রাল পলসি এথিটয়েড হওয়ায় সে হুইলচেয়ারে চলাফেরা করে। দৈনন্দিন কাজের জন্য মা-বাবার উপর অনেকাংশে নির্ভর করতে হয়। দক্ষিণ কলকাতায় বিশেষ ভাবে সক্ষমদের একটি স্কুলে পড়ে। এখন সে জাতীয় মুক্ত বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। উত্তর কলকাতার মানিকতলার খালের পাশে এক ছোট্ট ঘরে থাকে রূপরেখার নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার।

রূপরেখার জীবনের এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সঙ্কট কিন্তু তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নয়, বরং তার নিজস্ব সত্তার স্বীকৃতি। যার একটি বিশেষ মাত্রা— তার যৌন সত্তা। যাঁরা বিশেষ ভাবে সক্ষম, তাঁদের যৌনতার বোধ, যৌন আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কথা এড়াতে চান তাঁদের চার পাশের মানুষ। এ বিষয়ে সমাজের মনোভাব কেবল রক্ষণশীলই নয়, নেতিবাচক। যার শিকড় গাঁথা রয়েছে এ বিষয়ে অজ্ঞতা আর অস্বস্তিতে। বাড়ির লোকেরাও চান না যে, বিশেষ ভাবে সক্ষম সন্তানটির যৌন চেতনার উন্মেষ হোক। রূপরেখার সঙ্কট দ্বিগুণ। কারণ, নিজের লিঙ্গ-যৌনতার পরিচয় নিয়েও তার মধ্যে বেশ কিছু দিন একটা দোলাচল কাজ করছে। নিজের যৌন প্রবণতা বা ‘সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন’ কী, তা নিয়ে। তার শরীর ও মনের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, সেটাকে সে কী ভাবে ব্যাখ্যা করবে? সে নিজেকে আয়নার সামনে ঠিক কী ভাবে দেখতে চায়? এ সব নিয়ে রূপরেখার বলার আছে অনেক কিছু, একই সঙ্গে জানারও আছে তার থেকে অনেক বেশি।

ভারতে রূপান্তরকামী ও ‘কুইয়র’ মানুষরা যেখানে এখনও সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিরোধের মুখে পড়েন, সেখানে এক জন বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষের জন্য নিজের পথ খুঁজে নেওয়া আরও কত কঠিন, তা আন্দাজ করা শক্ত নয় মোটে। তাঁরা নিজেদের জন্মগত লিঙ্গপরিচয়ের থেকে আলাদা যৌনতার বোধ নিয়ে কথা বলার সুযোগই পান না। বললে শুনতে হয়, “এ সব ভাবার দরকার কী তোমার?” রূপরেখা সে কারণে চুপ করে থাকে।

প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষেরা এক অগৌরবের দিনযাপন করে চলেছেন। পুরুষতন্ত্রের প্রতি আনুগত্যের ফাঁকফোকর গলে নারী-পুরুষের সমানাধিকার নিয়ে কথা বলা হচ্ছে হয়তো, কিন্তু দু’টিমাত্র লিঙ্গে জগৎকে ভাগ করা, এবং জন্মগত লিঙ্গে প্রতিটি মানুষের যৌনতাকে আবদ্ধ করা— পুরুষতন্ত্রের এই স্বৈরাচার নিয়ে কথা হয় তুলনায় কম। সত্য এই যে, পুরুষ-নারী দ্বৈততার বাইরেও এক জন মানুষ যেতে পারেন, জন্মগত ভাবে নির্ধারিত লিঙ্গ-পরিচয়ে তিনি সীমাবদ্ধ নন। প্রত্যেকেরই স্বাধীনতা রয়েছে নিজের পরিচয় নির্মাণ করার, নিজের মতো করে জীবনকে সাজানোর।

তবে সেই বাঁচাকে সম্ভব ও সার্থক করতে হলে দরকার রয়েছে সামাজিক স্বীকৃতিরও। লিঙ্গ-পরিচয় যে কেবল শারীরিক বৈশিষ্ট্যের বিষয় নয়, তা স্বীকার করতে হবে সমাজকে। এবং সেই সঙ্গে এ-ও মানতে হবে যে সমকামী মানুষদের, ভিন্ন লিঙ্গ-যৌনতার মানুষদের একটা অংশে রয়েছেন বিশেষ ভাবে সক্ষম ব্যক্তিরাও। ভারতের ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, দেশে প্রায় ২৬.৮ কোটি, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার দুই শতাংশ বিশেষ ভাবে সক্ষম ব্যক্তি। পঞ্চম জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা (২০১৯-২১) অনুসারে এই অনুপাত আরও বেশি, প্রায় সাড়ে চার শতাংশ— কমবেশি সাড়ে ছ’কোটি মানুষ।

বিশেষ ভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের সুরক্ষা আইন (২০১৬) এই ব্যক্তিদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, সামাজিক নিরাপত্তা, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অংশগ্রহণ-সহ সব মৌলিক অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ ছাড়া বৈষম্যহীন পরিবেশ নিশ্চিত করা, বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদান এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের অন্তর্ভুক্তির নীতি বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই আইনে অবশ্য লিঙ্গ-পরিচয় সংক্রান্ত বিষয়টি নিয়ে আলাদা করে কথা বলা নেই। কিন্তু যৌন-পরিচয় নির্ণয়ের অধিকারকেও ব্যক্তির অধিকারের একটি মাত্রা বলেই ধরতে হবে। অথচ, রূপরেখার ‘স্পেশাল শিক্ষক’ও এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে তার পরিবারের থেকে বাধা পেয়েছেন।

বিশেষ ভাবে সক্ষমদের জীবন যেন সমাজের কাছে কেবল শারীরিক সীমাবদ্ধতার গল্প। তাঁরা কী অনুভব করেন, কাকে ভালবাসতে চান, নিজেদের কী ভাবে প্রকাশ করতে চান— এ সব প্রশ্ন সমাজ করে না। ধরে নেয়, এক জন বিশেষ ভাবে সক্ষম ব্যক্তি কেবল বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করবেন। জীবনের পূর্ণতা খোঁজার অধিকার তাঁর নেই। বিশেষত যে মেয়ে প্রজননক্ষম নন, তাঁর কাছে যৌনতা যেন সোনার পাথরবাটি। বিশেষ করে বৌদ্ধিক ক্ষমতার ক্ষেত্রে যাঁদের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তাঁদের সঙ্গে শিশুসুলভ আচরণ করতে দেখা যায় অন্যদের। সমাজ ধরে নেয় যে, তাঁদের কোনও যৌন চাহিদা নেই বা যৌন সম্পর্ক গড়ার প্রয়োজন নেই। অথবা তাঁরা নিজের যৌন সিদ্ধান্ত নেওয়ার যোগ্য নন। এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই কি? রূপরেখার মতো মানুষদের সামাজিক অন্তর্ভুক্তি কি কেবল অসার প্রতিশ্রুতি?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Specially abled people Society sexual desire Sexuality

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

ক্যানসেল করতে পারবেন আপনার সুবিধামতো

Best Value
প্রতি বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
প্রতি মাসে

৪২৯

১৬৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।