Advertisement
E-Paper

পাড়ার মুদিখানা আর কত দিন

এটি একটি ধাঁধা— বাবুদের মতো বিক্রেতারা কী করছেন, যা এই সুপারমার্কেটগুলি করতে পারে না? বাবুরা আসলে খদ্দেরদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করছেন, যা টাকাপয়সার লেনদেনের হিসাবের বাইরে।

kirana stores.

—ফাইল চিত্র।

পরন্তপ বসু

শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:১৮
Share
Save

বাড়ির অদূরেই তৈরি হয়েছে সুপারমার্কেট— যা চাই, এবং যা চাই না, তার সবই সাজানো রয়েছে থরে-থরে। তবুও দেখি, পাড়ায় বাবুর মুদিখানাটি দিব্য চলছে। সব সময়ই ভিড়। অনেক সময় খদ্দেরকে তাঁর চাহিদার জিনিসটা দিতে পারেন না বাবু, জানান, “আজ নেই, কাল আসবে।” খদ্দেরও মেনে নেন, পরের দিন আসেন সেই জিনিসটা নিতে। জিজ্ঞাসা করায় বাবু জানালেন, কাছাকাছি সুপারমার্কেট হওয়ায় তাঁর ব্যবস্থার একটু ক্ষতি হচ্ছে বটে, কিন্তু বাঁধা খদ্দেররা এখনও আছেন।

এটি একটি ধাঁধা— বাবুদের মতো বিক্রেতারা কী করছেন, যা এই সুপারমার্কেটগুলি করতে পারে না? বাবুরা আসলে খদ্দেরদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করছেন, যা টাকাপয়সার লেনদেনের হিসাবের বাইরে। তাঁরা চেনা খদ্দেরকে দেখে একটি ঝকঝকে হাসি উপহার দেন, কুশলসংবাদ নেন। টুকটাক ধার-বাকিও দিয়ে থাকেন প্রয়োজনে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে এই ধরনের দোকানগুলিকে বলে কিরানা। শুধু কেনা-বেচা নয়, সেই দোকানগুলোয় নানাবিধ কাজ হয়— খদ্দেরের ইলেকট্রিক বিল মেটানো, ট্রেনের টিকিট কেটে দেওয়া, মোবাইল রিচার্জ, বাড়ির দালালি, ঘটকালি, ছোটখাটো ঋণ দেওয়া ইত্যাদি। স্বভাবতই এই দোকানগুলিকে কেন্দ্র করে মানুষের সঙ্গে মানুষের সামাজিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ২০২১ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে প্রায় এক কোটি দশ লক্ষ কিরানা স্টোর আছে, যা ভারতের খুচরো বাজারের প্রায় নব্বই শতাংশ। এই ধরনের কিরানা স্টোরগুলিতে কর্মসংস্থানও হয় ভাল।

যে-হেতু এই দোকানগুলোর বেশির ভাগ লেনদেনই নগদে হয়, ফলে আয়কর ফাঁকি দেওয়ার একটা সমস্যা এই ক্ষেত্রে আছে। তবে, ইদানীং এই দোকানগুলিতে ডিজিটাল লেনদেনের পরিমাণ বাড়ছে। অনেকে পণ্য ডেলিভারি করার জন্য ব্যবহার করছেন বিভিন্ন ধরনের ই-কমার্স অ্যাপ। দোকানে কম্পিউটারও বসাচ্ছেন অনেকেই।

আমেরিকাতে স্থানীয় মনিহারি দোকানগুলিকে বলে মম অ্যান্ড পপ স্টোর। ২০২০ সালের ফাইনানশিয়াল টাইমস-এর একটি তথ্য বলছে, সেই সময় আমেরিকাতে ৪৭ লক্ষ মম অ্যান্ড পপ স্টোর ছিল, যেখানে প্রায় সওয়া এক কোটি কর্মী কাজ করতেন। এই দোকানগুলি এক দিকে ওয়ালমার্টের মতো সুপারমার্কেট আর অপর দিকে অ্যামাজ়নের অভ্যুত্থানের মাঝে চাপের মধ্যে ছিল। নিউবেরিপোর্টে ড্রাগন’স নেস্ট— যেটি চার্লস ডিকেন্সের বিখ্যাত উপন্যাস দি ওল্ড কিউরিয়োসিটি শপ-এর আদলে খেলনা বিক্রি করত বিগত চার দশক ধরে— সেটিরও মৃত্যু হল ২০২০-র অগস্টে। কোভিডের পরে এই ছোট প্রতিষ্ঠানগুলি কিছু কিছু আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে। ইংল্যান্ডে এই ধরনের দোকানগুলোকে কর্নার শপ বলা হয়। সম্প্রতি দ্য গার্ডিয়ান-এর একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ইংল্যান্ডে এখন প্রায় ৫০,০০০ কর্নার শপ আছে যেগুলি মূলত ভারতীয়রা চালান।

ভারতে অতিমারির ফলে এই ধরনের ছোট প্রতিষ্ঠানগুলি মার খেয়েছে ঠিকই, কিন্তু পশ্চিম বিশ্বের তুলনায় এই মনিহারি দোকানগুলি উঠেও দাঁড়িয়েছে তাড়াতাড়ি। বিদেশে মম অ্যান্ড পপ স্টোরগুলি বহুলাংশে মার খেলেও লন্ডন আর নিউ ইয়র্কের রাস্তায় এখনও ফুটপাতের উপরে কিছু দোকানে টুকিটাকি জিনিস পাওয়া যায়। তবে সেখানে ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক নৈর্ব্যক্তিক, কারণ ভ্রাম্যমাণ ক্রেতা সচরাচর একই দোকানে যান না। সুতরাং এই দোকানগুলো মম অ্যান্ড পপ স্টোর নয়।

ভারতে কিরানা দোকানগুলির ভবিষ্যৎ কী? প্রথমত, এটি মনে রাখতে হবে যে, এই দোকানগুলিতে বেশি সওদা করেন নিম্ন আর মধ্যবিত্ত মানুষ। এখনও ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে সুপারমার্কেটের সংখ্যা খুব বেশি নয়। সেখানে যে সব মানুষ যাতায়াত করেন, তাঁদের অনেকেরই নিজস্ব গাড়ি আছে। ২০২৩-এ প্রকাশিত, বিশ্ব ব্যাঙ্কের মেক্সিকো নিয়ে একটি সমীক্ষা থেকে জানতে পারছি যে, সেখানে একশো জন নাগরিকপিছু একটি মম অ্যান্ড পপ স্টোর দেখতে পাওয়া যায়। তুলনামূলক ভাবে আমেরিকাতে এই সংখ্যাটি ২২০০। সমীক্ষাটি এ কথাও বলছে, যেখানে পেট্রলের দাম বেশি, সেখানে মম অ্যান্ড পপ দোকানগুলির সংখ্যাও বেশি। অর্থাৎ, এমন মুদিখানা সেখানেই গজিয়ে উঠছে বেশি যেখানে যাতায়াত ব্যয়বহুল।

দ্বিতীয়ত, এটিও ঠিক যে, অনেক কিরানা দোকান এখন আধুনিক হয়ে গেছে। তাদের নিজস্ব অ্যাপ আছে। ক্রেতারা সেটি ডাউনলোড করে জিনিসপত্র অর্ডার করতে পারেন। ইউপিআই ব্যবহার করে দাম মেটাতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রে কিরানারা অতিবৃহৎ সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধছে। যেমন, রিলায়েন্স কিরানা দোকানগুলির সঙ্গে স্থানীয় ক্রেতাদের যোগাযোগ করতে সাহায্য করছে। সুতরাং, বড় সংস্থা যে সর্বদাই কিরানা দোকানগুলির ব্যবসা কেড়ে নিচ্ছে, তা নয়। তবে এই ধরনের লেনদেন সম্পূর্ণ ডিজিটালভিত্তিক। যে সব কিরানা দোকান এই ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করতে উৎসাহী হবে না, তাদের অবস্থা ক্রমশই কঠিন হবে।

অর্থশাস্ত্রের একটি মন্ত্র হল ক্রেতার স্বাচ্ছন্দ্য বাড়ানো। সুপারমার্কেট, টেলিমার্কেট অনেকাংশে ক্রেতা স্বাচ্ছন্দ্য বাড়িয়েছে ঠিকই, অন্য দিকে ক্ষুদ্র বিক্রেতারা যাঁরা বাড়ি বাড়ি হেঁটে বা সাইকেল-ঠেলাগাড়িতে পণ্য ফেরি করে বেড়াতেন, ক্রমশই নেপথ্যে চলে যাচ্ছেন। ডিজিটাল পদ্ধতিতে লেনদেন যত বেশি হবে, ক্রেতারা স্মার্টফোনে যত বেশি কেনাবেচা করবেন, কিরানা দোকানের সামনে জটলাও ততই কমে আসবে। মানুষের সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত সংযোগের পীঠস্থান এই কিরানা দোকানগুলির প্রয়োজনও হয়তো ফুরিয়ে যাবে। অর্থাৎ, একটি দেশের উন্নয়নের গতি যত বাড়বে, যোগাযোগ ব্যবস্থা যত উন্নত হবে, ডিজিটাল লেনদেন যত বাড়বে, ততই পাড়ার মুদি দোকানের পসার কমে আসবে। এগুলিই হয়তো জোসেফ শুম্পেটারের ভাষায় ‘ক্রিয়েটিভ ডেস্ট্রাকশন’। সে দিন কত দূরে? কালের যাত্রাই তা বলতে পারবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Shops India

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}