প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।
যে সব বিরোধী দল ‘ইন্ডিয়া’ (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স) নামধারী এক ছাতার তলায় এসেছে, তারা আগামী সপ্তাহে তৃতীয় বার মিলিত হতে চলেছে। এখন যদি তারা সাবধানে পা না ফেলে, তা হলে ১৯৭১ সালে যে ভুলটি হয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। সেই সময়েও বিরোধী জোট এক প্রবলপ্রতাপ প্রধানমন্ত্রীকে গদিচ্যুত করার ব্যাপারে সচেষ্ট হয়। স্লোগান ওঠে— ইন্দিরা হটাও।
তখন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ‘গরিবি হটাও’ স্লোগান তুলে আলোড়ন ফেলেছিলেন। বিরোধীদের স্লোগান ছিল তারই বিপরীতে সমধর্মী একটি স্লোগান। কিন্তু সেই দ্বৈরথে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাই জয়ী হন। সেই জয়ের পিছনে ঠিক কী কাজ করেছিল, তা বোঝা খুব দুরূহ নয়।
এখন বিরোধী দলগুলি একত্র হয়ে আওয়াজ তুলছে— মোদী হটাও। যার বিপরীতে নরেন্দ্র মোদী বলছেন এক ‘অমৃতকাল’-এর কথা। যার সঙ্গে সে দিনের ‘গরিবি হটাও’-এর উচ্চাশার তুলনা টানা যেতে পারে। ‘ইন্ডিয়া’ একেবারেই প্রাথমিক দশায় রয়েছে। কিন্তু (লক্ষণীয়, ‘ইন্ডিয়া’ নামকরণটির পিছনে যথেষ্ট বিভ্রান্তির সম্ভাবনা রয়েছে। সঙ্গে রয়েছে বেশ খানিকটা বাগাড়ম্বরও) বিরোধীরা এ বার কিছু বিশেষ পন্থা একত্র করেই পথে নেমেছেন বলে মনে হয়। পরের ধাপে তাঁরা নিশ্চয়ই স্পষ্ট করবেন, ঠিক কেন ভোটদাতারা মোদীকে হটানোর পিছনে তাঁদের যুক্তিতে কান দেবেন। বিরোধীরা এ-ও স্পষ্ট করবেন যে, এই নতুন জোট কী হিসাবে মোদী সরকারের চেয়ে উন্নততর কিছু দেওয়ার দাবি করছে।
কেউ কেউ মনে করতেই পারেন, ‘ইন্ডিয়া’ ২০১৯-এর নির্বাচনে কংগ্রেসি প্রচারের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে না। সে বার রাহুল গান্ধী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত দুর্নীতির ওজর তুলেছিলেন, যা ভোটের বাজারে তেমন সুবিধা করতে পারেনি। সেই সঙ্গে এ-ও সত্য যে, এ বার নেতিবাচক ভোটের আশা করেও কোনও লাভ হবে না (১৯৭৭ সালে এবং কিছুটা হলেও ২০১৪-এর নির্বাচনে যা ঘটেছিল)। কারণ, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা গগনচুম্বী। সেই সঙ্গে এ-ও স্বীকার করতে হবে যে, বহু মানুষ মোদীর তীব্র সমালোচকও। অনেকেই তাঁকে সেই সব প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে দেওয়ার জন্য দায়ী করেন, যেগুলি হয়তো আরও শক্তিশালী, আরও দায়িত্ববোধ সম্পন্ন এক প্রশাসন তৈরি করতে পারত। কিন্তু এই জাতীয় কারণের ভিত্তিতে মোদী বা তাঁর দলকে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন, এমন মানুষের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে নগণ্য। তার মধ্যে এমন অনেক মানুষ রয়েছেন, যাঁরা জানেন, বিরোধীরা (কংগ্রেস-সহ) মসনদে বসলে ক্ষমতার অপব্যবহার কিছু কম হবে না। যদি বিরোধীরা জয়ের আশা নিয়ে এগোতে চান, তা হলে নতুন জোটকে বর্তমান সরকারের সমালোচনার চেয়ে বেশি কিছু তুলে ধরতে হবে। এমন কিছু তুলে ধরতে হবে, যা ‘পরিবর্ত’ হিসাবে দৃশ্যতই উন্নততর।
সেই উন্নততর পরিবর্ত তুলে ধরার কাজটি মোটেই সহজ নয়। প্রথমেই যা নজরে আসে, সেটি হল, বিরোধীরা নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর মতো কোনও নেতার সন্ধান এখনও দিতে পারেননি। বিজেপি যে রাজ্য স্তরের নির্বাচনগুলির তুলনায় জাতীয় স্তরে ক্রমাগত সাফল্যের মুখ দেখেছে, তার পিছনে অন্যতম কারণ মোদীর মতো নেতার উপস্থিতি। পাশাপাশি, জনগণের মধ্যে আলোড়ন তোলার জন্য যে পরিমাণ রসদের প্রয়োজন, তা-ও বিরোধীদের নেই। ফলে, শাসকদলের তুলনায় তাদের নির্বাচনী প্রচারের ব্যবস্থাপনা দুর্বল হবে বলে ধরে নেওয়া যায়। অবশ্য এ কথা ইতিপূর্বে বহু বার প্রমাণিত হয়েছে যে, ভোটদাতার মর্জি ভিন্ন দিকে ঘুরে গেলে টাকা দিয়ে তা ফেরানো যায় না। কিন্তু প্রশ্ন এখানেই। কেন ভোটদাতার মর্জি বিপরীত দিকে ঘুরে যাবে? উত্তরে বলা যায়, মুদ্রাস্ফীতি আর বেকারত্বের সমস্যাকে যথাযথ ভাবে তুলে ধরতে পারলে তা সম্ভব।
