আজকাল নিজের বক্তব্য খুব জোরালো ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে অনেকেই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেন, গুগল করে মিলিয়ে নিন! এই ক’দিনে সন্ত্রাসবাদ প্রসঙ্গে যত বিতণ্ডা হল, তাতে অনেককে বলতে শুনলাম, ইসলামি মানেই সন্ত্রাসবাদী না হতে পারে, সন্ত্রাসবাদী মানেই ইসলামি। কিন্তু গুগলে সন্ত্রাসের প্রকারভেদ শব্দ দুটো টাইপ করলেই তাঁরা দেখতে পেতেন, সন্ত্রাস মানে যেমন শুধু ইসলামি নয়, সন্ত্রাস মানে শুধু ধর্মীয় সন্ত্রাসও নয়। কিন্তু তাই বলে ইসলামি সন্ত্রাসবাদ যে পৃথিবী জুড়েই একটা খুব বড় বিপদ, তা অস্বীকার করার উপায় নেই, কারণও নেই। ঠিক যে রকম কাশ্মীরে নিহত পর্যটকরা হিন্দু, তা-ও গোপন করার কোনও কারণ নেই।
সন্ত্রাসবাদের ধর্ম হয় কি না, সন্ত্রাসে নিহতদের ধর্মপরিচয় আলাদা করে উল্লেখ করা জরুরি কি না— অনেক রকম তর্কবিতর্কই চোখে পড়ছে। শিবির বিভাজনও এখানে অনেকটাই প্রকট। এই অতি স্পর্শকাতর আবহে সন্ত্রাসবাদের ধর্ম হয় কি হয় না, এটা আসলেই কোনও তর্কের বিষয় হতে পারে না। কারণ ধর্মীয় সন্ত্রাস সন্ত্রাসবাদের অন্যতম প্রকার হিসাবে স্বীকৃত। অন্যতম প্রকার, একমাত্র প্রকার নয়। যে সন্ত্রাসবাদীরা ধর্মের ঝান্ডার তলায় একত্রিত হচ্ছে, তাদের ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদী না বলে আর কী বলা হবে? এবং ঠিক একই যুক্তিতে তারা যে ধর্মের ঝান্ডার তলায় একত্রিত হচ্ছে, যে ধর্মীয় পরিচয়কে তারা সগর্বে তাদের অভিজ্ঞান করে তুলছে, সেই ধর্মের নাম অনুল্লিখিত রাখারই বা কী আছে?
নিহতের ক্ষেত্রেও একই কথা। কোনও বাজারে একটা বিস্ফোরণ হল। বহু মানুষ মারা গেলেন। নিহতের ধর্মপরিচয় সেখানে জরুরি নয়। কিন্তু ধর্মপরিচয়ের ভিত্তিতে বেছে নিয়ে যদি কাউকে হত্যা করা হয়, সেখানে তা উল্লেখ না করলে ঘটনাটির চরিত্র বিচারই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। হিটলার যে ইহুদিনিধন যজ্ঞে নেমেছিলেন, সে তো তাঁরা ইহুদি বলেই। সেখানে ইহুদিনিধনকে স্রেফ গণহত্যা বললে কি তার বিশেষত্ব বোঝা যাবে? গোরক্ষা বাহিনীর হাতে যখন শয়ে শয়ে মুসলিম খুন হয়েছেন, মুসলিম বলেই তো খুন হয়েছেন। আমেরিকায় কিছু দিন আগে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন হয়ে গেল। এখানে ‘ব্ল্যাক’ কথাটা বাদ দিলে কি চলবে? দলিত নিগ্রহকে তো দলিত নিগ্রহই বলি, নারী-নির্যাতনকে নারী-নির্যাতন। মানুষের দ্বারা মানুষের নিগ্রহ বা নির্যাতন বলে বর্ণনা করি কি? বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলাকে হিন্দুত্ববাদীদের কাজ না বলে কেবল ‘মব’-এর উন্মত্ততা বললে ন্যায্য হবে কি?
ইসলাম মানেই সন্ত্রাস নয় বা সন্ত্রাস মানেই ইসলাম নয়, এটা মনে করিয়ে দিতেও কিন্তু ইসলামি জঙ্গিবাদকে ‘ইসলামি জঙ্গিবাদ’ বলে ডাকার প্রয়োজন আছে। কারণ এই শব্দবন্ধ দিয়েই বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব, ইসলাম একটা আলাদা শব্দ। ইসলামি জঙ্গিবাদ আলাদা। ঠিক যেমন, হিন্দু একটা শব্দ। হিন্দুত্ববাদ একেবারে আলাদা। একই ভাবে ধর্মীয় কারণে প্রাণ হারালে নিহতের ধর্মপরিচয় বলতে ঢোঁক গেলার কোনও অর্থ নেই। তাতে সত্যের অপলাপ ছাড়া আর কিছুই হয় না। ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়াইয়েরও ক্ষতিই হয়। কারণ সে ক্ষেত্রে এটাও বলার জায়গা থাকে না যে, গ্লোবাল টেররিজ়ম ইন্ডেক্স ২০২৪-এ সন্ত্রাসপীড়িত একেবারে প্রথম সারির দু’টি রাষ্ট্র সিরিয়া এবং পাকিস্তান। অর্থাৎ ইসলামি জঙ্গিবাদ সবচেয়ে বেশি প্রাণ কাড়ছে মুসলিমেরই। ইসলামি জঙ্গিরা শুধু হিন্দুদেরই শত্রু নয়। এতদসত্ত্বেও অনেক সময় নিরাপত্তার স্বার্থে, আতঙ্ক-বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়াকে রোখার স্বার্থে শব্দচয়নে কিছু অস্পষ্টতার প্রয়োজন থাকে। বলা ভাল, থেকে এসেছে অনেক দিন পর্যন্ত। কিন্তু ইদানীং একাধারে তথ্য এবং ভুয়ো তথ্যের বিস্ফোরণের বাজারে সত্য গোপন কোনও মঙ্গল সাধন তো করবেই না, হিতে বিপরীত ঘটাতে পারে। বিশেষ করে যখন পহেলগাম-পরবর্তী দিনগুলিতে কট্টরবাদীদের সবচেয়ে রাগ গিয়ে পড়েছে উদারতার আদর্শের প্রতি, সহিষ্ণুতার বার্তার প্রতি, ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটির প্রতি। তাঁরা যেন মানসচক্ষে দেখতে পেয়েছেন, উদারতা-সহিষ্ণুতা-সংযম আর ধর্মনিরপেক্ষতাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে পারলেই দেশ সন্ত্রাসমুক্ত হবে। জঙ্গি দমনেরও আগে তাই উদারতার গলা টিপে ধরতে এগোচ্ছেন ওঁরা।
উদারবাদের প্রতি রাগের এই উদ্গিরণ দেখলে মনে হতে বাধ্য, দেশটা চালাচ্ছেন উদারবাদীরাই। তাঁদের হাতেই সব ক্ষমতা, তাঁরাই এ দেশের হর্তা-কর্তা-বিধাতা। নেটিজ়েনরা তাই উদারপন্থীদের কাছে পহেলগামের জবাবদিহি চাইছেন। কেউ কেউ এমন কথাও বলছেন, ‘মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম’ গানটাই আর গাওয়ার দরকার নেই। অনেকে দাবি তুলছেন, সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটা বাদ দেওয়া এই মুহূর্তে প্রথম কাজ হওয়া উচিত। অবলীলায় বলছেন, খুব দাপটের সঙ্গে বলছেন। যত চিৎকার করে বলছেন, তত বেশি মানুষ গলা মিলিয়ে জানাচ্ছেন, বটেই তো, বটেই তো!
এই উৎকট কলরোলে উদারবাদীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় নালিশটা কী? না, তাঁরা খালি ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেন আর হিন্দুত্ববাদের সমালোচনা যতখানি করেন, ইসলামি জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তত বলেন না। মজার কথা এই যে, ইজ়রায়েলের উদারবাদীদেরও ঠিক একই কথা শুনতে হয়— আপনারা নেতানিয়াহুর বিরোধিতা যতখানি করেন, হামাস নিয়ে তত বলেন না। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ইরান, ব্রিটেন, আমেরিকা— যেখানেই দেখা যাক না কেন, বয়ানটা একই। উদারবাদীদের বয়ানও এক, কট্টরবাদের বয়ানও এক। সকলেই সকলের দিকে আঙুল তুলে বলে, তুমি বেছে বেছে কথা বলছ!
সময় এসেছে, খুব জোরের সঙ্গে এটা বলার যে, কথা বেছেই বলতে হয়! কে কোন বিষয়ে কথা বলতে চাইবেন, কোন বিষয়কে গুরুত্ব দেবেন, কোন ঘটনায় কী ভাবে আন্দোলিত হবেন— বাছাই তো থাকবেই। সবার থাকে, সব পক্ষের থাকে। উদারবাদীর বাছাই এক রকম, কট্টরবাদীর বাছাই আর এক রকম। যেমন উদারবাদীরা পহেলগাম নিয়ে শোকার্ত হয়েছেন কিন্তু কট্টরবাদীরা দাদরি নিয়ে ক্রুদ্ধ হননি। মতাদর্শের তফাত আছে, তাই বাছাইয়েরও তফাত আছে। উদারবাদী মতাদর্শ বিদ্বেষকে হাতিয়ার না করার কথা বলে, খণ্ডকে সমগ্রের সঙ্গে এক করে না ফেলার কথা বলে। উপরন্তু সে বিশ্বাস করে— যে কোনও রাষ্ট্রেই মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরুকে একটু বেশি দায়িত্বশীল হতে হয়, আত্মসমালোচনার পাল্লা একটু ভারী রাখতে হয়। এই বিশ্বাস থেকেই তার মনে হয়, আধিপত্যের কণ্ঠস্বরের তলায় যে কথাগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে, সেগুলো সামনে আনা দরকার। সেখান থেকেই সে পক্ষ নেয়।
এই পক্ষাবলম্বন করতে গিয়ে পরিমিতির হেরফের হতে পারে। ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি সংখ্যালঘুর পাশে দাঁড়ানোর নাম করে তোষণের পথ নেয় না, এমন নয়, তাতে সংখ্যালঘুর ক্ষতি ছাড়া লাভ হয় না। কিন্তু নির্বাচনী রাজনীতির বাইরে থাকা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এটুকু অন্তত ডেঁটে বলতেই পারেন যে, তাঁর পক্ষাবলম্বনের মধ্যে অসদুদ্দেশ্য নেই, বিদ্বেষ নেই, বিভাজনের অঙ্ক নেই। কট্টরবাদীরা যে পর্যটক হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে হিন্দু পরিচয়টা অতিকায় আকারে প্রচার করছেন, সেটা তো নিখাদ সত্যের খাতিরে নয়, লোক খেপানোর লক্ষ্যে। উদারবাদীরা যে তার বিরোধিতা করছেন, সেটাও সত্য গোপনের উদ্দেশ্যে নয়। বিষবাষ্প আটকানোর তাগিদে। অভিপ্রায়ের এই তফাতটা চিনতে শেখা জরুরি।
একই সঙ্গে জরুরি, নাগরিকের মৌলিক অধিকার এবং কর্তব্যকে সামনে রাখা। নাগরিককে সুরক্ষিত রাখার জন্যই সরকার আছে, পুলিশ আছে, সেনাবাহিনী আছে, গোয়েন্দা বিভাগ আছে, ক্রমবর্ধমান প্রতিরক্ষা বাজেট আছে। সুরক্ষার পরিকাঠামো সব সময় জঙ্গি হানা রুখতে পারে, এমন নয়। কিন্তু পহেলগামের ক্ষেত্রে অন্তত সুরক্ষার গলদটা যে বড় বেশি বেআব্রু, সেটা অস্বীকারের উপায় নেই। পদাধিকারীদের প্রতি প্রশ্ন তোলার অভ্যাস, কৈফিয়ত চাওয়ার অভ্যাস এ দেশে খুব ভাল রকমই ছিল। সেই অভ্যাস ভুলিয়ে দিতে চাইছেন কারা এবং কেন— তা তলিয়ে ভাবা দরকার। নাগরিকের দ্বিতীয় লড়াইটা আরও গভীর।কারণ সেখানে লড়াইটা গুলি-বন্দুকের নয়, বরং চেতনার, বোধের। শুভ বনাম অশুভের লড়াইয়ে শুভকে যদি জিততে হয়, তা হলে শুভবুদ্ধি-শুভচেতনার প্রসারই একমাত্র কর্তব্য। বিদ্বেষের জোয়ারে ভেসে গেলে বিদ্বেষেরই প্রসার হয়, জঙ্গিবাদের লক্ষ্যই সফল হয়।
আজ যাঁরা সেকুলারিজ়মের আলখাল্লা খুলে ফেলার বীরত্বে উদ্বাহু, তাঁরা ওই ঘৃণা আর বিদ্বেষের পরীক্ষাগারে গিনিপিগ জোগান দিচ্ছেন মাত্র। আর উদারবাদীদের অপরাধ হচ্ছে, তাঁরা কোনও নারকীয় অপরাধকে ব্যবহার করে বিষ ছড়ানোর বিরোধী। তাঁরা এটা ভুলে যাওয়ার বিরোধী যে, শোকার্ত হওয়া মানে বিদ্বেষের বিষ ওগরানো নয়। সেকু-মাকু-ওকু-লিবুদের গণশত্রু হিসাবে চিহ্নিত করার আগে চশমাটা একটু মুছে নিলে ভাল।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)