‘ব্রিক্স’ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির নেতৃবৃন্দ। —ফাইল চিত্র।
কোনও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ‘ডাকনাম’ দেওয়ার বিষয়টি সত্যিই বেশ গোলমেলে। এ নিয়ে ভাবতে গেলে প্রথমেই যে নামটি মনে আসে, সেটি হল ‘ব্রিক্স’।বিশ্বের অন্যতম অগ্রণী বিনিয়োগীব্যাঙ্কিং ম্যানেজমেন্ট সংস্থা ‘গোল্ডম্যান স্যাক্স’-এর অর্থনীতিবিদেরা একুশ শতকে পা রাখার সময়ে এই বিশেষ নামটি দিয়েছিলেন ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া এবং চায়না— এই দেশগুলির নামের আদ্যক্ষরগুলি একত্র করে। তাঁদের ধারণা ছিল একুশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এই দেশগুলির অর্থনীতি একত্রে ‘জি-৬’ নামে পরিচিত (সত্তরের দশকে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মানি, জাপান এবং ইটালি একত্রে ‘গ্রুপ অফ সিক্স’ বা সংক্ষেপে ‘জি-৬’ নামে উন্নততর শিল্প-অর্থনীতির একটি গোষ্ঠী গঠন করে)উন্নত অর্থনীতির গোষ্ঠীকে অতিক্রম করে যাবে।
প্রায় এক দশক সেই ধারণা বলবৎ থাকলেও তার পরে তা ভেঙে যায়। চিন (২০০১ সালে বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহৎ অর্থনীতি) এবং ভারত (তখনও পর্যন্ত প্রথম ১০-এ ছিল না) এগিয়ে আসতে শুরু করে। এবং তারা দু’জনেইএখন বিশ্বের প্রথম পাঁচটি অর্থনীতির মধ্যে রয়েছে। কিন্তু ব্রাজিল ও রাশিয়া সেই আশা পূরণ করতে পারেনি। বিশ্বের প্রথম ১০টি বৃহৎ অর্থনীতির মধ্যে রাশিয়ার তেমন কোনও ভবিষ্যৎ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। অন্য তিনটি দেশের তুলনায় মাথাপিছু আয়ের নিরিখে ভারতও খানিকটা দূরে সরে রয়েছে বলেই মনে হয়।
তেমন তলিয়ে না দেখলেওআরও কিছু সাধারণ বিষয় নজরে আসে। ২০০১-এ বিশ্বের সব থেকে জনবহুল ছ’টি রাষ্ট্রের মধ্যে থেকে চারটিকে বেছে নেওয়া হয় ‘ব্রিক্স’-এ। বিশ্বের সবথেকে বড় আয়তনের সাতটি দেশের মধ্যেও তারা রয়েছে। সে দিক থেকে দেখলে ভূগোল এবং জনসংখ্যার নিরিখে তাদের এক পঙ্ক্তিতে বসানোর বিষয়টি যুক্তিযুক্ত। কিন্তু পাকিস্তান এবং নাইজেরিয়া জনসংখ্যার দিক থেকে রাশিয়া এবং ব্রাজিলকে অতিক্রম করে যায়। ইতিমধ্যেদক্ষিণ আফ্রিকা (কার্যত ভারতীয় অর্থনীতির এক দশমাংশের দেশ)-কে পঞ্চম সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করলেগোষ্ঠীর পিছনে কাজ করার অর্থনৈতিক যুক্তি অবান্তর হয়ে পড়ে।
কিন্তু এমন একটা গোষ্ঠীনামকে সহজে বিলুপ্ত হতে দেওয়া যায় না। ফলে নিয়মিত ‘ব্রিক্স’ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে শুরু করে। সেই সব বৈঠকে অবশ্যই আলোচ্যের অভাব ছিল না। কিন্তু সেই অলোচ্যগুলি ছিল একের পর এক অবাস্তব ব্যাপার নিয়ে। আলোচনা হয়েছিল বহু বিষয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘ব্রিক্স ব্যাঙ্ক’ই এক মাত্র বাস্তবায়িত হয়। অবশ্য ভেনেজুয়েলার মতো ‘ব্রিক্স’-বহির্ভূত কিছু রাষ্ট্রকে এর সদস্য করার পর আর আন্তর্জাতিক উন্নয়নের জন্য গঠিত অন্যান্য আর্থিক সংস্থার সঙ্গে ‘ব্রিক্স ব্যাঙ্ক’-এর বিশেষ পার্থক্য রইল না।
আমেরিকার হাত থেকে তথ্য সুরক্ষিত রাখতে সমুদ্রের তলা দিয়ে ‘ব্রিক্স কেব্ল’ পাতার একটি পরিকল্পনা প্রায় এক দশক আগে করা হয়েছিল। কিন্তু তার বাস্তব রূপদানের কাজটি অত্যন্ত ধীরগতিতে এগোতে লাগল। অন্য দিক থেকে দেখলে, তথ্য হাতানোর ব্যাপারে চিনও যথেষ্ট পারঙ্গম। সেই দিক থেকে ভাবলেবিষয়টির গোড়াতেই গলদ হয়েছিল বলে মনে হতে পারে। আমেরিকান ডলারের বিপরীতে নতুন মুদ্রাব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়েও আলোচনা হয় ‘ব্রিক্স’ সম্মেলনে। কিন্তুসে ক্ষেত্রে আবার ভারত তেমন আগ্রহ দেখায়নি। কারণ, চিনের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সেই মুদ্রাব্যবস্থার ঘনিষ্ঠ যোগ তার পক্ষে মঙ্গলজনক বলে মনে হয়নি। ডলার অর্থনীতির খপ্পর থেকে বেরিয়ে এসে চিনা ইউয়ানের পাল্লায় পড়ার বিষয়টি সুখকর ছিল না।
ইতিমধ্যে, ‘ব্রিক্স’ গঠনের পিছনে যে মূল ভাবনাটি কাজ করেছিল, অর্থাৎ বিশ্বব্যবস্থায় পশ্চিমী প্রাধান্যের একটি পাল্টা জবাব তৈরির বিষয়, সেটি প্রাসঙ্গিকতা হারাতে থাকে। কারণ, ‘ব্রিক্স’-এর অন্তর্নিহিত যুক্তিকাঠামোই ভেঙে পড়ে। কমবেশি ৪০টি উন্নয়শীল দেশ এতে যোগ দিতে আগ্রহ দেখায়। কিন্তুএই ভাবনা দিয়ে প্রধানতম উন্নয়নশীল দেশগুলি নিয়ে গঠিত জি-১৫ গোষ্ঠীর অনুবর্তী কিছু তৈরি করাও দুরূহ ছিল। একই উদ্দেশ্য নিয়ে জি-১৫ প্রায় ২৫ বছর কোনও মতে টিকে থেকে এক দশক আগে অস্তিত্ব হারায়। ‘ব্রিক্স’-এর পক্ষে জি-১৫-র শূন্যস্থান পূর্ণ করার ব্যাপারে যথেষ্ট সমস্যা ছিল। কারণ, চিন বা রাশিয়া, কেউই সে অর্থে ‘উন্নয়নশীল’ দেশ নয়। যে জায়গায় তাদের মিল, তা হল পশ্চিম-বিরোধিতা।
সে অর্থে দেখতে গেলে ‘ব্রিক্স’-এর পক্ষে চিনা কূটনীতির দ্বারা চালিত এক সংগঠনে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। চিনের সংলগ্ন এলাকায় মিত্র দেশ বলতে উত্তর কোরিয়া, কম্বোডিয়া এবং সম্ভবত মায়ানমার। সুতরাং বৃহত্তর কূটনৈতিক সমর্থনের ভিত্তি গড়ে তোলার তাগিদ বেজিংয়ের তরফে ছিলই। অনুমান করা যায়, বেজিংই ‘ব্রিক্স’-এর সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়ে চাপ দিচ্ছিল। রাশিয়ার সঙ্গে নতুন করে বন্ধুত্ব শুরু হলেআফ্রিকায় কূটনৈতিক সম্পর্কের সন্ধান এবং সাম্প্রতিক কালে উপসাগরীয় অঞ্চলে তার জমি শক্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে চিন ‘ব্রিক্স’-কে আয়তনে বাড়িয়ে পশ্চিমী আধিপত্যের অবসান ঘটাতে চেয়েছিল। সত্যিই ‘ব্রিক্স’ সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের মতো আর একটি চিনা-প্রাধান্য যুক্ত গোষ্ঠীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরুও করেছিল।
ভারতের দিক থেকে দেখলে চিনের সঙ্গে সুসম্পর্কের অভাবের কারণে এ ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিত। বিশেষ করে চিন থেকে পণ্য আমদানি এবং বিনিয়োগ আনার ক্ষেত্রে যখন ভারত নিষেধাজ্ঞা জারি করল এবং ভারতীয় বাজারের দরজা চিনা প্রযুক্তির কাছে বন্ধ করা হল, তখন সমস্যাবেশ স্পষ্ট হয়ে দেখা দিতে পারত। সেই সঙ্গেউন্নয়নবিষয়ক বেশ কিছু ক্ষেত্রে (জলবায়ুগত পরিবর্তন সমেত) ভারতের সঙ্গে পশ্চিমের উন্নত দেশগুলির মতপার্থক্য অনিবার্য। সামরিক সরঞ্জাম, প্রযুক্তি এবং মানবসম্পদের সঞ্চালনের মতো বিষয়ে ভারতের সঙ্গে আবার ইউরোপ এবং আমেরিকার মিত্রতার প্রয়োজন ছিল। চিন বা রাশিয়ার তুলনায় ভারত অনেকটাই মুক্ত রাজনৈতিক আবহাওয়ার দেশ। তা সত্ত্বেও যে হেতু ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতো রাষ্ট্র ‘ব্রিক্স’-এর সদস্য হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠল, তখন সংঘাতে না গিয়ে তাদের আটকানো ভারতের পক্ষে কষ্টকর বলেই মনে হয়েছিল। সে দিক থেকে ভারত নতুন সদস্য গ্রহণের ব্যাপারে সুস্পষ্ট মাপকাঠি জানানোর ব্যাপারে দাবি করে। কিন্তু এই প্রশ্ন থেকেই যায় যে, ইতিমধ্যেই ‘ব্রিক্স’-এর সদস্য হয়ে থাকা দেশগুলি কি সত্যিই কোনও অর্থবাহী মাপকাঠি বহন করে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy