E-Paper

কূটনীতির স্নায়ুযুদ্ধ

কূটনৈতিক কর্তাটি প্রথম দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে বৈঠকের সম্ভাবনা যে ভাবে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, তার মধ্যে সারবত্তা ছিল না এমনটি নয়।

পাশাপাশি?: তাইল্যান্ডে মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে নরেন্দ্র মোদী। পিটিআই।

পাশাপাশি?: তাইল্যান্ডে মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে নরেন্দ্র মোদী। পিটিআই।

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২৫ ০৮:২৬
Share
Save

নিত্যদিন ভারতকে গালি দেওয়া হচ্ছে। বার বার বলা সত্ত্বেও সংখ্যালঘু হিন্দুদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নেই। চিন কি ওদের খাওয়াবে, না পাকিস্তান? ইসলামাবাদ নিজেদের রুটি নিজেরা জোগাড় করতে পারছে তো! এক দিকে গালিগালাজ, অন্য দিকে টেবিলে বসে কথা— এক সঙ্গে তো হতে পারে না।”

ক্ষোভ, ব্যঙ্গ, হতাশার মিশ্রণে এই কথাগুলি সাউথ ব্লকের এক অন্যতম শীর্ষকর্তার কাছ থেকে যখন ছিটকে এসেছিল, ব্যাংককের শাংগ্রিলা হোটেলে ভারত ও বাংলাদেশের শীর্ষনেতৃত্বের মধ্যে হওয়া পার্শ্ববৈঠকের তখন আর এক পক্ষকালও বাকি নেই। সাধারণ ভাবে বিদেশনীতির রীতি হল, ছ’মাস পরে কোনও দেওয়ালে পেরেক পোঁতার কথা থাকলে এখনই সেখানে গর্ত করার পরিকল্পনা পাকা করে ফেলা। পেরেকের রং কেমন হবে, কে তা হাতে করে দেওয়ালের কাছে নিয়ে যাবেন, ঠিক ক’টায় সেই শুভকার্য শুরু ও শেষ করতে হবে, কত জন আমন্ত্রিত থাকবেন— চূড়ান্ত ফাইল তৈরি হয়ে তিন টেবিল ঘুরে আসে ঢের আগেই।

আর এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশী বলয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং অধুনা অশান্ত দেশটির পক্ষ থেকে বৈঠকের প্রকাশ্য বায়না জমা পড়ার এবং বিমস্টেক সম্মেলন ঘনিয়ে আসা সত্ত্বেও, এতটাই নেতি জমে ছিল সাউথ ব্লকের ক্ষমতা-করিডরে। যে নেতি তার পর বদলে গেল অনিশ্চয়তা এবং দোলাচলে। তার পর আশঙ্কা এবং শেষে অনিচ্ছুক মনে বৈঠকের প্রস্তাবটি স্বীকার করা হল।

এমন কূটনৈতিক চিত্রনাট্য গত দু’দশকে বার বার আমরা দেখেছি পাকিস্তান প্রসঙ্গে। বিদেশনীতিতে নতুন হাত পাকানো কোনও সাংবাদিকের কাছে চিরকাল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের ঝঞ্ঝাট। এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে যে কোনও স্তরের বৈঠকের সম্ভাবনা (যে কোনও বহুপাক্ষিক মঞ্চে) কিউমুলোনিম্বাস মেঘের থেকেও অনির্ণেয়। এক নেতা অন্যের দিকে তাকালেন কি না, কত ক্ষণ করমর্দন করলেন, শেষ মুহূর্তে বৈঠক ভেস্তে যাচ্ছে কি না— গোটা বিষয়টিকে সঠিক ভাবে অনুকরণ করা বা আগাম খবর করা ছিল সত্যিই চ্যালেঞ্জ। আপাতত দীর্ঘ দিন পাকিস্তানের সঙ্গে শীর্ষপর্যায়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পাট চুকেছে। সার্ক সম্মেলন পাকাপাকি ভাবে হিমঘরে চলে গিয়েছে। কিন্তু প্রকৃতি কিছুই শূন্য রাখে না। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের নতুন শিরঃপীড়া এখন বাংলাদেশ, যা কিছু মাস আগেও ‘সোনালি অধ্যায়’-এর অংশ ছিল। এ বারের তাইল্যান্ড-বৈঠকটি তাই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের চুয়ান্ন বছরের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে ‘অন্য রকম’ এক কূটনীতির হদিস দিল।

কূটনৈতিক কর্তাটি প্রথম দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে বৈঠকের সম্ভাবনা যে ভাবে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, তার মধ্যে সারবত্তা ছিল না এমনটি নয়। তিনি তো মনগড়া কোনও কথা বলবেন না। সরকারের এই পর্যায়ে ব্যক্তিগত মতামতে নীতি নির্ধারিত হয় না। আসলে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল এবং তাঁর বাহিনী গোড়া থেকেই চাইছিলেন না, মুহাম্মদ ইউনূসের মুখোমুখি হন নরেন্দ্র মোদী। তাঁদের মত ছিল, বৈঠকে বসলে সে দেশের অন্তর্বর্তী সরকার যা করে চলেছে তা এক ধরনের কূটনৈতিক মান্যতা পেয়ে যাবে। বৈঠকের পর নিজেরা কাড়া-নাকাড়া বাজিয়ে ‘ন্যারেটিভ’ তৈরি করার সুযোগ পাবে। সবচেয়ে বড় কথা, যে কোনও টান-টান শীর্ষ আন্তঃরাষ্ট্রীয় বৈঠকের যে আবশ্যক দু’টি শর্ত থাকে, এ ক্ষেত্রে তার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না বা নেই— এক, আলোচনার পূর্বমুহূর্তে উভয়ত একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করা; দুই, আলোচনার পর হাতেকলমে কিছু সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার (টেকঅ্যাওয়ে) জোগাড় রাখা। সদ্যসমাপ্ত মোদী-ইউনূস পর্বে এর কোনওটাই হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান তাঁর ঘরোয়া আওয়ামী লীগ-বিরোধী আবেগকে পতাকার মতো উড়িয়ে (তাতে তাঁর গদিতে আরও কিছু দিন টিকে থাকতে সুবিধা) শেখ হাসিনা সম্বন্ধে বহু কটু কথা বলেছেন মোদীর সামনে। বৈঠক-পরবর্তী যে ভাষ্যটি প্রকাশ করেছে তাঁর দফতর, তাতে বলা আছে ইউনূস মোদীর কাছে জানতে চেয়েছেন, আমরা হাসিনাকে যে ফেরত চাইছি তার কত দূর! আমরা জানি যে, তাঁর ঘরোয়া রাজনীতির জন্য এই ভাষ্য তৈরি হয়েছে, কিন্তু এর প্রভাব ভারতের মতো বিশাল রাষ্ট্রের বাজার, রাজনীতি, ধর্মীয় বিভাজনে নানা ভাবে পড়বে। অন্য দিকে, মোদী কাটা রেকর্ডের মতো পুনরাবৃত্তি করেছেন বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে ভারতের উদ্বেগ। জানিয়েছেন, ভারত সে দেশে দ্রুত নির্বাচন চায়। কিন্তু এর কোনও পাথুরে প্রতিশ্রুতি ইউনূসের কাছ থেকে পাওয়া গিয়েছে এমন খবর নেই।

কংগ্রেস ন্যায্য ভাবেই খোঁচা মেরেছে প্রধানমন্ত্রীর ‘ঝুঁকে পড়া’ নিয়ে। অভিযোগ, কোনও নিশ্চিত আশ্বাস ছাড়াই মোদী বসে গিয়েছেন বাংলাদেশের ক্রমাগত চাপের ফলে। অন্য দিকে, এই বৈঠককে এ বার সাজিয়ে গুছিয়ে নিজেদের সুবিধামতো কাজে লাগানোর সুযোগও পেয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে না গিয়ে রাজ্যপাটে দীর্ঘমেয়াদি ভাবে জুড়ে বসার যে লক্ষণগুলি ইউনূস সরকারের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, তাতে ভারতেরও সিলমোহর (তা সে যতই অস্ফুট হোক না কেন) পড়েছে।

এ কথাটা স্পষ্ট করেই বলতে হচ্ছে যে, অনেক কাটাছেঁড়া বিচার-বিশ্লেষণের পর ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতের সিদ্ধান্তটা কার্যত বাধ্য হয়ে শেষ মুহূর্তে নিতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে। তিনি অনন্যোপায় হয়ে পড়েছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের কূট নীতি-নকশার সামনে। বিশ্লেষকরা বলেন, এটা আর অজানা নয় যে, এই অঞ্চলে যখন কোনও দেশের সরকার চিনের দিকে ঝুঁকতে উদ্যত হয় বা ঘনিষ্ঠতা বাড়ায় এমনকি বাড়ানোর ভানও করে, ভারতের কালঘাম ছুটতে থাকে। শুধু মোদীকে এই প্রবণতায় দুষ্ট বলে লাভ নেই। মনমোহন সরকারের সময়, প্রণব মুখোপাধ্যায় বিদেশমন্ত্রী থাকার কালেও এই এক চিত্রনাট্যের পুনরাবৃত্তি আমরা দেখে আসছি বার বার। অত্যন্ত বিচক্ষণ, পোড় খাওয়া কূটনীতিকের মতো ইউনূস তাঁর পালাটি এ বার সাজালেন। বিমস্টেকের আগে, ভারতের সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ বাতাসে ভাসিয়ে দিয়ে তিনি বেজিংয়ে চলে গেলেন। সেখানে দাঁড়িয়ে সরাসরি ভারতের দুর্বল স্নায়ুমূলে হাত রাখলেন। বললেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত বোনের এক চম্পা তাঁরাই! সাতটি রাজ্যই স্থলবেষ্টিত, সমুদ্রের কাছে পৌঁছনোর কোনও উপায় তাদের নেই। এই অঞ্চলের সমুদ্র-অভিভাবক বাংলাদেশই। এখানেই না থেমে ইউনূস তিস্তা মহাপরিকল্পনার কথা পাড়লেন। জানালেন, ভবিষ্যতে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে সহায়তা করবে চিন। আর এটি বাস্তব হলে ভারতের মানচিত্রের ‘একিলিস’ হিল’খ্যাত ‘চিকেন নেক’-এ বা শিলিগুড়ি করিডরের কাছে ড্রাগনের নিঃশ্বাস পড়বে— তার ইঙ্গিতও পড়ে নিতে পারল সাউথ ব্লক।

পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর শীর্ষ প্রতিনিধিদলের ঢাকা সফর নিয়ে উদ্বেগের বাতাবরণ তৈরি হয়ে ছিলই। তা শুকোতে না শুকোতে চিনের নতুন ধাক্কা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলল। অন্য দিকে, ইউনূসের কর্তারা সমানে মুখে এটাই বলে যেতে থাকলেন, ভারত চাইছে না বলেই বাধ্য হয়ে তাঁকে বেজিং সফরে যেতে হল। নয়তো বাংলাদেশের প্রধানের তো প্রথম গন্তব্য হওয়ার কথাই ছিল নয়াদিল্লি!

ভারত ইউনূসকে আমেরিকার ডেমোক্র্যাটদের পুতুলের বেশি কদাপি গণ্য করেনি। সেই তিনিই যে এমন ব্যূহ রচনা করবেন, হয়তো ভাবেননি কূটদর্শী অজিত ডোভাল এবং তাঁর দল। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে আরও ঠেলে সরিয়ে দিলে সে দেশের ভারত-বিরোধী ভাষ্য, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ, কট্টরপন্থার বাড়বাড়ন্তকে সামলানো যাবে না— শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তেই এল বিদেশ মন্ত্রক এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। আর তাই আগের রাতে মোদী কাঠের মতো ইউনূসের পাশে বসে নৈশাহার সারলেও, পরের দিন দুপুরে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেন। ভিডিয়োতে দেখা গেল, করমর্দনকালে হাত ঝাঁকিয়েই চলেছেন ইউনূস। নান্যোপায় মোদীও, যত ক্ষণ না বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা তাঁকে অব্যাহতি দেন!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Muhammad Yunus Narendra Modi

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।