এই দুই সমস্যার বিপরীতে মোদী যা যা বলতে পারেন, সেই সবই তাঁর দলের মূল আলোচ্যের অন্তর্গত। অযোধ্যায় মন্দির নির্মাণ, জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার অবসান এবং অবশেষে সংখ্যালঘু তোষণের বিরোধিতা বলে তাঁদের ভোটাররা যা মনে করেন। মোদী তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে প্রকৃত তথ্য এবং অতিরঞ্জনের মিশেলে বক্তব্যকে খানিক ঘুরিয়েও পেশ করতে পারেন। যেখানে জগৎসভায় ভারতের মর্যাদাবৃদ্ধিকে আরও বড় করে দেখানো হবে (যদিও বিশ্ব জুড়ে ভারতে ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয়ে নেতিবাচক সমালোচনাই চলছে)। তার সঙ্গে মোদী জুড়ে দিতে পারেন জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টিও (সে ক্ষেত্রে আপাতত চিনকে ভুলে যেতে হবে)। পাশাপাশি, উঁচু গলায় বলে যেতে হবে, ভারত অচিরেই বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠতে চলেছে।
তার পাশাপাশি মোদী বিভিন্ন স্তরে গৃহীত ‘ডিজ়িটাইজেশন’ বিষয়ক পদক্ষেপগুলির কথাও বলতে পারেন। সেই সঙ্গে জুড়তে পারে জনকল্যাণমুখী কাজকর্মের খতিয়ানও। যার মধ্যে দেশের বাহ্যিক পরিকাঠামোগত ‘প্রগতি’র ছবি জোরালো ভাবে তুলে ধরা হবে। বলা হবে দ্রুত গতির আন্তঃশহর ট্রেন চালু করার মতো বিষয়। নোটবন্দি বা ২০২০-র কোভিড অতিমারীর সময়কার ভয়াবহ স্মৃতি ক্রমেই ফিকে হয়ে এসেছে। ফলে বহু ভোটারই এ সব বাণীতে ভুলে গিয়ে তৃতীয় বার মোদী সরকার গড়ার উদ্দেশ্যে ইভিএম যন্ত্রের বোতাম টিপতে পারেন।
তবে বিরোধী জোটের দিক থেকে দেখলে এখনই এত কিছু ভেবে রাখার সময় আসেনি। সবে জোট গঠন হয়েছে। আগামী সময়ে বিরোধী জোট এমন কিছু পরিকল্পনা বিশদে তুলে ধরতে পারে, যা তাদের নির্বাচনী প্রচারের পালে ইতিবাচক বাতাস নিয়ে আসবে। নির্বাচনী প্রচারের অঙ্গীকারে তারা এমন কিছু জিনিসপত্র বা সুবিধা বিনামূল্যে দেওয়ার কথা বলতে পারে, যা ভোটব্যাঙ্ককে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে।
সম্প্রতি কর্ণাটকের নির্বাচনে কংগ্রেস এমন কৌশলই নিয়েছিল। আম আদমি পার্টির তরফেও একই ধরনের উদ্যোগ দেখা গিয়েছে। বিরোধী জোট সেই সব মানুষের কথা তুলে ধরতে পারে, যাঁরা ইংরেজি বর্ণমালার ‘কে’ অক্ষরটির আকৃতির অর্থনৈতিক প্রগতিতে পিছিয়ে-পড়া বর্গ হিসেবে গণ্য হচ্ছেন (আর্থিক প্রগতির বিশেষ একটি পরিস্থিতি, যেখানে অর্থনীতির একটি অংশের উত্থান ঘটে আর বাকি অংশের অধোগামিতা অব্যাহত থাকে)। ২০০৪ সালে বাজপেয়ী সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারের সময়ে এই বক্তব্য বিশেষ ভাবে ফল দিয়েছিল। কিন্তু এক কল্যাণকামী তথা গণমুখী মঞ্চ ব্যবহার করে বিরোধী জোটের বাজারভিত্তিক অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি থেকে দূরে সরে যাওয়ার সম্ভাবনাও থেকে যাচ্ছে। আসল ঝুঁকির জায়গাটি হল, একটি জোটের প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটকে অন্ততপক্ষে সেই জোটের অন্য অংশের ভোটের সংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। নইলে বিরোধীদের উদ্দেশ্যপূরণ সহজ হবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy