প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।
আমেরিকান সংস্থা ‘পিউ রিসার্চ’-এর একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে, বড়জোর ডজন দুয়েক দেশ বর্তমানে ভারত সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। কিন্তু আগে সংখ্যাটা এত কম ছিল না। নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তা তাঁর নিজের দেশে যেমন অপ্রত্যাশিত বেশি, বিশ্বের অন্যত্র সেই জনগ্রাহ্যতার মাত্রা তার অর্ধেকও নয়। পিউ-সমীক্ষা আরও জানাচ্ছে, আলোচ্য দেশগুলিতে সাম্প্রতিক কালে ভারতের প্রভাব-প্রতিপত্তি কিছুমাত্র বাড়েনি। দেশের ভিতরে কিন্তু ছবিটা একেবারেই আলাদা।
ভারতের বিষয়ে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক স্তরের অভিমতের মধ্যে এই ফারাক অভাবনীয় নয়। এই সমীক্ষায় উঠে আসা পরিসংখ্যানও তেমন আকস্মিক নয়। কিন্তু সমীক্ষা থেকে পাওয়া কিছু তথ্য মোদী সরকারের নিরন্তর ‘সাফল্যে’ বিশ্বাসী নন, এমন মানুষদের কাছে বিস্ময়কর বলে মনে হতে পারে।
বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পরেও ভারত সম্পর্কে বিশ্বের বাকি অংশের ধারণা তেমন ইতিবাচক ছিল না। চন্দ্রভিযান সফল হওয়ার পরেও যে দেশের গৌরব সীমানা ছাড়িয়ে আরও বিস্তৃত হয়েছে, এমনও নয়। কোভিডের টিকা সরবরাহের মতো ইতিবাচকই হোক অথবা চাল রফতানি নিষিদ্ধকরণের মতো নেতিবাচক পদক্ষেপ— আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের কর্মকাণ্ড বিশ্বের অন্যত্র তেমন কোনও প্রভাব ফেলে না। অতীতেও অবশ্য অবস্থা এমনই ছিল। অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বের অন্যতম দ্রুত গতিছন্দের অর্থনীতির এবং বিশ্ব অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে তৃতীয় বৃহত্তম অংশগ্রহণকারী দেশটিকে যে ধর্তব্যের মধ্যে আনা হবে, এমন কোনও নিশ্চয়তাও নেই। অথচ ভিন্দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতীয়দের সাফল্য নিয়ে কেউ কোনও প্রশ্ন তুলতে পারবেন না। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে ভারতীয়দের সংখ্যা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি নিয়েও সন্দেহের অবকাশ নেই। ভিন্ন সমাজে গিয়ে তার সঙ্গে সংহতি স্থাপনের বিষয়ে ভারতীয়দের দক্ষতাও সর্বজনবিদিত। এ সমস্ত কিছু থেকেই বিশ্বসভায় ভারত সম্পর্কে এক উচ্চ ধারণা গড়ে ওঠার অবকাশ ছিল।
কিন্তু ভারত সরকারের আত্মপ্রচারের কৌশল এবং দেশের মন্ত্রীদের অত্যুৎসাহ বিড়ম্বনা তৈরি করে চলেছে। যতই হোক, বিভিন্ন আশাব্যঞ্জক প্রতিশ্রুতির পরেও মুক্তবাণিজ্য সংক্রান্ত চুক্তিগুলির ব্যাপারে ভারতের তরফে সবিশেষ কিছুই দেখানোর নেই। যাঁরা বাণিজ্য বিষয়ক সংবাদমাধ্যমগুলির সঙ্গে নিয়মিত ভাবে পরিচিত নন (এমন লোকের সংখ্যাই বেশি), তাঁরা এ কথা শুনে আশ্চর্য হতে পারেন যে, গত বছর এবং চলতি বছরে এ দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের মাত্রা লক্ষণীয় ভাবে কমেছে। সেই সঙ্গে বিদেশি পোর্টফোলিয়ো (শেয়ার, বন্ড, ফান্ড এবং নগদ হিসেবে যে কোনও আর্থিক সম্পদের সমন্বয় ) বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ২০২২ সালে কিছুটা জোয়ার দেখা গেলেও ২০২৩-এ তাতে ভাটার টান।
পিউ সমীক্ষা অনুযায়ী দেশের অভ্যন্তরে যাঁর জনপ্রিয়তা ফুলেফেঁপে উঠেছে, সেই নরেন্দ্র মোদীর ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন দেশের সরকার উপায়ান্তর না দেখেই ভারতের সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য হচ্ছে। মোদী প্রায় সব সময়েই তাঁদের শুনিয়ে যাচ্ছেন, উজ্জ্বল দিন সমাগত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ ভারতের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের গতিপ্রকৃতির সঙ্গে অপরিচিত নন। কিন্তু তাতে ভারত সম্পর্কে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির তেমন বদল ঘটছে বলে মনে হয় না।
এর পরে বাকি থাকে চিন। ক্ষমতার খেলা সর্বদাই আপেক্ষিক হওয়ায় ভারতের উত্থানকে সব সময়েই ঢেকে দেয় চিনের অগ্রগতি। এমনকি, ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলিও চিনের সঙ্গে দৃঢ়তর বাণিজ্যিক সম্পর্কে আবদ্ধ। সামরিক সরঞ্জাম সংক্রান্ত চুক্তির ক্ষেত্রেও তারা ভারতের চেয়ে চিনকে বেশি গুরুত্ব দেয়। এ বিষয়ে সন্দেহের তেমন অবকাশই থাকতে পারে না যে, বেজিং থেকেই ‘ব্রিক্স’ (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চিন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা নিয়ে গঠিত অর্থনৈতিক জোট)-এর সদস্য বাড়ানোর ব্যাপারে সব থেকে বেশি কলকাঠি নাড়া হয়। প্রকারান্তরে চিনই ‘ব্রিক্স’কে অতিরিক্ত মাত্রায় পশ্চিম-বিরোধী মঞ্চের রূপ দিচ্ছে আর ভারত তা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে।
দ্বিপাক্ষিক চুক্তিগুলির ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, বেজিং তার কর্তৃত্ব একচুলও ছাড়তে রাজি নয়। বিতর্কিত সীমান্ত সংক্রান্ত ব্যাপারে অসামরিক বা সামরিক পরিকাঠামো তৈরি, ভৌগোলিক আগ্রাসন, গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে ভারতের প্রবেশ রুখে দেওয়ার বিষয়ে চিন সর্বদা সচেষ্ট। যদি শি জিনপিং নয়াদিল্লির জি২০ সম্মেলন থেকে দূরে থাকেন, তবে ভ্লাদিমির পুতিনও সেখানে আসবেন না। সুতরাং, ভারত অথবা নিদেনপক্ষে নিজের ভাবমূর্তি বাড়ানোর ব্যাপারে মোদী মোটেই তেমন অনুকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতি পাবেন না। আসলে চিন জি২০-র প্রাধান্যকে কমিয়ে ‘ব্রিক্স’-কেই তুলে ধরতে চায়।
সুতরাং, আন্দাজমাফিক এ কথা বলাই যায়, যে বিশ্বে আমরা বাস করছি, সেখানে দু’টি অতিশক্তিশালী, রাশিয়ার মতো দুই থেকে তিনটি মহাশক্তিধর এবং তার পিছনে কিছু মাঝারি শক্তির রাষ্ট্র রয়েছে। যার মধ্যে তৃতীয় সারিতে থেকে ভারত তার অস্তিত্ব কিছুমাত্রায় জাহির করতে পেরেছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যত উন্নতিই করুক না কেন, রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে ‘ভেটো’ দেওয়ার ক্ষমতা না থাকায় ভারত কখনই ‘মহাশক্তিধর’ রাষ্ট্রে পরিণত হবে না। শিল্পোৎপাদনে বিপুল অগ্রগতি, প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নতি, দৃঢ় ভাবে গড়ে তোলা প্রতিরক্ষা শিল্প, মানবিক উন্নতির সূচকগুলিকে ক্রমাগত পূর্ণ করে যাওয়া ইত্যাদি সত্ত্বেও ভারতের পরিচয় এক বণিক রাষ্ট্র, যার অন্তর্নিহিত সংহতি যথেষ্ট— এতেই আটকে থাকবে। এক কথায়, ভারত এমন একটি দেশ হিসেবে সর্বদা পরিগণিত হবে, যেখানে উন্নয়নের কাজ সব সময়েই বহমান। ‘উন্নত’ হয়ে ওঠা আর তার পক্ষে হয়ে ওঠে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy