Advertisement
১৭ অক্টোবর ২০২৪
‘রূপে লক্ষ্মী’ না হলে কি তাঁর দেবত্ব নিয়েও সংশয় তৈরি হত?
Lakshmi Puja

কোথায় তারে দিবি রে ঠাঁই

রূপবর্ণনার পিছনেই থাকে ‘লুক শেমিং’; ছায়ার মতো। রূপের মতো যে বাহ্যিক, সাময়িক বিষয়ে আমার হাত নেই, তার আঘাতও যে আমার নেওয়ার দায় থাকে না, সে কথা বলবে কে?

প্রহেলী ধর চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০২৪ ০৭:২৯
Share: Save:

লক্ষ্মী আসেন। অলক্ষ্মীও। তাঁর আসার খবর কেউ রাখে না। তবু অলক্ষ্মীই আসেন আগে। সৃষ্টির শুরু থেকেই। দেবাসুরের সমুদ্রমন্থনে প্রথমে আবির্ভূত হন অলক্ষ্মী, পরে লক্ষ্মী। অলক্ষ্মী তাই জ্যেষ্ঠা, লক্ষ্মী কনিষ্ঠা।

লক্ষ্মী, অলক্ষী দুই-বোন হলেও নামভূমিকাতেই তাঁরা বিপরীত। বিপরীত রূপে, গুণে, লোকায়তে, জনপ্রিয়তায়। মানবকুলের মতো দেবসমাজেও যে-হেতু লিঙ্গবৈষম্য প্রবল, তাই মর্তলোকের সাধারণ মহিলাদের মতোই দেবলোকের মহিলা-দেবতারাও সোনার আংটিটি নন— বাঁকা হলে বিশেষ যায়-আসে। মর্তের ‘প্রকৃত সুন্দরী পাত্রী চাই’ শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপনের মতোই, দেবীকৌলীন্য বিচারেরও প্রথম সূচক দেবীর রূপ। গুণ পরে। কথার প্রথমে তাই ‘রূপে লক্ষ্মী’, পরে ‘গুণে সরস্বতী’। ঘরে ঘরে প্রথমেই ‘আহা, লক্ষ্মী-প্রতিমার মতো চেহারা’, পরে গুণের কথা আসে না। গুণ, থাকলে ভাল, না-থাকলেও বিশেষ আটকাবে না; মর্তে মেয়ের বিয়ে পণ্ড হবে না, স্বর্গে দেবী হওয়া ঠেকবে না। ত্রিলোক জুড়েই মেয়েদের ক্ষেত্রে ‘লুক ম্যাটারস’।

রূপবর্ণনার পিছনেই থাকে ‘লুক শেমিং’; ছায়ার মতো। রূপের মতো যে বাহ্যিক, সাময়িক বিষয়ে আমার হাত নেই, তার আঘাতও যে আমার নেওয়ার দায় থাকে না, সে কথা বলবে কে? সে কথা স্বয়ং দেবীও বলেননি মর্তের নশ্বর মানুষকে। তাই চাঁদ সওদাগর দেবী মনসার পুজো দিতে অস্বীকার করে যখন বলেন; “যে হস্তে পূজিয়াছি দেব শূলপাণি/ সে হস্তে না পূজিব চ্যাংমুড়ি কানি”, তখনও এই ‘লুক শেমিং’ দেবী মনসা শুধু হজমই করেন না, উল্টে বলেন; বাপ আমার সেই হাতে না পূজিস, আরও তো একটি হাত আছে। সেই বাঁ হাতে উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়েই একটু পুজো দে।

সুরূপের প্রতি এই দায়বদ্ধতা মানুষী কিংবা দেবী নির্বিশেষে সকল নারীকেই গুণ ও গুণের আর্থরাজনৈতিক বাজার থেকে দূরে সরিয়ে রাখে সুকৌশলে। তদুপরি রূপের লিঙ্গকরণ আমরা অন্তরে গ্রহণ করে বলি,‘ছেলেদের আর দেখায় কী যায় আসে’! অর্থাৎ মেনে নিই যে, রূপের দায় কেবল মেয়েদেরই, পুরুষের তো গুণ বিচার্য।

লক্ষ্মী সুরূপা, বন্দিত। কুরূপা অলক্ষ্মী নিন্দিত। নিন্দিত তাঁর চেহারার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনায়। পদ্মপুরাণের অলক্ষ্মী বা ঋকবেদে নিঋতি-র কুরূপের বর্ণনা রচিত, পঠিত, চর্চিত হয়েছে এ ভাবে— তাঁর খুদে খুদে চোখ, মুলোর মতো দাঁত, পশুর মতো পা, ব্যাঙের মতো শুষ্ক ত্বক, শিম্পাঞ্জির মতো চওড়া ঠোঁট আর চোয়ার মার্কা ঝোলা গাল। কুরূপ বর্ণনার এমন আতিশয্যে দিব্য মালুম হচ্ছে যে, অলক্ষ্মী একটি ‘নেগেটিভ স্টক ক্যারেক্টার’। এমন কুরূপ যাঁর, তিনি কু-গুণের অধিকারী না-হলে পোয়েটিক জাস্টিস হয় না। অলক্ষ্মীর তাই আর এক নাম কলহপ্রিয়া— তিনি গাধায় চড়েন, আর অসুর তাঁর স্বামী। ২০০০ সালে প্রকাশিত দীপেশ চক্রবর্তীর বই প্রভিন্সিয়ালাইজ়িং ইউরোপ বইতে পাই, অলক্ষ্মী যে-সংসারেই যান (সংসার ছাড়া নারী হিসাবে তাঁর আর কোথাও যাওয়ার নেই), সে সংসারেই লোকজন ঝগড়াঝাঁটি করে মরে, ভাইয়ে ভাইয়ে শত্রু হয়, সংসারের পুরুষরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ধ্বংস হয়ে যায়। এ-এক দুরন্ত আইডিয়া। সংসারের পুরুষ মানুষটির সব দোষ সংসারের মেয়েমানুষটির ঘাড়ে চাপিয়ে দাও। তার পর বলো, “তুই তো অলক্ষ্মী, তোর জন্যে আমার ক্ষতি।” এমন নির্গুণ মেয়েকে এ বার নিজের ক্ষতিপূরণে মারো, কাটো, পোড়াও, যা ইচ্ছে করো…

আসলে ত্রিলোক জুড়েই, ধমকে-চমকে আর চাপিয়ে দিয়ে মেয়েদের গুণনির্মাণ হয়েছে পুরুষের প্রয়োজন অনুসারে। তাই মেয়েদের গুণগত অস্তিত্বের স্বতন্ত্র প্রয়োজন হয়নি। স্বয়ং দুর্গারই সৃষ্টি যে ভাবে— দেবপিতা ব্রহ্মার বরে দুর্বৃত্ত মহিষাসুরের মৃত্যু কোনও পুরুষের হাতে সম্ভব নয় বলে দেবতেজে তৈরি হলেন দেবী দুর্গা। দশ হাতে দশ দেবতার প্রসাদগুণধন্য অস্ত্র ও বাহনে অসুর বধ করলেন। তার পর? দেবানুগ্রহের এই সফল লড়াইয়ের বাইরে কিন্তু তিনি কেবল এক সাধারণ বধূ ও মাতা। নেশাখোর স্বামীর সেবা করেন, সন্তান মানুষ করেন আর ফি-বছরে এক বার চার দিনের জন্যে বাপের বাড়ি আসেন।

বা, লক্ষ্মীঠাকুরের কথাই ধরুন। তিনি ত্রিদেবীর অন্যতমা, তাঁর চার হাত ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ— অস্বিত্বের চার প্রাথমিক স্তম্ভের বাহক। গজলক্ষ্মী রূপে হাতি তাঁর বাহন এবং তিনি শক্তি, বৃষ্টি ও যশের প্রতীক। বীরলক্ষ্মী রূপে সিংহ তাঁর বাহন এবং তিনি তেজ ও শৌর্যের প্রতীক। তাঁর এই মহাশক্তিরূপ খোদিত থাকত গুপ্তরাজাদের মুদ্রায়। ধনলক্ষ্মী রূপে শ্বেতপেঁচা তাঁর বাহন এবং তিনি যশোদেবী, ধনদেবী, অপার অন্ধকারেও তাঁর দৃষ্টি অনির্বাণ। তিনি লক্ষ্মীতন্ত্রে মহশ্রীরূপিণী এবং তাঁর চার স্বর্ণহস্তে মুগুর, ফল, ঢাল ও অমৃতকলস। আবার স্কন্দপুরাণ এবং তার বৈষ্ণবখণ্ডে তিনি প্রজাপতি ব্রহ্মার মা। স্কন্দপুরাণ, লক্ষ্মীতন্ত্র এবং মার্কণ্ডেয় পুরাণে লক্ষ্মী সহস্রনামা, অষ্টাদশহস্তরূপিণী। তাঁর আঠারো হাতে রয়েছে কুঠার, তীর, শঙ্খ, গদা, জপমালা, বজ্র, পদ্ম, যষ্টি, ঢাল, তরোয়াল, কলস, ঘণ্টা, ত্রিশূল, ফাঁস, চক্র, সুরাপাত্র, শক্তি ও আশীর্বাদ। এমন সর্বাঙ্গীণ, স্বয়ংসম্পূর্ণা রূপ যাঁর, তিনিও কিন্তু স্বামী বিষ্ণু-সহ সকল দাম্পত্যচিত্রে, তাঁর একক চিত্রপটের তুলনায় খর্বকায়, আকারে ছোট। জেমস লোয়ফেল্ডের ২০০২ সালে প্রকাশিত দি ইলাস্ট্রেটেড এনসাইক্লোপিডিয়া অব হিন্দুইজ়ম-এ যা বর্ণিত হয়েছে এক প্রকার চাপিয়ে দেওয়া স্ত্রীগুণ হিসাবে— স্বামীর প্রতিতুলনায় অক্ষম স্বীয় পরিবেশনার মাধ্যমে স্বামীর প্রতি সমর্পণের চিত্ররূপে।

অপর জনপ্রিয় ছবিতে লক্ষ্মী স্বামীর পদসেবারত। লক্ষ্মী তো সামান্যা নারী নন, তিনি আদিশক্তি, কমলাত্মিকা রূপে আদ্যাশক্তি। ত্রিলোকে তাঁর রূপ, গুণ, যশ ও ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দ্বিতীয়টি নেই। তিনি শুধু হিন্দুদেবী নন, কিসজুটেন নামে জাপানেও পূজিত। এমন এক গ্লোবাল দেবী মহামায়াকে যখন শায়িত স্বামীর পদসেবায় নিমজ্জিত দেখানো হয়, যখন তাঁর মুখ দিয়েই তাঁর পাঁচালিতে বলানো হয় যে, মর্তে অসুখের মূল কারণ মহিলাদের লজ্জা বিসর্জন, বিনা অনুমতিতে যত্রতত্র গমন, উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা, স্বামীর আগে ভাত খাওয়া কিংবা স্বামীর আত্মীয়দের প্রাণভরে সেবা না-করা, তখন এই মানুষের তৈরি দেবতার মাধ্যমে, আসলে মানুষেরই দেওয়া মূলবার্তা স্পষ্ট হয় এ ভাবে— “ওহে নারী, তুমি দেবীই হও বা মানুষী, যতই হও গুণবতী বা যশস্বী, রমণী পরিচয়ে তুমি সর্বদাই পুরুষের কাছে নগণ্য। জেনে রেখো, তুমি কেবল তোমার রূপসৌন্দর্যে ও দেহমাধুর্যে অন্যতমা বলে আমার সঙ্গে এক ফ্রেমে ঠাঁই পেয়েছ, না হলে সেখান থেকেও তোমায় বিলকুল কাঁচি করে দিতাম। আর এই একই কথা চোদ্দো বার করে ঘুরিয়ে, ফিরিয়ে বলতে পারিনে বাপু। এই নাও, তোমার আদর্শ যে রমণী লক্ষ্মী, ঘরে ঘরে যার নিত্য পুজো, যার মতো গোছানো সংসারের লক্ষ্যে আর যাকে সংসারে বেঁধে রাখার তাগিদে তুমি ব্রতী, যার মতো ‘লক্ষ্মী মেয়ে’ আর ‘লক্ষীমন্ত পুত্রবধূ’ কামনায় তোমার মা-ঠাকুমারা নিত্য থানে মাথা কুটছেন; এই নাও, তোমার সেই লক্ষ্মীঠাকুরকেই পাবলিকলি আমার পদসেবায় বসালাম। এই বার নিজের ক্ষমতা আর অবস্থানের দৌড় স্পষ্ট বুঝে নাও তো দেখি!”

কথা হল, আমরা মেয়েরা এ সব কথা স্পষ্ট করে বুঝে নিয়েছি আর উত্তরাধিকারসূত্রে নাগাড়ে তা আমাদের পরবর্তী মেয়ে প্রজন্মকে দিয়েও যাচ্ছি। এ-প্রসঙ্গে পেপসিকো-র প্রাক্তন সিইও এবং চেয়ারপার্সন ও বিশ্বের প্রথম একশো জন সফলতম নারীর তালিকায় স্থান করে নেওয়া ইন্দ্রা নুয়ির একটি সাক্ষাৎকারের কথা মনে পড়ছে। নুয়ি বলছেন, “অফিস থেকে ফিরে গ্যারাজে গাড়ি রেখে সবে বাড়িতে ঢুকতে যাব, সিঁড়ির উপর থেকে মা বললেন, ‘বাচ্চা দুটোর জন্যে একটু দুধ কিনে একেবারে ঢোক, মা’। তখন রাত দশটা। গ্যারাজের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম আমার কত্তা ইতিমধ্যেই বাড়ি চলে এসছেন। বললাম, ‘ও কখন এসেছে?’ ‘এই আটটা নাগাদ’, মা বললেন। ‘ওকে আনতে বলতে পারলে না এত ক্ষণে?’ আমার প্রশ্নের উত্তরে মা বললেন, ‘ও ক্লান্ত আছে, সারা দিন অফিস করেছে।’ কথা না-বাড়িয়ে দুধ কিনে এনে টেবিলের উপরে রেখে রাগত কণ্ঠে মা-কে বললাম: ‘তোমার ধারণাই নেই যে, আজ আমি পেপসিকো-র প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছি, এবং আজ থেকে আমি বোর্ড অব ডিরেক্টর্সের মেম্বার।’ মা বললেন, ‘সে তুমি যেখানে যাই হও না বাপু, এ-সংসারে তুমি কেবল এক জন বৌ এবং দুই সন্তানের মা।’”

এ বার যদি আপনার-আমার তৈরি করা লক্ষ্মীর এমন লিঙ্গভিত্তিক লৌকিক কনসেপ্টের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলি, প্রশ্ন করবেন?

অন্য বিষয়গুলি:

Lakshmi Puja kojagori lakshmi puja Discrimination
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE