ফসল কাটায় ব্যস্ত একা-মেয়ের গান, শুনেছিলেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ। মুগ্ধ কবির পরামর্শ, শুধু দেখা নয়, অবলোকন করতে হবে মেয়েটিকে: ‘বিহোল্ড’। দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে কান পাততে বলেছিলেন সে-গানে অথবা নীরবে চলে যেতে বলেছিলেন। কী ছিল সে-গানে, নানা আন্দাজ। হয়তো অতীতের বেদনা, প্রাচীন লড়াই-অনুষঙ্গ, নিভৃত বিচ্ছেদ-স্মৃতি। আচম্বিতের দান সে-গান শেষ হয়েও নিবেদন-স্পন্দনে অশেষ।
নিবেদন আর আচম্বিতের সেই মাধুর্যই মহম্মদ রফিতে (ছবি)। আর খানিক আধ্যাত্মিক আকর্ষ। তাঁর ভোরের গানে ঘুমজড়ানো আবেশ, রাত্রিগান নিঃসঙ্গতার সান্ত্বনা। উদ্যাপনে রং, বেদনায় দার্শনিকতা। ভাল সুর-গান-গায়কির সঙ্গে পরিণতি-অনিশ্চিত ভালবাসার যে রহস্য-মিল, যার গন্ধরেণু লোকসুরে, মার্গগানে। উপমহাদেশের সঙ্গীত-শস্যখেতের ‘সলিটারি রিপার’ মহম্মদ রফিতে সেই প্রত্যাশাহীন কাঙালপনা।
কাব্য-কলার মতোই সঙ্গীত সঙ্কেতধর্মী। সব বয়ানে নাগাল মেলে না। মিললে গন্তব্য আনন্দ-মধুর, বিষাদ-মধুর। ‘ওই দূরদিগন্তপারে যেথা আকাশ-মাটিতে কানাকানি/ তোমার-আমার শুধু এমনি করেই জানাজানি’— ছোটবেলায় প্রথম শোনা। আজ প্রায় কোথাও বাজে না। কিন্তু রেলগাড়ির জানালায় চোখে পড়া মাঠ-মাদুর আর আকাশ-ওড়নার মিলনে আজও তার সঙ্কেত। রফির সে-গানের সুরকার বিনোদ চট্টোপাধ্যায়, গীতিকার পবিত্র মিত্র। ছাপা নাম দেখার আগে অবধি ‘দূরদিগন্তপারে’ তালাত মাহমুদের গান বলেই ভাবতাম। তিরতির তরঙ্গগতিই হয়তো কারণ, যাতে তালাত নেশা ধরাতেন। তালাত, রফির মতোই জন্মশতবর্ষে যিনি। ‘আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়’, পাশে তালাত থাকতেন বহু বাঙালি-বাড়িতে, একদা। মাহমুদ-কম্পিত কানেই দূরদিগন্তপারে রফি বেজেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত তখনও ফিল্মি হিন্দি গান শোনার সৌভাগ্য সম্মতি পায়নি বাড়িতে।
সম্মতির শুরুতেই ভিন-ঝামেলা। সে উৎপাত তখন ময়দান, রাজনীতি, পর্দা— সর্বত্রই। বেছে নিতেই হবে, তুমি মোহনবাগান না ইস্টবেঙ্গল, হেমন্ত না মান্না, সিপিএম না কংগ্রেস, উত্তম না সৌমিত্র, রফি না কিশোর! বাড়িতে হেমন্ত-মান্না জলবণ্টন, বন্ধুচক্রে রফি-কিশোর কাঁটাতার। বহু বার দলবদল করলেও দলের সংজ্ঞা বদলে দেয় বয়স— পুরু-আলেকজ়ান্ডারের তুলনা করতে নেই!
তবু তুলনা ছিলই। সে-কালের তুমুল দুই শিল্পী মান্না-রফি পরম্পরা-প্রশিক্ষিত। ছবিশিল্পে শাস্ত্রীয় স্পর্শের গান পুরুষ কণ্ঠে তাঁদের ছাড়া ভাবা যেত না। তবে মান্নার বিবেচনায়, ‘রফিসাব’ সবার উপরে। বলতেন, শাস্ত্রীয় ঘরানায় যেমন পাটিয়ালা-আগরা-কিরানা, তেমনই হিন্দি ছবিগানে রফি-ঘরানা। সৌভাগ্য ঘটেছিল মান্না দে-র সঙ্গে কথা বলার। প্রশ্নের সুযোগমাত্র না দিয়ে বলেছিলেন— রফি অদ্বিতীয়। ভক্তিভাবে, গানের নাটকীয়তায়।
ভক্তির হৃদিসীমা বেলপাতা-চাদর-প্রার্থনায় বন্দি নয়। ভক্তি-ভাবনার মাটিই প্রেম-পদাবলি দিয়েছে, মীরা-নিবেদন দিয়েছে, খসরু-লালনের মিলনার্তি দিয়েছে। ভারতীয় তথা উপমহাদেশের গানবাজনার সঙ্গে ভক্তির নাড়িযোগ। ভক্তিরস নিজের ভাণ্ড উপচে মিশে-ছড়িয়ে রয়েছে সব রসপাত্রে। রবীন্দ্রনাথেও যেমন— প্রেম-পর্যায়ে ছড়াছড়ি পূজা-আঙ্গিকের গানের এবং উল্টোটাও। রফি সব ধরনের গানে ভক্তিরসের অণুধর্মেরই সম্পাদনা করে গিয়েছেন। প্রেমের গানে তাঁর নিবেদন সুফিয়ানা। সরাসরি ভক্তিগানে তিনি প্রেমভিখারি।
‘এহসান তেরা হোগা মুঝ পর’— শঙ্কর-জয়কিসানের সুরে জংলি ছবির এই প্রেমের গান চেনা কাঠামোর ভজনের মতোই, রফির ‘তৃণাদপি সুনীচেন’ বৈষ্ণব পেশকারি ছাড়া যে জাদু সম্ভব হত না। একই গানে লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠ-চলন ঢের বেশি শরীরী প্রেমের। প্রেমের গান রফিতে অতীন্দ্রিয়। অন্য দিকে, সরাসরি ভক্তিগানে রফি বাসনা-কামনার গন্ধবিধুর। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য তাঁর ভাই পান্নালাল সম্পর্কে বলতেন— ‘পান্নার মতো নাড়িছেঁড়া মা-ডাক ডাকতে পারলাম কই!’ এই বাসনার্তি দিলীপকুমার রায়েও দ্রাব্য। তেমনই, ক’জনের ‘হরি ওম্’ ধ্বনি ভিতরকণিকা উজাড় করা? বড়ে গোলাম আলি খানের নাম মনে আসবেই। আসবেন রফিও। সাকিল বদায়ুনির কলমে নৌশাদের সুরে রফির ‘মন তরপত হরি-দরশনকো’। বৈজু বাওরা ছবিতে মালকোশ-নিবদ্ধ সে গানে অচিন গ্লানির ‘ক্যাথারসিস’ ঘটে যায়, তা সে শ্রোতা নিরীশ্বরবাদী-অজ্ঞেয়পন্থী হলেও।
গানের নাটকীয়তাতেও রফি হ্যামিলিনের বাঁশি। নাটকীয়তা-অতিনাটকীয়তা নাট্যগুণ, আর সঙ্গীত নাট্যেরই অংশ। ভারসাম্য জরুরি এবং ‘যে পারে সে আপনি পারে’। ‘তর্ফ রহে হ্যায় হাম ইহাঁ তুমহারে ইন্তেজ়ারমে’ রফিতে প্রথমে উচ্চারিত হয় ‘ইন্-তেজ়ারমে’— ‘ইন্’ অংশের পরে খানিক থমকে যান গায়ক— থমকানোয় প্রতীক্ষার শরীর দেখা যায়।
বাঙালির বাড়তি সুবিধা গানের নাটকীয়তা অনুভবে। বন্ধু রবীন্দ্রনাথ। কাব্যগীতির উজাড় নাটকীয়তা সেখানে। কিন্তু সুবিশাল দেশের গানবাণিজ্যে রাজত্ব কেন রফির নাট্যময়তার? কারণ, শত ‘সিন্ডিকেট’ সত্ত্বেও মধুরের আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য।
‘সিন্ডিকেট’ই তৈরি হয়েছিল তাঁর গানজীবনের গোধূলিতে। কিশোর-কালের আগে হিন্দি ছবির সুর ছিল মূলত রাগাশ্রয়ী। সুরকারেরা মার্গগানে তুখোড়। গাওয়াতেন উস্তাদ-পণ্ডিতদের দিয়েও। আর সমপ্রাখর্যের শিল্পীরা তো ছিলেনই। মান্না, রফি, লতা, আশারা। সেই ‘রাগশিবির’ শচীন দেব বর্মণ, নৌশাদ, ও পি নায়ার, মদনমোহন, শঙ্কর-জয়কিসানদের মতো নক্ষত্র-সঙ্গীতকারের আকাশগঙ্গা। ছিল অমিত-ব্যতিক্রমী অন্য দুই শিবির। তারও একটির জাদুকর শচীনকর্তা, সেখানে রাজত্ব হেমন্ত মুখোপাধ্যায়দেরও। সেখানে রাগ-রাগিণী অপ্রকট ভাবে সুপ্রযুক্ত, স্পষ্ট মাটিগানের আলিম্পনও। অন্যটি সলিল চৌধুরীদের সাম্রাজ্য, জন্মশতবর্ষের বিভা ছুঁয়ে যাচ্ছে সলিলকেও। সলিলে প্রাচ্য-জানালা খোলা হলেও পশ্চিম-দুয়ার উন্মুক্ত বেশি। বাবার উত্তরাধিকার মেখেও সলিলে স্নান করলেন রাহুল দেব। তাঁর ভিয়ানে দেশি-বিদেশি ক্লাসিক্যাল, লোকসুর মিলে নতুন পদ। সে সুগন্ধে ঝলসে উঠলেন সহজিয়া গায়ক কিশোরকুমার। এই ধারায় কিশোর অনিবার্য হলেন। তখতে গানসম্রাটের বদল ঘটল। আসলে, বদলাল সুরের জলবায়ু।
ঋতুবদলের আসন্নতা আন্দাজ করেননি রফি। বিরতি নিয়ে তীর্থযাত্রা। ফিরেও কিছুকাল বিশ্রাম লম্বা সময়ের সম্রাটের। মধ্যে পটবদল। যদিও কিশোর-ইনিংসেও ছক্কা হাঁকানোর জন্য রফির ডাক পড়ত, রাগাশ্রয়ী গানে। সেখানে ‘রফিসাব’ ছাড়া ভাবা যাবে না, জানিয়ে দিতেন কিশোরও। তবে তাঁর প্রতি গানমহলের হিরণ্ময় নীরবতার কারণ জানতে বন্ধু-পরিজনকে নাকি জিগ্যেস করতেন রফি— ফুরিয়ে গিয়েছেন সত্যি?
‘ফুরায় যা, তা ফুরায় শুধু চোখে’। নয়া জমানাতেও ঘটেছিল রফি-তুফান। রাহুলের সুরে ‘হাম কিসিসে কম নেহি’ ছবির গানে কৌতুকী সমাপতন ঘটল, গানজীবনের সঙ্গে ছবিনামের! পাড়ামণ্ডপের চোঙা উপচে ঝরতে লাগল ‘কেয়া হুয়া তেরা ওয়াদা’র নির্ঝর, মায়ামেঘে জমতে লাগল ‘চাঁদ মেরা দিল’। ওই ছবিতে মারকাটারি কিশোরের ‘বাচনা এ হাসিনো’র মতোই ‘কেয়া হুয়া তেরা ওয়াদা’ হয়ে উঠল সময়ের ‘থিম সং’।
এমন বহু গানই গাইলেন রফি। অগুনতি জগঝম্পও। রফির ‘ঘরে বসত করে কয়জনা’? একুশ বছরে ছবিগানে প্রবেশ। আশি বছর বেঁচে তাঁর গান। কারণ, তাতে রয়েছে প্রকাশভঙ্গির সমান্তরাল চিত্রনাট্যও, যা স্তুতির ঊর্ধ্বে বিস্ময়, ‘তারিফ করু কেয়া উসকি যিসনে তুমহে বানায়া’?
নানা কাহিনি তুলে ধরে এক সূক্ষ্মতাবাদীকে। যিনি রেকর্ডিংয়ের আগে দীর্ঘ সময় চেয়ে নেন অভিনেতার বাচনভঙ্গি আত্মস্থ করতে, ‘কেয়া-বাত’ রেকর্ডিংয়ের পরেও সুরকারের বাড়ি গিয়ে কান্নাকাটি করেন ‘রিটেক’ চেয়ে।
নৌশাদ, শচীন দেব, হেমন্তকুমার, সলিল, নায়ার, মদনমোহন, শঙ্কর-জয়কিসান, জয়দেব, রবি, রোশন বা রাহুল দেব— সবার কাছেই রফি মানে অবিশ্বাস্য স্বরসীমাতেও সাবলীল ‘নোট’, তুমুল চড়াতেও স্পষ্টতা, ‘মেলডি’-সুরক্ষিত ‘মডিলিউশন’, তুঙ্গশিখর থেকে অতলমন্দ্র ‘রেঞ্জ’ এবং বাড়তি কিছুও। এই ‘বাড়তি’টি রফির পেশকারি, রেকর্ডিংয়ের আগে অবধি যা সুরকারেরও অজ্ঞাত। বলা হয়, দক্ষ সুরস্রষ্টা সুরদ্রষ্টাও, গানের অবয়ব দেখতে পান। ‘তুমি যে আমার’ গানের খসড়া-সুর শুনিয়ে ছবির পরিচালক অজয় কর, নায়ক-প্রযোজক উত্তমকুমারকে বলেছিলেন হেমন্ত— ‘গাইবে কিন্তু গীতা’। সুচিত্রার ‘লিপ’, সন্ধ্যার বদলে গীতা দত্ত? ‘এ গান গীতার মতো ভারতে কেউ গাইতে পারবে না’ বলে ঘর ছেড়েছিলেন হেমন্ত— বাকি ইতিহাস। একই ভাবে ‘রফি ছাড়া অসম্ভব’ গোত্রের গানে ইতিহাস গড়েছেন বহু সঙ্গীতকার। শুধু ‘চাহে কই মুঝে জংলি কহে’র দুরন্ত দ্রুতির মধ্যেও অবিশ্বাস্য ‘এনার্জি’ নয়, ‘মধুবন মে রাধিকা নাচে’র অকৃপণ হাম্বির-শৃঙ্গারই নয়, রফি-ম্যাজিকেই সম্ভব ‘আকেলে আকেলে কাঁহা যা রহে হো’র স্বরশৃঙ্গ অতিক্রমণ, ‘লিখে যো খত তুঝে’র ‘আপাত-সাধারণ’ সুরের কালজয়ী হয়ে ওঠা। নেশাবস্তু না-ছোঁয়া কণ্ঠে ধারণ করা তাঁর মদ্যপের গানকে ঈর্ষা করে খোদ নেশাপাত্র।
রাগাশ্রয় গানকে পরাধীন করে বলে অনেকের মত। অযৌক্তিক। প্রেমে অন্তর্লীন পরাধীন-স্বাধীনতার মতোই গানের রাগাশ্রয় বন্ধনহীন গ্রন্থিও দেয়। রফি সে সত্যের অবতার-প্রতিমা। তাই ইমনের উঠোনে দোঁহার রেণু মেখে ছড়িয়ে রোশনের সুরে রফির ‘মন রে, তু কাহে না ধীর ধরে’র স্বাধীন শান্তিকল্যাণ। তাই জয়দেবের সুরে ‘আভি না যাও ছোড় কর’ কল্যাণ-প্রত্নলিপি ভালবাসার সিন্ধুসভ্যতার। তবে শুধু ক্লাসিক্যাল-পারদর্শিতাতেই রফি হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। তা হলে নিশ্চিত মিলত দ্বিতীয় কোনও রফিও।
সেই কবিতায় ওয়ার্ডসওয়ার্থ জানিয়েছিলেন— মেয়েটি ‘সিংগিং বাই হারসেল্ফ’। ‘শি সিংগস’ না বলে ‘সিংগিং বাই হারসেল্ফ’ কেন? কোনও মৌল সাধনা? একমেবাদ্বিতীয়ম্-এর আন্দাজ?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy