শান্তি পাচ্ছেন না সাবিনা বিবি। সংশোধিত ওয়াকফ আইন তাঁর অশান্তির কারণ। লক্ষ্মীর ভান্ডার পেয়ে উপকৃত। সংসার চালানোয় সে টাকার গুরুত্ব মেনেও বাঁকুড়ার ইন্দাসের সাবিনা বলছেন, “ধর্ম নিয়ে আপসের প্রশ্ন নেই। আপত্তি অশান্তিতেও।” তাঁর বক্তব্য মিলে যায় বীরভূমের রামপুরহাট মহকুমা এলাকার সালমা বিবি, রুনা বিবিদের কথার সঙ্গে। তাঁরা বলছেন, “লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকায় সুবিধা হয়। তবে না দিলেও সংসার চলত। এখন ভাবছি, ধর্মে আঘাত এসেছে। অশান্তি হচ্ছে। অশান্তি রোখার দাবিতে প্রয়োজনে পথে নামতে পারি।”
ওয়াকফ-অশান্তির জেরে মুর্শিদাবাদ তেতে ওঠার পরে, গত ১৬ এপ্রিল সারা রাজ্য জুড়ে বিজেপি ‘হিন্দু শহিদ দিবস’ পালন করেছে। ডাক দেওয়া হয়েছে ‘ভাত নয়, জাতের লড়াইয়ের’। তাই কি এই মনোভাব? ডোমকলের মমতাজ বিবি বলছেন, “সংশোধিত ওয়াকফ আইনের মাধ্যমে মুসলিমদের সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করতে চাইছে সরকার। তাতে অশান্তি বাড়ছে। প্রতিবাদ সে কারণে।” তাঁর মতো পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম, খেজুরি, কাঁথি-৩, ভগবানপুর-২ ব্লকের ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এর প্রাপক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মহিলাদের দাবি, তাঁদের ধর্মাচরণ এবং সামাজিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে। তাঁরা বলছেন, কোনও ভাবে যাতে কেউ কারও ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করতে না পারে, দেখতে হবে তা।
ওয়াকফ পরবর্তী পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো নিয়ে চিন্তায় শহর শিলিগুড়ির মুসলিম মহিলারা। তাঁদেরই এক জনের কথায়, “মুর্শিদাবাদ, মালদহ, এমনকি শিলিগুড়িতেও উস্কানি দেওয়া হচ্ছে। যা ঘটছে, তা মোটেই ভাল নয়।” হুগলির পান্ডুয়ার আমিনা খাতুনের মতো নানা জেলার সংখ্যালঘু মহিলারা আবার বলেছেন, “সংশোধিত ওয়াকফ আইনটি ভাল করে জানি না। ইমামেরা ভাল বলতে পারবেন। ব্যক্তিগত ভাবে চাই, শান্তি থাক।”
তবে উত্তর দিনাজপুরের প্রত্যন্ত এলাকার সংখ্যালঘুদের বড় অংশ জাতভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে বিরক্ত। সে জেলার চাকুলিয়া, গোয়ালপোখর, করণদিঘি, ইটাহারের প্রত্যন্ত এলাকার সংখ্যালঘু মহিলাদের মধ্যে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ নিয়ে আগের মতো উচ্ছ্বাস নেই। তাঁদের দাবি, যে হারে রান্নার গ্যাস-সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ছে, তাতে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এর টাকায় খুব বেশি উপকার হচ্ছে না।
পক্ষান্তরে, ভোটের জন্য ‘সংখ্যালঘু তোষণ’ সরকারের কাজ হতে পারে না বলে মনে করছেন ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্পের বাঁকুড়ার একাধিক প্রাপক। মুর্শিদাবাদের সাম্প্রতিক হিংসায় উদ্বিগ্ন বাঁকুড়ার শুভ্রা মণ্ডলের বক্তব্য, “সবার আগে নিরাপত্তা।” মনে পড়ায় শমসেরগঞ্জের বাসিন্দা রিমা দাসকে, যিনি এলাকা পরিদর্শনে আসা জাতীয় মহিলা কমিশনের সদস্যদের বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লক্ষ্মীর ভান্ডার দিয়ে মহিলাদের উন্নয়নের দাবি করেন। অথচ, শমসেরগঞ্জে দু’জনকে খুন করার খবর পেয়েও পুলিশ আসেনি। আমরা লক্ষ্মীর ভান্ডার চাই না, চাই নিরাপত্তা।” মেদিনীপুর সদর ব্লকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মহিলার কথায়, “যেখানে বাড়ির লক্ষ্মীরা সুরক্ষিত নয়, সেখানে লক্ষ্মীর ভান্ডার দিয়ে কী লাভ?”
অনেকে ভাবছেন ‘বহিরাগত’দের নিয়ে। বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া জেলাগুলিতে এই ভাবনার শরিক অনেকেই। মুর্শিদাবাদের ডোমকলের সাগরপাড়ার এক শিক্ষিকা বলেন, “ভিন্দেশিরা এলাকায় ঢুকলেও বুঝতে পারব না। বাংলাদেশের লোকেদের সঙ্গে আমাদের এলাকার মানুষের চেহারা, ভাষা, পোশাকের ফারাক নেই। কে বহিরাগত, বোঝা মুশকিল। চিন্তারও কারণ।”
তবে সীমান্তের জেলা কোচবিহার থেকে শুরু করে দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রত্যন্ত এলাকায় বার বার শোনা গিয়েছে, হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গে থাকতে অসুবিধে কোথায়? এত কাল তো পাশাপাশিই থেকেছেন সকলে। সেখানে ভাতের আগে জাত নয়। ভাতের জন্য হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে এক নৌকায় সাত-দশ দিনের জন্য কাঁকড়া ধরতে বেরিয়ে পড়েন, দুই ২৪ পরগনায় এটাই স্বাভাবিক। কাকদ্বীপ অক্ষয়নগরের বাসিন্দা মঞ্জু দাস বলেন, “জাতপাত নিয়ে অত ভাবি না। দু’বেলা দু’মুঠো খাবার কী ভাবে জোগাড় হবে, তা-ই ভাবি।”
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘লাইফ লং স্টাডিজ়’ বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান মনতোষ বসু বলেন, “সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যদি না থাকে, তা হলে মানুষ তাঁদের মৌলিক চাহিদা পূরণের লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে পারবেন না। শাসক পক্ষ সব সময় চাইবে, বিভেদ রচনা করতে। কিন্তু একটা সময় মানুষের মধ্যে চেতনা জাগে। তাঁরা নিজেদের প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধ হন।” বহরমপুরের বাসিন্দা মণিদীপা দাসের কথায়, “ব্লাড ব্যাঙ্কের রক্ত নেওয়ার সময়ে ভাবি না কোন জাতের রক্ত। স্কুলে পড়ানোর সময় শিক্ষক-শিক্ষিকারা ভাবেন না পড়ুয়ারা কে, কোন জাতের। রাম-রহিমের মিড-ডে মিল এক থালায় বসে খাওয়ার নজির রয়েছে এ রাজ্যে। জাত নয়, ভাত বড়।”
(শেষ)
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)