Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Narendra Modi

ভারত গণতন্ত্রের জননী! আর পশ্চিমবঙ্গ?

বৌদ্ধ ধর্ম পালিয়ে বেঁচেছে চিনে, জাপানে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের পরে প্রজাতন্ত্রের নাম ও নিশান মিটে গিয়েছিল। দরকার ছিল তাকে ফিরিয়ে আনার? পিএম মোদী কি সেই ভুলই করলেন যা নেহেরু করেছিলেন?

Origin of Democracy in Ancient India & the Political Hinduism of Narendra Modi

পিএম মোদীর উক্তি কি দেশের ভক্তকুলকে বিভ্রান্ত করেছে? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

অর্ধেন্দু সেন
অর্ধেন্দু সেন
শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৮:০৫
Share: Save:

প্রাচীন ভারত কি গণতন্ত্রের জননী? এমনটাই মনে করেন পিএম মোদী। এ কথা তিনি রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় বলেছেন। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেসের যুগ্ম অধিবেশনে তার পুনরাবৃত্তি করেছেন। কিন্তু কেন? একটা কারণ হতে পারে এই যে, ইদানীং পিএম মোদীর সমালোচনায় নোটবন্দির কথা ওঠে না। তাড়াহুড়ো করে জিএসটি চালু করার কথা ওঠে না। মেক ইন ইন্ডিয়া প্রকল্পের ব্যর্থতার কথা ওঠে না। সে বিভীষিকা আমরা পিছনে ফেলে এসেছি। এখন তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ভারতে গণতন্ত্র ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছেন। সরাসরি এ কথার বিরোধিতা তিনি করেননি। করলে তা হত তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। কোনও সমালোচনাকেই সে গুরুত্ব তিনি দিতে চান না। তা না-করেও সহজেই তিনি বোঝাতে চেয়েছেন তিনি গণতন্ত্রের প্রকৃত অনুরাগী।

দ্বিতীয়ত, মোদীর নেতৃত্বে ভারত এখন বিশ্বগুরুর পদের দাবিদার। ন্যায্য দামে কোভিডের ভ্যাক্সিন সরবরাহ করবে কে? ভারত। বিশ্বের বাজারে খাদ্যশস্যের ঘাটতি মেটাবে কে? ভারত। ডলারের স্থায়ী বিকল্প হবে কোন মুদ্রা? ভারতীয় রুপয়া। ইউক্রেনের যুদ্ধ থামাবে কে? ভারত। যুদ্ধ অবশ্য থামেনি কিন্তু তার তীব্রতা তো কমেছে! মার্ক টালি তো বলেই দিয়েছেন ‘দেয়ার আর নো ফুলস্টপস ইন ইন্ডিয়া’। বিশ্বের জানা দরকার, নেতৃত্বের দাবি কোনও উটকো দাবি নয়। ভারত চিরকালই গুরুর পদে আসীন। এমনকি পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলির প্রিয় গণতন্ত্র— তা-ও ভারতের অবদান।

প্রাচীন ভারতের রাজনীতি সম্বন্ধে কতটুকু জানি আমরা? জানি অনেকটাই, কারণ রাজনীতি নিয়ে পঠনপাঠন আর আলোচনা সেই সময়ে কম হয়নি। অর্থশাস্ত্রে তো বটেই, মহাভারতের শান্তিপর্বে রাজধর্মের উপর দীর্ঘ আলোচনা আছে। বেশ কিছু কাল পরে লেখা মনুস্মৃতি তো জগৎবিখ্যাত। এ ছাড়া কিছু পুরাণে এবং ‘ব্রাহ্মণে’ এ বিষয়ে মন্তব্য করা হয়েছে। ঐতীরিয় ব্রাহ্মণে গল্প আছে যে— দেবতারা একবার অসুরদের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হলেন। অনুসন্ধান করে দেখা গেল এই পরাজয়ের কারণ, দেবতাদের কোনও রাজা নেই। তখন দেবতারা মিলে মহাপরাক্রমশালী ইন্দ্রদেবকে রাজা মনোনীত করলেন। এ গল্পে রাজার মাহাত্ম্য পরিষ্কার। বিপদের সময়ে রাজাই পারেন প্রজাদের রক্ষা করতে। মনে হতে পারে এ কথাও বলা হয়েছে যে রাজা হবেন নির্বাচিত। তা কিন্তু ঠিক নয়। স্বর্গে কারও মৃত্যু হয় না। কাজেই উত্তরাধিকারের প্রশ্ন ওঠে না। মর্ত্যে সেটাই মুখ্য প্রশ্ন। কোনও বিশেষ সময়ে রাজা নির্বাচিত হতেই পারেন। তাই বলে তার সন্তান সিংহাসনের দাবি ছেড়ে দেবে তার কোনও মানে নেই।

সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতা অথবা সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকার সভ্যতাই ভারতে সর্বপ্রাচীন বলে ধরে নেওয়া হয়। মনে করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সাল পর্যন্ত ছিল এই সভ্যতার সময়কাল। তার পর কোনও এক অজ্ঞাত কারণে এই সভ্যতার বিনাশ হয়। মহেঞ্জোদারো এবং হরপ্পা এই সভ্যতার দুটি উজ্জ্বল নিদর্শন। এখন রাখিগড়ির মতো অন্য নগরের হদিশ পাওয়া গিয়েছে। এই সভ্যতা সম্বন্ধে আমরা যথেষ্ট তথ্য পাইনি এই কারণে যে, এদের লিপি উদ্ধার করা যায়নি। অনেকে অনুমান করেছেন, এই সময়ে রাজত্ব করতেন পুরোহিত-রাজারা। এর পর এল বৈদিক যুগ। ঋগ্বেদ এবং অন্য তিনটি বেদ রচিত হল। এই যুগে প্রতিষ্ঠিত হল ছোট বড় রাজার রাজত্ব। রাজা চান ছোট থেকে বড় হতে। ব্রাহ্মণ বলেন সে জন্য যজ্ঞের প্রয়োজন। তাই চালু হল অশ্বমেধ ইত্যাদি যজ্ঞ। বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ হিসেব করে ঠিক করে দিলেন যজ্ঞের বেদি কী রকমের হবে।

সে ভাবেই চলছিল। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে দুটো বড় পরিবর্তন এল। এক দিকে ভগবান মহাবীর এবং গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাব হল। জৈন এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার এবং বিস্তার হল। অন্য দিকে এ হল নগরায়নের যুগ। প্রধানত কৃষক এবং গোপালকের দেশে উত্থান হল শ্রেষ্ঠীদের। এদের অনেকে হলেন জৈন এবং বৌদ্ধ। ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতি হওয়ায় নগরের পত্তন হল। সঙ্ঘাশ্রম ধর্মের প্রভাবে নগরগুলির পরিচালন ব্যবস্থা এল নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে। দেশের সিংহভাগ রয়ে গেল ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের পার্টনারশিপে। বাকিটা এল ব্যবসায়ীদের হাতে। এই সময়ে ১৬টি মহাজনপদ গড়ে ওঠে। এদের মধ্যে বিখ্যাত হয় লিচ্ছবি, শাক্য, মল্ল এবং কোশলদের জনপদ। লিচ্ছবি জনপদ ভগবান বুদ্ধের আশীর্বাদধন্য হয়। তিনি বলেন, লিচ্ছবিদের সংবিধান যত দিন থাকবে তত দিন কেউ তাদের পরাজিত করতে পারবে না।

ষোড়শ জনপদ।

ষোড়শ জনপদ। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে অ্যালেক্সান্ডার ভারত জয় করতে আসেন। ফিরে যান ব্যর্থ হয়ে। একাধিক নগর ও জনপদ তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে। অ্যালেক্সান্ডার ফিরে যাবার অব্যবহিত পরে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সাম্রাজ্যের পত্তন করেন। সম্রাট অশোক ছিলেন তাঁর পৌত্র। ভারতবর্ষের অনেকটাই এই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। বলা বাহুল্য, এই শক্তিশালী সাম্রাজ্যের দাপটে জনপদগুলি নিশ্চিহ্ন হয়। পুনর্বার এদের উত্থান দেখা যায় মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তিমকালে। গুপ্তযুগের উত্থানকালে দেখা যায় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। গুপ্তযুগকে বলা হয় হিন্দুদের স্বর্ণযুগ। এই যুগ শেষ হবার অল্প পরেই দেশ চলে যায় ইসলামধর্মী লুটেরাদের হাতে। তার পর আসে ইংরেজ শাসন।

প্রাচীন ভারতের গৌরবগাথায় আমরা শুনতে অভ্যস্ত হয়েছি গুপ্তযুগের নাম। হয়তো বা মৌর্যদের নাম। লিচ্ছবিদের নাম কে কবে শুনেছে? চিরকাল শুনে এসেছি বিদেশি আক্রমণ ঠেকাতে প্রয়োজন হয় বিরাট সাম্রাজ্যের। শক্তিশালী রাজার। গজনি বা ঘোরি থেকে শি জিনপিং আমাদের সেই শিক্ষাই দিয়ে এসেছেন। তাই তো আমরা পণ্ডিত নেহরুকে অশ্রুজলে বিদায় জানিয়ে পিএম মোদীকে বসিয়েছি হৃদয়াসনে। আজ যখন চিন দাবি করছে অরুণাচল প্রদেশ তাদের, দাবি করছে লাদাখের অংশও, তখন লিচ্ছবিদের কথা মনে করিয়ে দেওয়া কি কাজের কাজ হয়েছে? বৌদ্ধ ধর্ম পালিয়ে বেঁচেছে চিনে, জাপানে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের পরে প্রজাতন্ত্রের নাম ও নিশান মিটে গিয়েছিল। দরকার ছিল তাকে ফিরিয়ে আনার? পিএম মোদী কি সেই ভুলই করলেন যা নেহেরু করেছিলেন? মমতা কি কখনও বলেন, আমাদের দেশে পশ্চিমবঙ্গই কমিউনিজমের জননী?

আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাসের মিল আছে। খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতক পর্যন্ত গ্রিস ছিল রাজার রাজত্বে। ৫০৮ খ্রিস্টপূর্বে আথেন্স নগরে প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হয়। প্রজাতন্ত্র হলেও ক্রীতদাসদের ভোট ছিল না। যদিও সংখ্যায় তারাই ছিল অধিক। ভোট ছিল না মহিলাদেরও। পিএম মোদীর মূল্যবান উক্তির আগে আথেন্সকেই মনে করা হতো গণতন্ত্রের জননী। খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৯ সালে পারস্যের রাজা আথেন্স আক্রমণ করলে ম্যারাথনের যুদ্ধে আথেন্সের জয় হয়। পারস্যের সঙ্গে দ্বিতীয় যুদ্ধ হয় খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৯ সালে থারমোপাইলিতে। এ বার কিন্তু পারস্যের সম্রাট জয়ী হন। গ্রিসের ইতিহাস আমাদের কি শেখায়? কোনও বিশেষ তন্ত্রের সাধনা নয়। দেশের প্রয়োজন শক্তির সাধনা।

পিএম মোদীর উক্তি কি দেশের ভক্তকুলকে বিভ্রান্ত করেছে? ভক্তদের মধ্যে যে ব্যক্তিটিকে বিলক্ষণ চিনি, তিনি হলেন অবসরপ্রাপ্ত আমলা। তিনি কি ভাবছেন? আমলারা কোনও কালেই গণতন্ত্রের পূজারি নন। নীতি আয়োগের ভারপ্রাপ্ত এক আমলা আক্ষেপ করে বলেছিলেন, আমাদের দেশে বড় বেশি গণতন্ত্র। গণতন্ত্র মানেই তো জমি অধিগ্রহণে দীর্ঘসূত্রিতা। চিনে যে প্রকল্প রূপায়িত হয় এক বছরে তা আমাদের দেশে তিন বছর নেবে কেন? তা হলে আমরা চিনের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হব কী করে? তাদের আগ্রাসন ঠেকাবো কী করে? প্রধানমন্ত্রী বিদেশি অপপ্রচারের জবাব দিতে যা বলার বলেছেন। দেশের লোকের যেটুকু জানার দরকার তা তিনি ‘মন কি বাত’-এ বলবেন!

(লেখক পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব। মতামত নিজস্ব।)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy