—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
সুইৎজ়ারল্যান্ডে ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম শুরু হয়েছে। আর সেখানে আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভার দাবি করেছেন, চলতি ক্যালেন্ডার বছরে বিশ্ব অর্থনীতি গত বছরের তুলনায় ভাল করবে। কিন্তু লোহিত সাগরের হাউথিরা যে ভাবে জাহাজের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে, ইরান যে ভাবে ইরাকের উপর অতর্কিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে এবং অবশ্যই ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধ, তার পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রক্ষেপ কতটা বাস্তব সাংবাদিকদের সেই প্রশ্নের কোনও উত্তর তিনি দেননি।
তবে ভারত মহাসাগরে ২০০০ সাল থেকে যে ভাবে জলদস্যুদের অত্যাচার বাড়ছে তাতে বিশ্ববাণিজ্যের উপর চাপ বাড়ছেই। ইনটেল ইতিমধ্যেই তাদের চিপ তৈরির কারখানা এশিয়া থেকে সরিয়ে ইউরোপে করার কথা ভাবতে শুরু করেছে এবং তা ঘোষণাও করেছে সোমবার।
সুয়েজ খাল এশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্যের অন্যতম দরজা। বিশ্ববাণিজ্যের ১২ শতাংশ চলে লোহিত সাগর দিয়ে। আর তার মধ্যে ৩০ শতাংশই হল কনটেইনারবাহী জাহাজ। এর পরিপ্রেক্ষিতে সোমালিদের পরে হাউথিরা এখন যে ভাবে আধুনিক অস্ত্রসম্ভার নিয়ে বাণিজ্য জাহাজগুলোর উপর হানা দিতে শুরু করেছে তাতে যে জাহাজ পরিবহণ সংস্থাগুলি এই অঞ্চল এড়িয়ে চলার সিদ্ধান্ত নেবে তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে!
ইতিমধ্যেই তাদের জাহাজের বিমার খরচ বাড়তে শুরু করেছে। একটি হিসাব বলছে বিমার খরচ বেড়েছে ১৭৩ শতাংশ। এ বার সুয়েজ খাল এড়িয়ে যদি এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চালাতে হয় তাতে দুরত্ব বাড়ার কারণে শুধু জ্বালানির খরচই যে বাড়বে তাই নয়, তার সঙ্গে সময়ও অনেক বেশি লাগবে। আর এই দুই কারণেই পণ্য পরিবহণের খরচ আরও বাড়বে। যার প্রতিফলন বিশ্বজুড়ে পণ্যের দামের উপর পড়তে বাধ্য। মজার ব্যাপার হল সুয়েজ খাল কিন্তু তৈরি হয়েছিল এই খরচ কমানোর উদ্দেশ্যেই।
মাথায় রাখতে হবে বিগত কয়েক বছরে বিশ্ব জুড়ে মুদ্রাস্ফীতির চাপ সামলাতে প্রতিটি দেশের শীর্ষ ব্যাঙ্ক সুদের হার ক্রমাগত বাড়িয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। এর প্রভাব পড়েছিল বৃদ্ধির হারের উপর। সুদের হার বাড়ায় বিনিয়োগের খরচ বাড়ার ফলেই নতুন বিনিয়োগ গতি হারিয়েছিল। গত দু’টি ত্রৈমাসিকে মুদ্রাস্ফীতির হার সহনশীল হয়ে ওঠায় সুদের হার কমার আশা তৈরি হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলোর নীতি নির্দেশও সেই ইঙ্গিতই করছিল। কিন্তু সেই ইঙ্গিত কি কার্যকর করা যাবে?
ইজ়রায়েল-হামাস দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে ইরানের ইন্ধনে হাউথিরা বাণিজ্য জাহাজের উপর যে আক্রমণ শানিয়েছে তাতে নতুন করে তৈরি হওয়া অন্য আরও অশান্তির কারণে এই আশার মুখে ছাই পড়তে পারে।
হউথিরা ইয়েমেনের একটি জনগোষ্ঠী। হাউথি আন্দোলনের শুরু ১৯৯০ সালে। আনসার আল্লাহ বা ইশ্বরের সমর্থক বলে পরিচিত এই শিয়া ইসলামিক গোষ্ঠী যাত্রা শুরু করে ইয়েমেনি রাষ্ট্রপতি আবদুল্লাহ সালের বিরোধী গোষ্ঠী হিসাবে। এদের ঘোষিত শত্রু হল ইজ়রায়েল, ইহুদি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এবং ইজ়রায়েল-হামাস যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাদের ঘোষিত অবস্থান হল যে লোহিত সাগর অঞ্চলে মার্কিন মদতপুষ্ট সব দেশের জাহাজকেই তারা নিশানা করবে।
এটা যদি হুমকিতে সীমাবদ্ধ থাকত তা হলে হয়ত বৃদ্ধির হার নিয়ে জর্জিয়েভার দাবির উপর প্রশ্নচিহ্ন বসত না। কিন্তু হাউথিরা সেই হুমকিকে কার্যকর করে ফেলাতেই আশঙ্কার মেঘ ঘনাতে শুরু করেছে। এতটাই যে ভারতের বিদেশ মন্ত্রী এস জয়শঙ্কর উড়ে গিয়েছেন ইরানে প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির সঙ্গে বৈঠক করতে। সেই আলোচনায় নাকি লোহিত সাগরে বাণিজ্য জাহাজ নিয়ে হাউথি আক্রমণ মার্কিন বক্তব্যও জয়শঙ্করের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
ইতিমধ্যে ব্রিটিশ এবং মার্কিন সরকার এই আক্রমণ যে ভাবেই হোক মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের যুদ্ধজাহাজও ওই অঞ্চলে টহল দিচ্ছে। নেট দুনিয়া ভাসছে সারা দিনে কটা হাউথি আক্রমণ প্রতিহত করা হল তার হিসাব নিয়ে।
এই সমস্যা যদি শুধু পশ্চিমী দুনিয়ার হত তা হলে এক প্রশ্ন ছিল। কিন্তু এখানে বিশ্ব বাণিজ্য জড়িত। ভারতের পক্ষে আরও চিন্তার ব্যাপার হল বাণিজ্য জাহাজে মোট নাবিক সংখ্যার ১৫ শতাংশই ভারতীয়। তাই সোমালি সমস্যার সময়ও ওই অঞ্চলে ভারতীয় নৌজাহাজ টহল দিতে বাধ্য হয়েছিল এবং এখনও এই আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ভারতীয় নৌশক্তির নিত্য উপস্থিতি ওই অঞ্চলে রাখতেই হচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লোহিত সাগর অঞ্চলে বাণিজ্য জাহাজের উপর এই আক্রমণ রুখতে আগেই তাদের নেতৃত্বে ‘কম্বাইন্ড টাস্ক ফোর্স ১৫৩’ তৈরি করে। এখন যা ‘সিটিএফ ১৫৩’ নামে বিশ্বজুড়ে শিরোনাম দখল করে নিয়েছে। ঘোষিত হয়েছে ‘অপারেশনস প্রসপারিটি গার্ডিয়ান’। নামেই প্রকাশ তার উদ্দেশ্য। আর্থিক সমৃদ্ধির অভিভাবক! বাণিজ্য আটকালে সমৃদ্ধি ব্যাহত হবে। হাউথিরা সেটাই চায়। আর বাকি দুনিয়া সেই প্রচেষ্টায় জল ঢালতে চায়।
ইতিমধ্যেই লোহিত সাগর দিয়ে তেলের ট্যাঙ্কার চলাচল বন্ধ হতে শুরু করেছে। কাতারের তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস ভর্তি একাধিক ট্যাঙ্কার ওমানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। লোহিত সাগরের সমস্যা এড়াতে। এতে জ্বালানির দাম বাড়তে বাধ্য। এর প্রভাব তো বিশ্ব বাণিজ্যে পড়বেই।
সমস্যা হচ্ছে বিশ্বজুড়ে বিবাদ বাড়ছেই। ইউক্রেন-রাশিয়া, ইজ়রায়েল-হামাস আর এখন ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র যা ইরাকে আছড়ে পড়েছে। আফ্রিকার একটা বড় অংশে বাড়ছে হিংসা এবং গৃহযুদ্ধ।
এর ফলে খাদ্যশস্যের দাম আরও বাড়বে। বাড়বে জ্বালানির খরচও। গোটা ইউরোপ শীত এড়াতে ঘর গরম রাখার খরচ সামলাতে পারছে না, রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে জ্বালানির খরচ বাড়ায়। এশিয়ায় বিনিয়োগের ঝুঁকি যে বাড়ছে তা ইনটেলের ঘোষণাতেই প্রতিফলিত। প্রশ্ন হচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগ টানায় ভারতের ভবিতব্য নিয়েও। চিনের সঙ্গে পশ্চিমী দুনিয়ার মত পার্থক্যের কারণে এবং ভারতের বাজারের গভীরতা মেপে অ্যাপলের মতো অনেকেই ভারতে পা রাখার কথা ভাবছে। কিন্তু যে ভাবে পশ্চিম এবং বাকি দুনিয়ার মধ্যে নানান কারণে একটা প্রভেদ রেখা গভীর হয়ে উঠছে তাতে ভারতের প্রতি বিনিয়োগ স্রোতের যেটুকু আকর্ষণ তৈরি হয়েছে তা ক্ষীণ হয়ে যাবে না তো?
তবে এটা ঠিক যে ২০২৪ সাল নিয়ে বিশ্বের অর্থনীতি নিয়ে যে আশা তৈরি হয়েছিল সেই আশা ক্ষীণ হতে শুরু করেছে। বিশ্বজুড়ে যে গতিতে হানাহানি বাড়ছে তা কি সেনা নামিয়ে থামানো যাবে? এই প্রেক্ষিতে যে প্রশ্ন এখন আরও বড় হয়ে উঠছে তা হল বিশ্ব জুড়ে সমৃদ্ধির গতি অব্যাহত রাখতে পেশি শক্তি কতটা কার্যকরী হবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy