দামের বিনিময়ে খ্যাতির শিরোপা বিক্রি চিরাচরিত পুঁজিবাদের নীতিরই নতুন ব্যবহার। প্রতীকী ছবি।
রঞ্জা বেশ উঁচু পদে চাকরি করেন এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। পাশাপাশি তিনি নিজেকে এক জন ‘মোটিভেশনাল স্পিকার’ হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে তুলতে পেরেছেন। নানা জায়গা থেকে আজকাল বক্তৃতা করার ডাক পান তিনি। প্রায় প্রতি দিনই অফিসের কাজ শেষ করে এই সব ইমেল পড়তে বসেন রঞ্জা। এক দিন একটা ইমেল পড়ে একটু থমকে গেলেন তিনি। প্রেরক লিখছেন যে, তাঁরা রঞ্জাকে তাঁদের ‘ফর্টি আন্ডার ফর্টি’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে চান— অর্থাৎ, চল্লিশ জন অনূর্ধ্ব-চল্লিশ ব্যক্তির তালিকা, যাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে কৃতী। সম্মান প্রদর্শনের এ এক পরিচিত পন্থা, আন্তর্জাতিক স্তরেই। কিন্তু, ইমেল প্রেরক জানিয়েছেন, সেই সম্মান পাওয়ার জন্য রঞ্জাকে কিঞ্চিৎ অর্থদক্ষিণা দিতে হবে।
এটাও ব্যবসা। খ্যাতির ব্যবসা। আজকাল অনেকেই ইন্টারনেটের সুবাদে নিজেদের সৃষ্টিশীলতাকে বৃহত্তর পরিসরে পৌঁছে দিতে পারছেন। খ্যাতি এবং পরিচিতিও লাভ করছেন দ্রুত। তার পরেই তাঁরা হয়ে যাচ্ছেন খ্যাতি-ব্যবসায়ীদের লক্ষ্য। শুধু অভিনেতা-লেখক-পাবলিক স্পিকার নন, গবেষকরাও নিয়মিত ইমেল পান বিভিন্ন ‘প্রেডেটরি’ জার্নাল থেকে। ইমেলে জানানো হয়, গবেষণাপত্রটি তারা খুব দ্রুত প্রকাশ করার ব্যবস্থা করবে, যদি লেখক কিছু অর্থমূল্য দিতে রাজি হন। একের পর এক প্রলোভন এক সময়ে প্রাপককে ভাবতে বাধ্য করায় যে, সত্যিই তো, এই ক’টা টাকায় আমি যদি আরও জনপ্রিয় হতে পারি?
এই অবধি পড়ে মনে হতেই পারে যে, এ আর নতুন কথা কী? পুরস্কার যে কেনা যায়, সে তো সবাই ‘জানে’। তা নিয়ে হাসাহাসিও হয় বিস্তর। কিন্তু, নতুন কথা একটা আছে— আগে সেই পুরস্কার কেনা-বেচার বাজারটা ছিল সীমিত, এখন কার্যত প্রত্যেকেই সেই বাজারের সম্ভাব্য ক্রেতা। ইন্টারনেট এসে খ্যাতিকে কতিপয়ের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে সর্বজনীন করেছে— সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে খ্যাতিমান হওয়া, বা সেই সম্ভাবনাকে স্বীকার করার মতো লোকের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে, বাজারটি এক অর্থে নতুন। আসলে যে খ্যাতি বা জনপ্রিয়তা এক সময় ছিল স্বীয় ক্ষেত্রে সাফল্যের প্রতীক, তা নিজেই এখন হয়ে গেছে একটি পণ্য। যা পেতে হলে নোবেল বা অস্কার পেতে হয় না, অভিনয় বা খেলাধুলা করতেই হবে, এমন মাথার দিব্যিও নেই। ইনস্টাগ্রাম বা টিকটক-এর এক মিনিটের ভিডিয়ো কাউকে করে তুলতে পারে তুমুল জনপ্রিয়। কেউ যদি কোনও ভাবে একটি বড় পরিসরের মানুষের চাহিদা বুঝতে পেরে সেই মতো বিষয়বস্তু সৃষ্টি করতে পারেন, তবেই তিনিও এক জন ‘ক্রিয়েটর’। আর এই সর্বজনীনতার ঢেউকেই বলা হয় ‘সৃজনী অর্থনীতি’ বা ‘ক্রিয়েটর ইকনমিকস’।
লক্ষ করলে বোঝা যায় যে, এই আপাত-বৈপ্লবিক পরিবর্তনের স্বরূপ কিন্তু বহু পুরনো এবং অর্থনৈতিক। বিগত শতাব্দীর গণ-উৎপাদনের ধারার কথা ভাবা যেতে পারে। সেখানেও মুষ্টিমেয় উৎপাদকের বজ্রমুষ্টি থেকে প্রযুক্তিকে মুক্ত করে বেশি সংখ্যায় সাধারণ মানুষকে উৎপাদক হতে উৎসাহিত করা হয়েছিল। আরও পিছিয়ে গেলে দেখা যাবে, একই ভাবে সম্পত্তির উপরে সামন্তপ্রভুদের একচেটিয়া কায়েমি অধিকারের বেড়াজাল ছিন্ন করে ধনতন্ত্রের উত্থান হয়েছিল। সেই নিরিখে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রগতিকে বিশ্লেষণ করে দেখলে ধনতন্ত্রের আর এক দফা পদধ্বনি শুনতে পাওয়া স্বাভাবিক।
ধনতন্ত্রের প্রস্তাবনা অনুযায়ী সব পণ্যের মান যদি বাজারের চাহিদাই নির্ণয় করে, তবে খ্যাতি বা জনপ্রিয়তাই বা বাদ যায় কেন? এ ক্ষেত্রেও পুরনো পদ্ধতি— যা নির্ধারিত করত কে পাবে খ্যাতির মুকুট— তা সর্বসাধারণকে সেই জনপ্রিয়তার আলো থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। কিন্তু এখন নিজের জীবনের খুঁটিনাটি দেখানোকে শিল্প বা সৃষ্টিশীলতা বলা যায় কি না, তার বিচার কতিপয়ের হাত ছেড়ে চলে এসেছে একেবারে জনতার হাটে। আর হাটে বেচা-কেনা তো হবেই। যদি জনপ্রিয়তার চাহিদা থাকে, তা হলে জোগান আসতে বাধ্য। আর তাতে দাম লেখা কাগজও থাকবেই!
দামের বিনিময়ে খ্যাতির শিরোপা বিক্রি চিরাচরিত পুঁজিবাদের নীতিরই নতুন ব্যবহার। এতে আলাদা করে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এক সময় সোশ্যাল মিডিয়ায়— ফেসবুক-টুইটারে— যাঁরা নিজেদের ক্ষেত্রের স্বীকৃত এক্সপার্ট, তাঁদের প্রোফাইলের পাশে একটা নীল রঙের টিক থাকত এবং টুইটারে সেই স্বীকৃতি পাওয়া যেত বিশেষজ্ঞদের মনোনয়নের পরে। এই পদ্ধতিতে এলিটিজ়ম-এর গন্ধ পাওয়া টুইটারের নতুন মালিক এলন মাস্ক নীল দাগের স্বীকৃতিকে আট ডলারের বিনিময়ে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। ঠিক না বেঠিক, সেই আলোচনায় না গিয়েও বোঝা যায় যে, এখানেও জনমান্যতাকে অন্য সব কিছুর মতো আর্থিক মানদণ্ডে পরিমাপ করার চেষ্টা হচ্ছে।
তবে হঠাৎ করে কোনও কিছুকে খোলাবাজারে অর্থের বিনিময়ে সহজলভ্য করে তুললে তার একটি ফল হল অবমূল্যায়ন। নোবেলজয়ী সাহিত্যিক জন স্টাইনবেক ইস্ট অব ইডেন বইয়ে লিখেছিলেন, সব মহান এবং দুর্লভ জিনিসই বোধহয় একান্তই একাকী। সত্যিই, আমরা তো জানি যে, পথের ধারে অজস্র ছড়িয়ে থাকলে হিরের দামও কানাকড়ির বেশি থাকে না। টুইটারের নীল দাগের ক্ষেত্রে অনেকেই আট ডলার দিয়ে সেলেব্রিটি স্টেটাস কিনেও সন্তুষ্ট নন, সবাই সেলেব্রিটি হয়ে গেলে কি আর সেই খ্যাতির কোনও মানে থাকে? হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির দার্শনিক মাইকেল স্যান্ডেল তাঁর হোয়াট মানি কান’ট বাই বইটিতে প্রশ্ন করেছিলেন, যে পুরস্কার কেনা যায়, এবং যে পুরস্কারের ক্ষেত্রে সবাই জানে যে সেটি কেনা যায়, সেই পুরস্কারের কি কোনও অর্থ হয়? যে কোনও সম্মানের ক্ষেত্রেই এই প্রশ্নটি প্রযোজ্য।
তবু অনেকেই এই খ্যাতির শর্টকাটটি বেছে নিচ্ছেন। সৃজনী অর্থনীতির ধারণা পুঁজিবাদেরই পরবর্তী ধাপ। এবং তা সহজে চলে যাওয়ার নয়। খ্যাতি, বিশ্বাসযোগ্যতা, জনপ্রিয়তা— সবই আয়ত্তের মধ্যে চলে আসতে পারে, যদি কেউ উপযুক্ত দাম দিতে রাজি থাকেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy